শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল বাশার মিরাজ
  ২৫ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০
অবসর নামক শব্দটি যেন ড. জাকারিয়ার ডিকশনারিতে নেই। নানা প্রযুক্তি ও পরামর্শ নিয়ে তিনি সব সময় রয়েছেন কৃষকের পাশে - যাযাদি

ভালো বীজ আর কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারে পাল্টে যাচ্ছে কৃষকের জীবন। কৃষি প্রযুক্তি বিস্তারে তেমনি কাজ করে যাচ্ছেন সদ্য অবসরে যাওয়া পলস্নী উন্নয়ন একাডেমির (আরডিএ) পরিচালক কৃষি বিজ্ঞানী ড. এ কে এম জাকারিয়া। অবসরে গিয়েও তিনি তার গবেষণা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। অবসর নামক শব্দটি যেন ড. জাকারিয়ার ডিকশেনারিতে নেই।

নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে গিয়ে ড. এ কে এম জাকারিয়া জানালেন, ২০০২ সালে গবেষণা কাজে বগুড়া জেলার শাজাহানপুর উপজেলায় যাই। আমি যে গ্রামে গিয়েছিলাম তার নাম মারিয়া। দেখলাম ফসলি জমিগুলো আলগা (ফাঁকা) পড়ে আছে। মাঠের আইল (সীমানা প্রাচীর) দিয়ে হাঁটার সময় দেখা হয় কয়েকজন কৃষক ও নারীর সঙ্গে। এদের একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম। কি ব্যাপার! ফসলের এ অবস্থা কেন? ওরা তখন আমাকে বলল, 'ভালো বীজ নাই, কি নাগামো (লাগাবো)। টেকা নাই- বাজার থেকে বীজও কিনবার পারি না। ফসল তো ইনকায় (এরকমি) হবি (হবে)।' একথাটি শুনে তখন আমি আর তাকে কোনো জবাব দিতে পারিনি। বুঝতে পারলাম এরা গরিব কৃষক। বাজার থেকে উচ্চমূল্যের বীজ কিনে এদের পক্ষে ফসল ফলানো একেবারেই সম্ভব নয়। তা ছাড়া বাজারে ভালো বীজ সবসময় পাওয়াও যায় না। তারপর আবার উৎপাদিত ফসলের অনেক কম দাম। লাভ তো দূরের কথা, বলতে গেলে উৎপাদন খরচও উঠাতে পারে না অনেক কৃষক।

মারিয়া গ্রাম থেকে ফিরে আমার কর্মস্থল আরডিএতে এসে ভাবতে থাকি। কীভাবে এসব কৃষকদের সাহায্য করা যায়। এভাবে জমি ফেলে রাখলে কিংবা ফসল খারাপ হলে তো দেশের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। কিছুদিন পর আবার গেলাম ওই গ্রামে। ওদের সমস্যাগুলো আগ্রহ সহকারে শুনলাম। যা বুঝলাম ভালো বীজ না থাকার কারণেই মূলত তারা ফসল ফলাতে পারছেন না। এ কারণে দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে এদের জীবন। এরপর লেগে গেলাম কাজে। এই কৃষকদের বীজের সমস্যা কাটিয়ে উঠতে কি করা যায়, তা নিয়ে খুব করে ভাবতে লাগলাম। আবার আগে থেকেই ধরে নিয়েছিলাম, পুরুষ কৃষকরা যেহেতু বাড়ির বাহিরে ব্যস্ত থাকে এদের নয়, বরং নারীদের কাজে লাগাতে হবে। এরপর বীজ নিয়ে গবেষণা শুরু করলাম আরডিএর গবেষণাগারে। তবে যাই করি দেশীয় প্রযুক্তিতে করতে হবে সেটিও মাথায় রাখলাম। আবার ভাবলাম কেবল গবেষণা করলেই হবে না, বীজ প্রযুক্তি যদি ওইসব গরিব কৃষক ভাইদের কাছে সহজে পৌঁছে না দিতে পারি, তাহলেও আমার গবেষণা বৃথা যাবে।

বছর দুয়েক পরে একটি পূর্ণাঙ্গ মডেল দাঁড় করলাম। আমি চেষ্টার করেছি ওদের কোনো গ্রামীণ উদ্ভাবন কাজে লাগিয়ে প্রযুক্তি তৈরি করব। এতে সেটি গ্রহণ করা তাদের জন্য সহজ হবে। আমি তাই করেছি। আমি কেবল সায়েন্টিফিক বিষয়টি এটিতে যুক্ত করেছি। কীভাবে ভালো বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে প্রতিটি পরিবার যেন পরিণত হতে পারে একটি 'বীজ ব্যাংকে', এটিই ছিল আমার গবেষণার প্রধান লক্ষ্য। মারিয়া গ্রামের জন্য তো বটেই আমার নিজের জন্যও সুখবর বলা যায়, কারণ সে সময় এ গবেষণায় সহযোগিতা করতে এগিয়ে এলো আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনিস্টিটিউট (ইরি) এবং পরবর্তী সময়ে আসে আইএফসি ও ড্যানিডা। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকেও সহযোগিতা পেলাম। তখন আবার চলে গেলাম মারিয়া গ্রামে। যেহেতু এ গ্রামের লোকরা প্রযুক্তিটি উদ্ভাবন ও বিস্তারে শুরু থেকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছেন, তাই তাদের সম্মানে এ প্রযুক্তিটির নাম দিলাম 'মারিয়া বীজ প্রযুক্তি' মডেল।

ড. জাকারিয়া জানান, বহির্বিশ্বেও এখন মারিয়া মডেল প্রযুক্তিটি ছড়িয়ে পড়েছে। প্রযুক্তিটি দেখতে দেশ-বিদেশের কয়েক হাজার উচ্চপর্যায়ের লোকজন ও প্রশিক্ষার্থীরাও এ গ্রামে এসে হাতে কলমে কিভাবে বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা যায় তা গ্রামের নারীদের কাছ থেকে শিখে যান। এমনকি আরডিএতে যত ধরনের প্রশিক্ষণ পরিচালিত হয়, তাতেও প্রযুক্তিটি শেখানোর ব্যবস্থা থাকে। এ জন্য আমি আরডিএর মহাপরিচালক থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ দিতে চাই। গতবছর (২০১৮) সার্কভুক্ত ৮টি দেশের ৪৫ জন প্রতিনিধি প্রশিক্ষণ নিতে এখানে এসেছিলেন। এর আগে কম্বোডিয়া থেকেও ৩০ জনের একটি দলকে এ প্রযুক্তি সম্পর্কে জানাতে প্রশিক্ষণ দিয়েছি আমরা। এশিয়ান ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের ওয়েবসাইটে 'মারিয়া বীজ প্রযুক্তি' মডেলকে সফল ফার্মারস বীজ ব্যাংক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

বলতে গেলে প্রযুক্তিটির বিস্তারে আমাদের এখন কিছুই করতে হয় না। বর্তমানে এ গ্রামের প্রতিটি পরিবারই এক একটি বীজ ব্যাংকে পরিণত হয়েছে। তারাই দেশি-বিদেশিদের প্রশিক্ষণ দিতে সক্ষমতা অর্জন করেছে। এটি শুনে আমার কাছে খুবই ভালো লাগে যে, এ গ্রামের নারীরা প্রত্যেকেই নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে ভালো বীজ বিক্রি করে অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন করে সাবলম্বী হয়েছেন। এমনকি এ বীজ অঙ্কুরোদগম থেকে শুরু করে উৎপাদন ও গুণগতমান সরকার ঘোষিত বীজমানকেও স্পর্শ করতে সক্ষমতা অর্জন করেছে।

ড. জাকারিয়া বলেন, মানসম্মত বীজ কৃষি উন্নয়নের অন্যতম প্রধান পূর্বশর্ত। আমার নিজের ও বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, শুধুমাত্র মানসম্মত বীজ এককভাবে ২০ ভাগ পর্যন্ত ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারে। অথচ দেশে মানসম্মত বীজের ঘাটতি প্রায় ৭৪ ভাগ। এটি কেবল আমাদের দেশের সমস্যাই নয়। বিশ্বের অনেক দেশেরই বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া ও পশ্চিম আফ্রিকার দেশসমূহের এটি অন্যতম একটি সমস্যা। আমাদের দেশের এ ঘাটতি পূরণ হয় কৃষক পরিবারের নারী সদস্যদের সংরক্ষিত বীজ দিয়ে। যার মান বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দুর্বল। যদি এটি গুণগতসম্পন্ন বীজ দিয়ে করা যায়, তবে বাংলাদেশে কৃষিজ উৎপাদন আরো কয়েকগুণ বেড়ে যাবে এবং আগামী বহু বছর দেশের জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকবে। বর্তমানে এই মডেলটি বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশ যেমন পশ্চিম আফ্রিকার ৮টি দেশে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এ ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও নেপালে প্রযুক্তিটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

মারিয়া বীজ প্রযুক্তি কিভাবে করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ প্রযুক্তিটির ক্ষেত্রে নারীরা প্রথমে হাতবাছাই পদ্ধতিতে চোখে দেখে বীজ আলাদা করে মাচার (মাটি থেকে উঁচুতে) উপর রোদে শুকান। তারপর তারা সেগুলো সংরক্ষণ করেন। সংরক্ষণ করা বীজপাত্রে তারা মোমবাতি জ্বালিয়ে অক্সিজেন দূরীভূত করেন। এ ছাড়াও তারা ছাই অথবা মুড়ি দিয়ে পাত্রটির মুখভর্তি করে পলিথিন দিয়ে আটকে দেন। যাতে করে বাহির থেকে বাতাস ভিতরে প্রবেশ করে বীজকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে। বীজবপনের আগে তারা আবার লবণ পানি অথবা ইউরিয়ার পানির মধ্যে চুবান। এ সময় অপরিপুষ্ট/চিটা বীজ আলাদা হয়ে যায়। বীজ শোধনের ক্ষেত্রেও তারা প্রাকৃতিক পদ্ধতি ব্যবহার করেন। আর এ জন্য তারা ২৫টি জামপাতা দুই লিটার পানিতে দিয়ে ১ কেজি বীজ ২ ঘণ্টা ডুবিয়ে রাখুন। এতে করে বীজে থাকা ফাঙ্গাসসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর অণুজীবগুলো নষ্ট হয়ে যায়। জামপাতার রসে ডুবানো বীজ পুনরায় না ধুয়েই তারা জমিতে বীজগুলো বপন করে থাকেন।

ড. জাকারিয়ার আরেকটি কাজের সুফল বহুপূর্বে সারাদেশে পরিচিতি লাভ করেছে। সেটি হলো দেশের মাটিতে প্রথমবারের মতো হাইব্রিড ভুট্টা বীজ উৎপাদনের টেকনিক্যাল প্রটোকল উদ্ভাবনের মাধ্যমে ভুট্টা চাষ সম্প্রসারণ। এ বিষয়ে তিনি জানান, নব্বইয়ের দশকে (১৯৯৭ সাল) এটির কাজ আমি শুরু করি। এর ফলে প্রতি কেজি আমদানিকৃত ভুট্টা বীজ ৮ শত টাকার স্থলে মাত্র দেড়শ টাকায় নেমে আসে। এ কারণেই দেশে ভুট্টা চাষ ও পোল্ট্রি শিল্প দ্রম্নত বিকাশ লাভ করে। আর এ কাজটি পলস্নী উন্নয়ন একাডেমিকে স্বাধীনতা পদক-২০০৪ এনে দিতে সহায়তা করে। খুশির কথা, এখনও আমার উদ্ভাবিত সেই সিড প্রটোকল ব্যবহার করেই দেশে ভুট্টার হাইব্রিড বীজ উৎপাদন করা হচ্ছে।

কৃষিবিজ্ঞানী ড. জাকারিয়ার আরেকটি অন্যতম কাজ হলো চর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (সিডিআরসি) প্রতিষ্ঠা করা। এ বিষয়ে তিনি বলেন, চরাঞ্চলের কৃষির অন্যতম প্রতিবন্ধকতা ছিল কৃষিপণ্যের যথাযথ বিপণন ব্যবস্থা না থাকা। এখানকার কৃষকরা অনেক কষ্ট করেই কৃষিপণ্য উৎপাদন করেন। কিন্তু একশ্রেণির মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্যে তারা ফসল উৎপাদন করেও সুবিধা করতে পারতেন না। আবার চরে কোন কোন ফসল ফলানো যেতে পারে তা নিয়েও চরাঞ্চলের মানুষের তেমন জ্ঞান ছিল না। এটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিভিন্নভাবে আমরা তাদের পাশে থেকে চরের কৃষি জমিতে উৎপাদন বাড়াতে সক্ষম হয়েছি। প্রকৃতপক্ষে সিডিআরসি একটি সরকার অনুমোদিত উন্মুক্ত পস্নাটফর্ম। যেখানে যে কেউ চর নিয়ে গবেষণা, প্রশিক্ষণ করতে চাইলে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হয়ে থাকে।

মারিয়া বীজ প্রযুক্তি, ভুট্টা বীজের প্রটোকল উদ্ভাবন কিংবা সিডিআরসি প্রতিষ্ঠাতা ছাড়াও অসংখ্য গবেষণা রয়েছে ড. জাকারিয়ার। দেশে কম সেচে ফসল ফলানোর যে প্রযুক্তি সেটিও তার হাতে তৈরি। জৈব বালাইনাশক তৈরিতে তিনি টাইকোড্রার্মা ছত্রাক নিয়েও কাজ করেছেন। এ ছাড়াও তিনি পলস্নী গ্রামে ঘুরে ঘুরে কোন ফসলের কি চিকিৎসা তা দিয়ে বেড়ান। তার উদ্যোগেই বগুড়ার শাহজাহানপুরে পরীক্ষামূলকভাবে বেশ কয়েকটি গ্রামে 'পলস্নী ফসল ক্লিনিক' তৈরি করা হয়েছিল। এ কারণে তিনি কৃষকদের কাছে 'ফসলের ডাক্তার' নামেই বেশি পরিচিত। ফসলের রোগবালাইয়ের সেবাপ্রাপ্তি আরো সহজ করতে বর্তমানে এগুলোকে ডিজিটাল রূপ দেয়া হচ্ছে। এই উদ্যোগটি কেন নিয়েছিলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, মানুষের জন্য রয়েছে হাসপাতাল-ক্লিনিক, পশু-পাখির জন্যও রয়েছে হাসপাতাল। কিন্তু উদ্ভিদের বিশাল সামাজ্ঞ্যের জন্য নেই কোনো চিকিৎসা কেন্দ্র। এটি না থাকার কারণে এ দেশের কৃষকদের মাঝে ওভাবে সচেতনতা আসেনি। এর থেকে বের করে আনার জন্যই দেশে প্রথমবারের মতো এমন ক্লিনিক স্থাপনের কাজটি হাতে নিয়েছিলাম। এর সাফল্য সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বর্তমানে মোবাইলভিত্তিক ডিজিটাল ব্যবস্থায় এটি রূপান্তরিত হওয়ায় হাজার হাজার কৃষক এমনকি দুর্গম চরাঞ্চলের কৃষকরাও এখান থেকে সেবা পাচ্ছেন। আবার এ কাজটি আরো সহজ করা যায়- সেজন্য 'ফসলের প্রেসক্রিপশন' নামক বই বের করেছি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<63769 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1