লোভে পড়ে দিলেন সমিতিতে টাকা; এখন কেউ শোকে মৃত, কেউ ঘুরছেন দ্বারে দ্বারে

প্রকাশ | ২৬ জুন ২০২৫, ১৬:৪৪

দুর্গাপুর (নেত্রকোণা) প্রতিনিধি
ছবি : যায়যায়দিন

"বেশি মুনাফা পাবেন" এই আশায় জীবনের সঞ্চয় তুলে দিয়েছিলেন অনেকেই। কেউ গার্মেন্টসে ঘাম ঝরানোর আয়, কেউ ব্যবসার, কেউবা শেষ বয়সের ভরসা, কিন্তু সেই মুনাফার মুখ আর কেউ দেখেননি বেশিদিন। উল্টো আসল টাকায় মিলছে না এখন।  এই শোকে কেউ প্রাণ হারিয়েছেন, কেউ দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন টাকা ফেরত পেতে, আর কেউ আশ্রয় নিয়েছেন আদালতের।

নেত্রকোণার দুর্গাপুর উপজেলার গাঁওকান্দিয়া ইউনিয়নের জাগিরপাড়া এলাকায় একসময়ের আলোচিত ‘প্যাসিফিক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেড’ কে ঘিরেই ঘটেছে এই চাঞ্চল্যকর প্রতারণার কাহিনি। ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সমিতি নানান কৌশলে মানুষের আস্থা অর্জন করে। প্রতি লাখ টাকায় মাসে চার হাজার টাকা লাভ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গ্রামগঞ্জের বহু মানুষের সঞ্চিত অর্থ জমা নেয় তারা।

এই যেমন ঢাকায় ১৫ বছর গার্মেন্টসে কাজ করে উপার্জিত সব টাকা এই সমিতিতে জমা রেখেছিলেন রেহেনা খাতুন। ২০২১ সালে সাড়ে চার লাখ টাকা দিয়েছিলেন প্রতি লাখে মাসে ৪ হাজার লাভের আশায়। শুরুতে দু’মাস লাভের টাকা পেলেও এরপর বন্ধ হয়ে যায়। টাকার শোকে হয়েছেন অসুস্থ। চার বছর ধরে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।  

রেহেনা খাতুন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, "আমি জানতাম না ওরা এমন প্রতারণা করতে পারে। পাড়ার প্রতিবেশী চাচা জলিলকে আপন ভেবে বিশ্বাস করে টাকা দিয়েছিলাম। সে আমাকে লোভ দেখিয়েছিল, বলেছিল মাসে মাসে লাভ দেবো। শুরুতে দুই মাস দিয়েছেও। তারপর হঠাৎ বন্ধ করে দেয় সবকিছু। তখন থেকেই আমি চার বছর ধরে ঘুরছি, তাদের হাতে পায়ে ধরছি, কিন্তু তাও টাকাটা ফেরত দিচ্ছে না। এত চিন্তায় আমি অসুস্থ হয়ে গেছি, চারবার ব্রেন স্ট্রোক হয়েছে আমার। আমি এখন শুধু চাই, আমার টাকা উদ্ধার হোক। ন্যায্যটা যেন আমি পাই।"

স্থানীয় বাজারের দোকানি তাইজুল ইসলামও পড়েছেন একই ফাঁদে। তিনি জানান, লোভে পড়ে ২০ লাখ টাকা জমা রেখেছিলেন। এখন টাকা ফেরত না পেয়ে দিশেহারা হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন আদালতের দ্বারে। যে টাকা দিয়েছিলেন ঋণ করে সেই ঋণ মেটাতে করেছেন জমি বিক্রি এখন। আদালতে মামলা করে আল্লাহ'র উপর ভরসা করে আছেন তিনি।

আরেক ভুক্তভোগী আমিনুল ইসলাম বলেন, আমি ১২ লাখ দিয়েছি, আমারে পাঁচ মাস লাভ দিছে পরে বন্ধ করে দিছে আমি আসল টাকা চাইলে দিব দিব বলে আর দেয়নি, পরে আমি টাকা ফেরত পেতে আশ্রয় নিয়েছি আদালতের। আমার মতো এমন বহু মানুষ এখন নিঃস্ব এই প্রতারণার খপ্পরে পড়ে টাকা হারিয়েছে।

এই প্রতারণা কেবল আর্থিক ক্ষতিই আনেনি, কেড়ে নিয়েছে মানুষের জীবনও। গাঁওকান্দিয়া গ্রামের অধিবেষ সরকার নামে এক ব্যক্তি এই সমিতিতে জমা রেখেছিলেন ১৯ লাখ টাকা। প্রতারণার শিকারে মানসিক কষ্টে অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসার অভাবে আগে মারা যান তার স্ত্রী। পরে চলতি মাসের ৬ তারিখে মারা যান তিনিও।

মৃতের ছেলে আশিস সরকার বলেন, “আমার বাবার শেষ সম্বল ছিল সেই টাকা। তিনি ভেবেছিলেন, সমিতিতে দিলে কিছু আসবে এটাই ছিল আশা। কিন্তু টাকা দেওয়ার পরই মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে আমরা সমিতির কাছে আসল টাকা ফেরত চাই, চিকিৎসার জন্য খুব অনুরোধ করি। কিন্তু তারা একটিবারের জন্যও আমাদের আর্তি শোনেনি। পরে তো মা মারা গেল, বাধ্য হয়ে আমরা আদালতে মামলা করি।

আরও বলেন, টাকাগুলো বাবার জীবনের শেষ সঞ্চয় ছিল। সেই টাকা হারিয়ে বাবা সবসময় দুচিন্তায় থাকতেন। এই চিন্তা থেকেই ধীরে ধীরে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। একবার স্ট্রোক করে হাসপাতালে চিকিৎসা নেন, কিছুটা সুস্থও হন। কিন্তু পরে আবারও স্ট্রোক করে আমাদের ছেড়ে চলে যান। এখন আমরা মা-বাবা দুজনকেই হারিয়েছি। আমরা শুধু নই, এমন ভুক্তভোগী আরও অনেক আছে। সবাই প্রতারণার শিকার হয়ে আজ নিঃস্ব।”

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, প্যাসিফিক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতিটি জাগিরপাড়ায় একটি ঘরে ২০১৯ সালে চালু হয়। কিন্তু এখন সেখানে সেই অফিস নেই, নেই কোনো কার্যক্রম। আছে কেবল প্রতারণার শিকার মানুষের হাহাকার। এই সমিতি পরিচালনায় ছিলেন ওই এলাকার আব্দুল জলিল (সভাপতি), আব্দুল জলিল আকাশ (সহ-সভাপতি), আব্দুর রশিদ (সাধারণ সম্পাদক),আবুল কাশেম (যুগ্ম সম্পাদক), ইদ্রিস আলী (কোষাধক্ষ্য), মাহফুজুল ইসলাম (বোর্ড সদস্য)।

বিষয়টি নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও খোঁজ পাওয়া যায়নি ওই সমিতি বোর্ডের সভাপতি আব্দুল জলিলের দেখা। তার ব্যবহারিত দুইটি মোবাইল ফোনেও একাধিকবার কল দিলে বন্ধ পাওয়া যায়। 

উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা বিজন কান্তি ধর বলেন, সমিতিটি আমাদের কার্যালয় থেকে রেজিস্ট্রেশন নিয়েছে ঠিকই, তবে পরবর্তীতে আমাদের সাথে কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করেনি। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহের বিষয়ে এখনো পর্যন্ত কোনো লিখিত অভিযোগ আমরা পাইনি। অভিযোগ পেলে অবশ্যই তদন্ত করে দেখবো।"

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. নাভিদ রেজওয়ানুল কবীর বলেন, ঘটনাটি জানা ছিলো না আজকেই শুনলাম। বিষয়টি খোঁজ নেবো।

লোভে পড়ে মানুষ জীবনের সঞ্চয় তুলে দিয়েছিল একটি প্রতিষ্ঠানে, আজ সেই লোভই তাদের সর্বনাশ ডেকে এনেছে। এখন প্রয়োজন দ্রুত প্রশাসনিক পদক্ষেপ ও আইনি সহায়তা যাতে প্রতারিত মানুষরা অন্তত কিছুটা স্বস্তি ফিরে পান, আর ভবিষ্যতে কেউ যেন এমন ফাঁদে পা না দেন।