কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী আশ্রয়, ভবিষ্যৎ ও চ্যালেঞ্জ বিষয়ক সংলাপ

প্রকাশ | ২০ জুন ২০২৫, ১৫:৪৫

ফারুক আহমদ, উখিয়া (কক্সবাজার) প্রতিনিধি
ছবি: যায়যায়দিন

বিশ্ব শরণার্থী দিবস ২০২৫ উপলক্ষে কক্সবাজারের সার্কিট হাউস রোডে অবস্থিত অরুণোদয় স্কুলের অডিটোরিয়ামে ‘বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার ভবিষ্যৎ ও চ্যালেঞ্জসমূহ’ শীর্ষক এক গুরুত্বপূর্ণ সংলাপ  অনুষ্ঠিত হয়েছে।

বৃহস্পতিবার  (১৯ জুন) সংলাপ টি আয়োজন করে কোস্ট ফাউন্ডেশন। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (যুগ্ম সচিব) মো. শামসুদ দৌজা, সম্মানিত অতিথি ছিলেন আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন কক্সবাজার এর ডিআইজি প্রলয় চিসিম, সম্মানিত অতিথি  ছিলেন কক্সবাজার প্রেস ক্লাবের সভাপতি মাহবুবুর রহমান, হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা জামায়াতে ইসলামী এর আমীর নূর আহমেদ আনোয়ারী, হেল্প কক্সবাজার এর নির্বাহী পরিচালক আবুল কাশেম, বিশিষ্ট গবেষক ও লেখক নুরুল ইসলাম, কক্সবাজার দায়রা ও জজ আদালতের আইনজীবী সাকি এ কাউসার, সাংবাদিক তৌহিদ বেলাল, উখিয়া প্রেসক্লাব এর সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহমেদ, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গবেষক মকবুল আহমেদ, নুরুল ইসলাম, উখিয়া অনলাইন প্রেসক্লাবের সভাপতি শফিক আজাদ, হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী, উপজেলার বিএনপি এর সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেন, এনজিও প্ল্যাটফর্ম এর এক্সেস কো- অর্ডিনেটর মারকো মিলজেভিক এবং বিভিন্ন এনজিও-এর প্রতিনিধিগণ। 

এছাড়াও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক, সুশীল সমাজ এবং স্থানীয় যুব প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। কোস্ট ফাউন্ডেশন-এর নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন এবং কোস্ট ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন সহকারী পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম।

মোঃ শামসুদ দৌজা বলেন, যে সকল রাষ্ট্রগুলো দাতা হিসেবে আমাদেরকে অর্থ সহায়তা দিয়ে থাকে সেই রাষ্ট্র এবং তার বন্ধু ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো বিশ্বের অন্যান্য মানবিক সংকটে সহায়তা প্রদান করছে, যার ফলে রোহিঙ্গা সংকটে তহবিল ঘাটতি দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে অস্থিরতা বিরাজ করায় এই মুহূর্তে প্রত্যাবাসন সম্ভব নয়, আমরা চাই মিয়ানমার পরিস্থিতি দ্রুতই স্থিতিশীল হবে এবং প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু হবে।   

প্রলয় চিসিম বলেন, যেহেতু রোহিঙ্গারা আমাদের পাশে অবস্থান করছে সুতরাং তাদের অবস্থাও আমাদের চিন্তা করতে হবে এবং সামাজিক সম্প্রীতি বজায় রেখে বসবাস করতে হবে। বাংলাদেশ সরকার ক্যাম্প এবং ক্যাম্প অধ্যুষিত এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে, কিন্তু শুধুমাত্র আমাদের পক্ষে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়, এতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে সকলের অংশগ্রহণ খুবই প্রয়োজন। তহবিল শংকটের কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে এবং কিছু প্রকল্প স্থগিত হয়ে আছে, আমরা এই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য বিভিন্ন সংস্থার সাথে কাজ করে চলেছি,আশা করি এই সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হবে না।

মারকো মিলজেভিক বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যাকে সুযোগে পরিণত করে আমাদের কে সমস্যা সমাধান করতে হবে। যেহেতু  এই সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার, বিভিন্ন এনজিও এবং জাতিসংঘ কাজ করছে, এর জন্য আমাদের উচিত একটু ধৈর্য ধরতে হবে এবং সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে মানবিক সহায়তা কার্যক্রম চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
মাহবুবুর রহমান বলেন, প্রতিদিন নতুন করে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে, আমাদের উচিত অন্যান্য রাষ্ট্রে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া, এতে করে রোহিঙ্গারা যেমন উপকৃত হবে সেই সাথে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

নুর আহমেদ আনোয়ারী বলেন, আমাদের উচিত ক্যাম্প ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত কর্মকর্তা এবং উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ এর মধ্যে প্রতিমাসে অন্তত একটি করে সমন্বয় সভা করা, যাতে করে সমস্যা সমূহ দ্রুত চিহ্নিত করা যায় এবং বাস্তবায়ন করা যায়।

নুরুল ইসলাম বলেন, পরবর্তী অবস্থা কি হবে তার জন্য অপেক্ষা না করে আমাদের উচিত এখনই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

মকবুল আহমেদ বলেন, সংকট মোকাবেলায় এখন যদি পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হয় তাহলে একটা সময় আমরাও উদ্বাস্তু হয়ে যেতে পারি, আমরা যেমন তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হব, তাদেরকেও স্থানীয়দের প্রতি সহানুভূতি ও মর্যাদা প্রদর্শন করতে হবে।

আবুল কাশেম বলেন, আমাদের উচিত প্রকল্পের গুরুত্ব অনুসারে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা অন্যথায় রোহিঙ্গা রেসপন্স বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়তে পারে। পাশাপাশি নতুন দাত রাষ্ট্র বা সংস্থা খুঁজে বের করার জন্য কাজ করতে হবে।

শাহাদাত হোসেন বলেন, তহবিল হ্রাস হচ্ছে ও রোহিঙ্গা শিবিরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়াসহ ইতিমধ্যে আমরা অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছি এবং আগামীতে কোন ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে সেই বিষয়েও ধারণা করতে পারছি, তাই এখন সময় হল একটি সুন্দর অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করা এবং এই অনুসারে কাজ করা। 

পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, এই সংকট শুধু বাংলাদেশের একার সমস্যা নয়, এটি একটি বৈশ্বিক মানবিক ব্যর্থতা। সমাধান আসবে কেবল তখনই, যখন আমরা সবাই আমাদের দায়িত্ব স্বীকার করব। রোহিঙ্গা সংকট এখন আর শুধু মানবিক নয়—এটি একটি অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা এবং কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ যে সহানুভূতির নজির স্থাপন করেছে, তা আজও আন্তর্জাতিক মহলের আরও বেশি কার্যকর ও টেকসই ভূমিকা দাবি করে।

উক্ত  সংলাপে আরো গুরুত্ব পায়, রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় তহবিল হ্রাসের প্রেক্ষিতে অগ্রাধিকারভিত্তিক বাজেট ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জরুরি। স্থানীয় কর্মীদের চাকরি রক্ষা ও জনগণের অসন্তোষ কমাতে দক্ষতা উন্নয়ন ও বিকল্প আয় উৎস তৈরি করতে হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ক্যাম্প সম্প্রসারণ না করে পুনর্বাসন ও জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কার্যকর করা প্রয়োজন। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার ও রোহিঙ্গা নেতাদের মধ্যে নিয়মিত সমন্বয় ও কমিউনিটি পুলিশিং চালু করা উচিত। প্রত্যাবাসন ইস্যুতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সক্রিয় কূটনীতি ও তথ্যভিত্তিক প্রচারণা বাড়ানো দরকার। ICJ-তে মামলাটি দ্রুত এগোতে আঞ্চলিক সমর্থন ও প্রমাণ উপস্থাপন গুরুত্বপূর্ণ। কক্সবাজারের অর্থনীতি রক্ষায় পর্যটন খাত ও অবকাঠামোকে প্রাধান্য দিতে হবে। ভাসানচরে অবস্থান নিয়ে রোহিঙ্গাদের উদ্বেগ দূর করতে পরিবেশ উন্নয়ন ও অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থা প্রয়োজন। গণমাধ্যমের ভূমিকা হওয়া উচিত সচেতনতা বৃদ্ধি ও ভুল তথ্য প্রতিরোধ। শেষত, রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগণের মধ্যে সম্প্রীতি গড়তে যৌথ কার্যক্রম ও সংলাপ গুরুত্বপূর্ণ।