মোংলায় গাড়ি খালাসের প্রস্তাব, উদ্বিগ্ন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা

প্রকাশ | ২৫ জুন ২০২৫, ১৩:২৬ | আপডেট: ২৫ জুন ২০২৫, ১৩:৩০

মনির ফয়সাল, চট্টগ্রাম
ছবি: যায়যায়দিন

স্বাধীনতার পর চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই শুরু হয়েছিল দেশে রিকন্ডিশনড গাড়ি আমদানির যাত্রা। কিন্তু এখন সেই গাড়ি রাখার আগ্রহ হারাচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। 
বছর কয়েক আগেও কোটি কোটি টাকার হাজার হাজার ইউনিট গাড়ি আমদানি হতো বন্দর দিয়ে। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর থেকে অন্তত ৮০ শতাংশ গাড়ি আমদানির পরিবর্তে মোংলা বন্দর ব্যবহারের সুপারিশ করে ইতোমধ্যে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এতে বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন চট্টগ্রামের গাড়ি আমদানিকারকরা।

ব্যবসায়ীরা জানায়, বন্দরের প্রস্তাবনা কার্যকর হলে বেশি ক্ষতির শিকার হবেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা। চট্টগ্রাম কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া পুরো সেক্টরটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। 
একসময় চট্টগ্রাম নগরীতে ১৫০টির বেশি গাড়ির শোরুম থাকলেও ব্যবসা কমে তা এখন ৫০-এর নিচে নেমে এসেছে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে গাড়ি খালাস কমে গেলে এ শিল্প ধ্বংসের মুখে পড়বে।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশের মোটরযান সেক্টর পুরোপুরি আমদানি নির্ভর। বছর কয়েক আগেও জাপান থেকে হাজার হাজার রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি করে দেশের মোটরযান সেক্টর সচল রাখা হতো। 
১৯৭৯ সাল থেকে দেশে প্রথম রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি শুরু হয়। প্রথমদিকে খুব বেশি গাড়ি আমদানি না হলেও পরবর্তী বছরগুলোতে হাজার হাজার গাড়ি আমদানি করা হয়। 
এক সময় চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে বছরে অন্তত ৩২ হাজার রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি করা হয়েছে। দেশের ঢাকা চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানের ছয়শ জনের মতো আমদানিকারক গাড়ি আমদানি করে থাকেন। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট এবং খুলনায় চার শতাধিক শো রুমের মাধ্যমে গাড়ি বিক্রি হয়। 
চট্টগ্রাম এবং মোংলা বন্দরের মাধ্যমে এসব গাড়ি আমদানি হচ্ছে। জাপান থেকে রো রো ভ্যাসেল এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে কন্টেনারে ভর্তি করে গাড়ি আমদানি করা হয়। 
এই খাতে ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ প্রায় বিশ হাজার কোটি টাকা। প্রতি বছর সরকারকে চার হাজার কোটিরও বেশি টাকা ট্যাক্স প্রদান করে এসব গাড়ি বন্দর থেকে ছাড় করানো হয়। 
এছাড়া ইনকাম ট্যাক্স এবং ভ্যাট মিলেও বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় করা হয় গাড়ি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে।

সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বছরে গড়ে ১১ হাজার গাড়ি আমদানি হয়। বর্তমানে আমদানি করা বিলাসী গাড়ি রাখার জন্য বন্দর অভ্যন্তরে একটি এবং বাইরে একটি শেড রয়েছে। শেড দুটির গাড়ি ধারণক্ষমতা এক হাজার ২৫০টি। গাড়ি খালাসে প্রতি মাসে কমবেশি ২৫০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করে কাস্টমস।

চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দরের দুই শেডে বর্তমানে আমদানি করা ৯৮৫টি রিকন্ডিশন্ড গাড়ি খালাসের অপেক্ষায় আছে। গত ১৬ জুন ৮২২টি রিকন্ডিশন্ড গাড়ি নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে মাদার ভ্যাসেল 'এমভি মালয়েশিয়ান স্টার'। জাহাজটি এর মধ্যে ৩৮২টি গাড়ি চট্টগ্রাম বন্দরে খালাস করে বন্দর ত্যাগ করেছে। অবশিষ্ট গাড়িগুলো মোংলা বন্দরে খালাসের কথা রয়েছে।

জানা যায়, মোংলা বন্দর দিয়ে গাড়ি আমদানি শুরু হয় ২০০৯ সালে। ২০০৯ সালের ৩ জুন প্রথম মোংলা বন্দরে ২৫৫টি গাড়ির চালানের মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু। এরপর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের তুলনায় মোংলা বন্দর দিয়ে বাড়তে থাকে গাড়ি আমদানি।

বারভিডা সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দরে গাড়ি খালাসের পর প্রথম চার দিন বিনামূল্যে রাখা গেলেও, পরবর্তী সাত দিনে প্রতিটি গাড়ির জন্য প্রতিদিন ভাড়া ৭৯৩ টাকা এবং চার্জ ৫০৩ টাকা দিতে হয় আমদানিকারকদের। ১৪ দিন পর থেকে প্রতিদিনের মাসুল দাঁড়ায় ৭০০ টাকা।
 
অন্যদিকে, মোংলা বন্দরে চার দিন বিনামূল্যে রাখার পর প্রথম সাত দিনের জন্য প্রতিদিনের শুল্ক ৪০০ টাকা এবং দ্বিতীয় সাত দিনের জন্য ৭৬৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। 
এরপর প্রতিদিনের শুল্ক নির্ধারিত ১২৯ টাকা। তুলনামূলকভাবে মোংলা বন্দরের শুল্ক হার কম হলেও সেখানে পণ্য খালাস ও পরিবহনে নানা জটিলতায় আপত্তি তুলছেন ব্যবসায়ীরা।

বারবিডার সহ-সভাপতি গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে যদি গাড়ি না এনে মোংলা বন্দর দিয়ে যদি নিয়ে আসি তাহলে আমাদের কস্টিং চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা কস্টিং বেশি পড়বে ঢাকার ব্যবসায়ীদের তুলনায় ।

নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক স্বাক্ষরিত প্রস্তাবনার চিঠিতে বলা হয়, চট্টগ্রাম বন্দরে গাড়ি রাখার শেডগুলো মাল্টিস্টোরেড না হওয়ায় গাড়ির সংখ্যার অনুপাতে অধিক স্থান দখল করে, যার তুলনায় রাজস্ব আয়ও কম হয়। 
পাশাপাশি প্রতি বছর কিছু কিছু গাড়ি কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমদানিকারকদের আইনি জটিলতার কারণে খালাস না হওয়ায় বন্দরের জায়গা দখল করে পড়ে থাকে। 
এতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ আদায়যোগ্য রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়। তিন-চারটি কন্টেইনার একটির ওপর আরেকটি রাখা যায়। এতে সমপরিমাণ জায়গায় গাড়ির তুলনায় অধিক কন্টেইনার রাখা যায়। 
এতে তুলনামূলকভাবে বন্দরের রাজস্ব আয়ও বাড়বে। পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি কনটেইনার সংখ্যা প্রতি বছর দ্রুত বাড়ছে। সে তুলনায় কনটেইনার সংরক্ষণের স্থান সংকুচিত হয়ে পড়ছে বলে প্রস্তাবনার চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে গাড়ি না এনে যদি সেগুলো মোংলা বন্দরের মাধ্যমে আনে তাহলে মোংলা বন্দরের স্পেসটাও ব্যবহার হলো এবং চট্টগ্রাম বন্দরের ভেতরে যে অপারেশনাল কার্যক্রম সেটাও আমরা আরও ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারলাম।