সুপেয় পানির চরম সংকটে পাইকগাছাবাসী

দুর্ভোগ চরমে

প্রকাশ | ১৮ জুন ২০২৫, ১৯:০৭

পাইকগাছা (খুলনা) প্রতিনিধি
খুলনার পাইকগাছায় সুপেয় পানি নিতে দূরদূরান্ত থেকে আসা নারীদের ভিড়: ছবি যায়যায়দিন

সুপেয় ও নিরাপদ পানির অভাবে চরম দুর্ভোগে রয়েছেন পাইকাগাছা উপজেলাবাসী। অপরিকল্পিত উন্নয়ন, নিরাপদ পানির উৎস তৈরিতে সরকারি উদ্যোগ না থাকা, বহমান উৎসগুলো সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করার কারনেই এ সমস্যা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। তবে সচেতন মহল ও স্থানীয়রা এ সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানান।

বাংলাদেশের দক্ষিণের এ অঞ্চলে লবণ পানি হওয়ায় এবং পানির লেয়ার নিচে নেমে যাওয়ায় সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। পানির সংকট হওয়ায় দূরদূরান্ত থেকে বাড়ির মহিলারা খাওয়ার পানি সংগ্রহ করেন। 

লবণ পানি-অধ্যুষিত উপকূলবর্তী খুলনার দক্ষিণ জনপদ পাইকগাছা। এ অঞ্চলে সুপেয় পানির বড়ই অভাব। প্রাকৃতিক উৎসগুলো শুকিয়ে যাওয়া, সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় গড়ে ওঠা জলাধারাগুলো চাহিদা পূরণের সক্ষম না হওয়ায় তীব্র সংকট সৃষ্টি হয়েছে। 
নিরাপদ খাওয়ার পানি সংকট কাটিয়ে উঠতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন সচেতন মহল।

সরেজমিন ঘুরে ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার লতা-দেলুটি ইউনিয়নের একটি বাসের সাঁকো পার হয়ে লতার এপার থেকে ওপারে প্রতিদিন শতশত মানুষ দেলুটির একটি মিষ্টি পুকুরের ফিল্টার থেকে পানি সংগ্রহ করেন। কিন্তু পানির ফিল্টারটি দীর্ঘদিন অকেজো হয়ে পড়ায় পানির তীব্র সংকটে জীবন পার করছে লতা-দেলুটি ইউনিয়নের মানুষ।
অপরদিকে লস্কর ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায়, আলমতলা ও লক্ষীখোলার মাঝামাঝি একটি পুকুরের পানির ফিল্টার থেকে দুই থেকে তিন শতাধিক এর বেশি মানুষ সকাল-বিকাল পানি সংগ্রহ করেন। 

লক্ষীখোলা গ্রামের ইসমাইল হোসেনের স্ত্রী মাহফুজা বেগম বলেন, ‘আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে এই ফিল্টার থেকে পানি নিতে আসি। এত দুর পথ প্রতিদিন হেঁটে আসা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই একটা কলসি আর এই ছোট একটি পটে করে পানি নিয়ে যাই। 
এই পানি রান্নার কাজে ব্যবহার করি এবং খাই। যেটা আমাদের ছোট সংসারে দুই দিন চলে যায়। এত দূরদূরান্ত থেকে পানি নিয়ে যাওয়া ও কষ্টের ব্যাপার।’

পৌর সদরস্থ মধুমিতা পার্কে পানি প্রকল্পের আওতায় বি ব্লকে পানি নিতে আসা শুধু পৌরবাসী নয়, পার্শ্ববর্তী লস্কর ইউনিয়নের কড়ুলিয়া স্মরণখালী, আলমতলা নারী-পুরুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে কেউ কলসিতে, কেউ পটে করে পানি সংগ্রহ করেন।
পানি সংকটের কারণে পৌরসভা পানি দিতে হিমশিম খাচ্ছে। কিন্তু পানি ছাড়া তো এক দিনও চলে না।প্রত্যেকেই নিরুপায় হয়ে শ্যাওলাভর্তি, দুর্গন্ধযুক্ত পুকুরের পানি পান করতে বাধ্য হচ্ছেন এবং পড়ছেন স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। আবার পানি সংরক্ষণের মত বড় পুকুরেরও অভাব। দীর্ঘদিন ধরে সুপেয় পানির চরম সংকট হওয়ায় পানির অভাবে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়ছে এলাকাবাসী। পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারায় পুকুরের শ্যাওলাভর্তি, দুর্গন্ধযুক্ত পানি পান করতে বাধ্য হচ্ছেন পৌরবাসী।


প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে ৯নং ওয়ার্ড থেকে আসা চঞ্চলা রাণী, আরতী ও নাজমা আক্তারদের সাথে কথা হলে বলেন, এখান থেকে আমরা নিয়মিত পানি নেয়। কয়েক দিন ধরে পানি নেই। বাধ্য হয়ে পুকুর থেকে পানি সংগ্রহ করছি। উপজেলার লোনা পানি কেন্দ্রের পুকুর থেকে ড্রামে পানি তোলার সময় ভ্যানচালক সুশান্ত মন্ডল বলেন, পৌরসভা যে পানি দেয় খাওয়া যায় না। আমি প্রায় ৩-৪ কিলোমটার দূরে শিববাটি, 
পাশে সরল ও বাতিখালী গ্রামের অনেক মানুষদের খাওয়ার জন্য এখান থেকে পানি সরবরাহ করি। আর পৌরসভা আজকে পানি দেয় তো কালকে দেয় না। 
পৌর সদরের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পুকুর থেকে পানি নিতে আসা নাজমা, লাবনী, সাবিনা, টেলিফোন এক্সচেঞ্জের শ্যাওলাযুক্ত পুকুর থেকে পানি আনা শেফালী, কাকলী, উপজেলা পরিষদের পুকুর থেকে পানি আনা রোজিনা, আমেনারা প্রত্যেকেই নিরুপায় হয়ে শ্যাওলাভর্তি, দুর্গন্ধযুক্ত পুকুরের পানি পান করতে বাধ্য হচ্ছেন। এবং পড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে।

এছাড়াও পরীক্ষা করে দেখা গেছে, পৌরসভায় গভীর নলকূপ বসানোর উপযুক্ত না হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে সুপেয় পানির চরম সংকটে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। 
পৌরসভার পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারায় অনেকেই পুকুরের শ্যাওলাভর্তি, দুর্গন্ধযুক্ত পানি পান করতে বাধ্য হয়। বর্তমানে পৌর সদরের শিববাটি মৌজায় আবাসিক এলাকা গড়ে ওঠায় 
সেখানে পানির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে কিন্তু পৌর শাখার নতুন করে লাইন দেওয়া বন্ধ থাকায় ওই এলাকায় তীব্র সংকটে জীবন পার করছে মানুষ। টিউবওয়েল পানিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে আয়রণ থাকায় টিউবওয়েলের পানি ব্যবহার করতে পারছেনা। ফলে পৌর শাখার পানি থেকে বঞ্চিত ওই এলাকার মানুষ।

পানির সংকট নিরসনে প্রাথমিক পর্যায়ে ১৯১৪ সাল থেকে পৌর পানি শাখার মাধ্যমে ৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৬টি ওয়ার্ডে পানি সরবরাহ শুরু করেন পৌর কর্তৃপক্ষ। 
ওই বছরই সরল পুকুর পাড়ে তিনটি পাম্প হাউজের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করে ট্রিটমেন্ট করে সরবরাহ করেন। তখন গ্রাহক সংখ্যা ছিল মাত্র ২৫০টি। বর্তমানে হাউজের সংখ্যা ৫ হাজারের উর্ধ্বে। এত বিপুল চাহিদা পূরণ করতে পৌর কর্তৃপক্ষ হিমশিম খাচ্ছে।

পৌর শাখার পানির মান সহ বিবিধ প্রশ্ন উঠালে পৌর পানি সরবরাহ শাখা বিলক্লার্ক মো. শাহিনুর হোসেন এ প্রতিনিধিকে জানান, পানির গুণাগুণ ভালো আছে কিনা তার জন্য প্রতি ৬ মাস পর পর কুয়েট খুলনা হতে পানি টেস্ট করা হয়। 
গ্রাহকের নিকট ভালো পানি দেওয়ার জন্য ২০১৮ সালে পৌরসভার পার্শ্ববর্তি ইউনিয়ন গদাইপুরের মানিকতলা নামক স্থানে একটা বোরিং করে সেখান থেকে পানি সরবরাহ করে আসছে। 
কিন্তু দিন দিন গ্রাহকের সংখ্যা বাড়ায় একটা পাম্প হাউজ দিয়ে পানি সরবরাহ করা কঠিন হয়ে পড়ে। একটি পাম্প যদি নষ্ট হয় তখন সেটি মেরাতম করতে সময় লাগে মিনিমাম ৫/৭ দিন। 
যার কারণে পৌরসভা গদাইপুর মোড়ে একটি জমি ক্রয় করে। পুকুর থাকায় সেটা ভরাট করে সেখানে একটি পাকা পাম্প হাউজের জন্য ঘর নির্মাণ করা হয়েছে পৌরসভার অর্থায়নে। 
বিদ্যুৎ এর ফোর ফোরটি লাইন না থাকায় বিদ্যুৎ অফিস প্রায় লক্ষাধিক টাকা জমা দিয়ে দুইটি কারেন্টের পোল ক্রয় করে নির্মাণ করা হয়। সেখানে নিজস্ব তিনটি ট্রান্সমিটার ক্রয় করে বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। 
কারেন্টের সংযোগও নেওয়া শেষ। মানিকতলা হতে গদাইপুর জমি পযর্ন্ত " ই ক্লাস পাইপ বসানোর কাজ ও শেষ করা হয়েছে ঠিকাদারের মাধ্যমে। জনগনের নিকট ভালো পানি দেওয়ার জন্য এখন বোরিং এর কাজটা শেষ হওয়া জরুরি। না হলে পৌরসভায় কোন ভাবে পানি সরবরাহ করা সম্ভব হবে না।
পৌরসভার ভিতরে এখন ৫০% লোকের বাড়িতে পানির লাইন আছে। গ্রাহকের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও পানি দেওয়া সম্ভব হয় না। তাছাড়া ১ বছরের বেশি সময় নতুন পানির লাইনের সংযোগ দেওয়া বন্ধ আছে। 

এদিকে অস্বাস্থ্যকর, দুর্গন্ধযুক্ত পুকুর থেকে খাবার পানি সংগ্রহকারী পরিবারের প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মাহবুবর রহমান বলেন, এভাবে চলতে থাকলে হেপাটাইটিস এ, কলেরা, টাইফয়েড, আমাশা, ডায়রিয়া, এলার্জি সহ পানিবাহিত রোগের সংক্রমণ বৃদ্ধি পাবে। যা এলাকাবাসী স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে পড়বে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের পাইকগাছার সহকারী প্রকৌশলী প্রশান্ত পাল জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক প্রভাবে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার নদীতে পলি জমা হয়ে নাব্য কমে যাওয়ার কারণে পানি প্রবাহের বাধা সৃষ্টি করে। 
ফলে মিঠা পানির সংকট দেখা দেয়। এছাড়াও এই এলাকায় মিষ্টি পানির লেয়ার পাওয়া যায় না। সে কারণে মিষ্টি পানির সংকট দেখা দেয়। 
তবে এটা থেকে কিছু পরিত্রাণ পেতে যেটা করা যায় সেটা বেশি বেশি করে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করতে হবে। পুকুর খনন করে সেটা রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। 
আশপাশের পুকুর, জলাশয়, জলাভূমি, নদী, হ্রদ পরিষ্কার রাখতে হবে। প্রয়োজনে এসব জলাধার পরিষ্কার ও পরিছন্নতা কার্যক্রমে অংশ নিতে হবে তাহলে কিছু পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে।

বেসরকারি সংস্থা Development Organisation of the Rural Poor (DORP) তথ্য অনুসারে, উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে ৩টি ইউনিয়নে মোট ৫টি ফিল্টার বসিয়ে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। 
উপজেলার রাড়ুলী ইউনিয়নে-১টি কপিলমুনি-২টি এবং গড়ইখালী-২টি এর ভিতরে একটি কাজ চলমান রয়েছে। প্রতিটি পানির ফিল্টার থেকে দুই শতাধিক এর বেশি মানুষ পানি সংগ্রহ করতে পারে।

এ ব্যাপারে পৌর প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহেরা নাজনীন বলেন, আপনারা জানেন এ অঞ্চলটি লবণ পানি-অধ্যুষিত। চারিদিকে পানি। তবে বিশুদ্ধ খাবার উপযোগী পানি নাই।
পৌরসভার বর্তমান পানির গ্রাহকের সংখ্যা কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। চাহিদার তুলনায় পানি সরবরাহ অনেক কম থাকায় এ সংকট উত্তরণে গদাইপুরে পাম্প হাউজের কাজ চলমান। সকলের সহযোগিতায় খুব দ্রুত বাস্তবায়ন হলে পৌরসভা সহ আশেপাশের এলাকার মানুষের সুপেয় পানি আর সংকট থাকবে না।

দ্রুত বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট নিরসনে সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন উপজেলাবাসী।