বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

জাপানে ২০ থেকে ৪৪ বছর বয়সি পুরুষরা বেশি আত্মহত্যা করেন

নিপ্পন ফাউন্ডেশনের গবেষণা
যাযাদি ডেস্ক
  ০৬ মে ২০২৩, ১০:২৪
ফাইল ছবি

জীবন মান উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে জাপানে। মারাত্মক এই সামাজিক ব্যাধি এশিয়ার এই দেশটিতে এতটাই ছড়িয়ে পড়েছে, যে কোনো সমস্যা, চিন্তা-দুশ্চিন্তার কারণে অনেক মানুষই আত্মহত্যা বা ‘নিজেকে শেষ করে’ দেওয়ার চিন্তা করেন। গবেষণা অনুযায়ী, জাপানের ৪৫ শতাংশ তরুণ-তরুণী অর্থাৎ প্রতি দুজন তরুণ-তরুণীর মধ্যে একজন আত্মহত্যা করার কথা ভাবেন। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনে ভয়াবহ এই তথ্য তুলে ধরেছে টোকিওভিত্তিক নিপ্পন ফাউন্ডেশন।

জাপানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯, ২০২০ এবং ২০২১ সালে দেশটিতে যত তরুণ-তরুণীর মৃত্যু হয়েছে, তাদের বেশিরভাগই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে।

নিপ্পন ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, তারা ১৪ হাজার ৫৫৫ জনের ওপর জরিপ চালিয়েছে। যাদের বয়স ১৮ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে। তাদের মধ্যে ৪৪ দশমিক ৮ শতাংশ প্রেমের সম্পর্ক, যৌন হয়রানি, বুলিং, উচ্চশিক্ষা এবং ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশায় আত্মাহত্যার কথা ভেবেছেন। এই ৪৪ দশমিক ৮ শতাংশের মধ্যে ৪০ শতাংশ ‘আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়েছেন অথবা নিজেদের নিঃশেষ করে দেওয়ার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছেন।’

এছাড়া বিশ্বের অন্যতম উন্নত এই দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে সন্তান নেওয়ার ইচ্ছাও অনেক কমে গেছে। ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে দেশটিতে জনসংখ্যা ৫ লাখ ৫৬ হাজার কমে গেছে।

এর আগের এক গবেষণা অনুযায়ী, জাপানের শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, গত তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শিশু আত্মহত্যা করেছে গত বছরে। এছাড়া ২০১৬-১৭ অর্থবছরের মার্চ মাস পর্যন্ত প্রাথমিক থেকে হাইস্কুলের ২৫০ জন শিশু আত্মহত্যা করেছে বলে জানা গেছে। ১৯৮৬ সালের পর থেকে জাপানে এত বিপুল সংখ্যক শিশু আত্মহত্যার ঘটনা আর ঘটেনি।

তথ্য অনুযায়ী, আত্মহত্যার আগে ঐসব শিশুরা যেসব সমস্যার কথা জানিয়েছিল তার মধ্যে রয়েছে পারিবারিক সমস্যা, ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা এবং বন্ধুদের কাছ থেকে অবজ্ঞা বা তাচ্ছিল্যপূর্ণ ব্যবহার।

তবে স্কুলগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে এসব ঘটনার ১৪০টিরই সঠিক কারণ তারা জানে না, কারণ সেসব ক্ষেত্রে শিশুরা আত্মহত্যার আগে কোনো নোট রেখে যায়নি। ওই সময়ে আত্মহত্যা করা অধিকাংশ শিশুই হাই স্কুলের শিক্ষার্থী ছিল। ১৮ বছরের কম বয়সি জাপানি শিক্ষার্থীরা সাধারণত এসব স্কুলে লেখাপড়া করে।

তথ্য মতে, ২০১৫ সালে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা প্রবণ দেশগুলোর একটি ছিল জাপান। তবে এ প্রবণতা বন্ধ করতে জাপান সরকার বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার পর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয় বলে উঠে আসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, ২০০৩ সালে জাপানে মোট আত্মহত্যার ঘটনা ছিল ৩৪ হাজার ৫০০টি, যা ২০১৫ সালে কমে ২১ হাজারে নেমে আসে ২০১৭ সালে।

২০১৪ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী জাপানে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৭০ জন মানুষ আত্মহত্যা করে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে দক্ষিণ কোরিয়া বাদে অন্য কোনো দেশে আত্মহত্যার হার এত ব্যাপক নয়।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আর্থ-সামাজিক এবং ঐতিহাসিক কারণেও জাপানিদের আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক বেশি।

এ ব্যাপারে টোকিও’র টেম্পল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী ওয়াতুরু নিশিদা বলেন, ‘বিষণ্নতা এবং আত্মহত্যার অন্যতম প্রধান কারণ বিচ্ছিন্নতা বা একা থাকার প্রবণতা। জাপানে একসময় বৃদ্ধ অভিভাবকদের দেখাশোনা করত তাদের সন্তানরা, তবে বর্তমানে সে রকমটা হয় না বললেই চলে। বৃদ্ধাশ্রম বা হাসপাতালে একাকী মৃত্যুবরণের ঘটনা দিন দিন বাড়ছেই।’

জাপানে প্রচলিত ‘সম্মানজনক আত্মহত্যা’র ঐতিহ্যকে সাম্প্রতিক সময়ে আত্মহত্যার প্রবণতার বৃদ্ধির মূল কারণ হিসেবে দায়ী করেন বিশ্লেষকরা। জাপানের সামুরাই যোদ্ধাদের আত্মহত্যা, যাকে ‘সেপ্পুকু’ বলা হতো অথবা ১৯৪৫ সালে তরুণ ‘কামিকাজে’ বিমানচালকদের আত্মহত্যার ইতিহাস বর্তমান প্রজন্মের মানসিকতায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে বলে মনে করেন তারা।

মি. নিশিদা বলেন, ‘জাপানে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে, আত্মহত্যা করা পাপ নয়।’ জাপান হেল্পলাইনে কাজ করা কেন জোসেফ একটি সংবাদমাধ্যমে মন্তব্য করেন, অনেক সময় বৃদ্ধ ব্যক্তিরা অর্থনৈতিক দুশ্চিন্তা এবং বীমা সংক্রান্ত জটিলতা থেকে রেহাই পেতে আত্মহত্যা করেন। জাপানে আত্মহত্যা সংক্রান্ত ঘটনায় বীমা প্রতিষ্ঠানগুলো সহজেই বীমার অর্থ হস্তান্তর করে।’

মি. জোসেফ আরও বলেন, ‘যখন আর কোনো উপায় থাকে না, তখন অনেকেই মনে করেন, আত্মহত্যা করলে সহজেই পরিবারের টাকা-পয়সা সংক্রান্ত জটিলতা দূর হবে।’

অর্থনৈতিক চাপের কারণেও জাপানে আত্মহত্যার ঘটনা বাড়ছে। দেশটিতে যে শুধু নিঃসঙ্গ বৃদ্ধরাই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন, তা নয়। আত্মহত্যা করা মানুষের বয়স যাচাই করলে দেখা যায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক আত্মহত্যাকারী ২০ থেকে ৪৪ বছর বয়সি পুরুষ।

আত্মহত্যার ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, আত্মহত্যাকারীরা নিজেদের জীবন নিয়ে হতাশ ছিলেন এবং কারো কাছে সাহায্য চাইতে অপারগ ছিলেন। ১৯৯৮ সালে এশিয়ার অর্থনৈতিক সংকটের পর এ ধরনের আত্মহত্যার হার বেড়ে গিয়েছিল। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের পর আবারও এই হার বৃদ্ধি পায়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, জাপানে ‘অনিশ্চিত চাকরি’র সংখ্যা বা তরুণদের স্বল্পমেয়াদি চুক্তিতে চাকরি দেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। জাপানে অনেক বয়স্ক ব্যক্তি চাকরিক্ষেত্রে নিরাপত্তা এবং ব্যাপক সুবিধা পেলেও পরিসংখ্যান অনুযায়ী জাপানের তরুণদের প্রায় ৪০% স্থির চাকরি পান না। প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং প্রসার তরুণদের আরও বেশি সমাজবিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। যে কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে।

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে