বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। দু’দিন পরেই ঐতিহাসিক ১৬ ডিসেম্বর। দেশের স্বাধীনতা দিবস ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যেমন অসংখ্য গান রচিত হয়েছে তেমন এই বিজয়ের মাস ও তারিখকে কেন্দ্র করেও রচিত হয়েছে অসংখ্য গান। কণ্ঠ দিয়েছেন দেশের তারকা শিল্পীরাসহ বহু শিল্পী। এর মধ্যে অন্যতম সেরা গান হয়ে থাকবে স্বাধীনতা দিবসের জন্য বাংলাদেশ টেলিভিশনের নির্মিত বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুতকৃত ‘সব ক’টা জানালা খুলে দাও না আমি গাইব, গাইব বিজয়েরই গান...’ বাংলা ভাষায় রচিত দেশাত্মবোধক এই গানটি যার কণ্ঠে অত্যন্ত সুমধুর হয়ে দেশপ্রেমিক প্রতিটি মানুষের কানে অনুরণিত হয়েছে তিনি দেশের বরেণ্য কণ্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন। যিনি গানের পাখি, কোকিলকণ্ঠী বা প্লে-ব্যাক সম্রাজ্ঞী খ্যাত হয়ে আছেন দেশের মানুষের কাছে।
ওই বিশেষ সঙ্গীতানুষ্ঠানে ‘সব ক’টা জানালা খুলে দাও না’ ছাড়াও সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে ইমতিয়াজ আহমেদ বুলবুলের লেখা ও সুর করা ‘সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবণ্য’, ‘বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ’, ‘এই দেশ আমার সুন্দরী রাজকন্যা’ ও ‘আয় আয় আয় রে মা আয় আমার কোলে’ গানগুলোও প্রচারিত হয়েছিল।
বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশাত্মবোধক গানে সাবিনা ইয়াসমিন এক প্রকার অপ্রতিদ্বন্দ্বীই। তার কণ্ঠে দেশের গান কতটা অন্তরছোঁয়া দরদমাখানো হয়ে থাকে সেটা গোবিন্দ হালদারের কথা এবং আপেল মাহমুদের সুর করা ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনল যারা’Ñ গানটি যারাই শুনেছেন তারাই বলতে পারবেন। এই গানটির জন্যও সাবিনা ইয়াসমিন বাংলা গানের জন্য কিংবদন্তি হয়ে থাকবেন। ২০০৬ সালে হওয়া বিবিসি’র এক শ্রোতা জরিপে দেখা গেছে, বাংলা গানের সর্বশ্রেষ্ঠ ২০ গানের একটি হিসেবে সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে গাওয়া এই গানটিও আছে।
বাংলাদেশে যাদের কণ্ঠে দেশের গান মানুষের অন্তর ছুঁয়ে গেছে তাদের মধ্যে সাবিনা ইয়াসমিন সবার অগ্রগণ্য হয়ে থাকবেন। বাংলা গানের সেরা শিল্পীর তালিকা করলে তার নামটি একেবারে শুরুতেই থাকবে। প্লে-ব্যাকে রেকর্ডসংখ্যক চৌদ্দবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি। ছয়বার বাচসাস পুরস্কার, উত্তমকুমার পুরস্কার, জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পদকসহ বহু সম্মাননায় ভূষিত বাংলাদেশের বরেণ্য সঙ্গীতশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন। ১৯৮৫ সালে গানের জন্য ভারত থেকে পেয়েছেন ‘ডক্টরেট’।
দেশাত্মবোধক গানে আরও যারা শ্রোতাপ্রিয় হয়েছেন তারা ফেরদৌসী রহমান, শাহনাজ রহমতুল্লাহ্, ফরিদা পারভীন, নীনা হামিদ, আব্বাস উদ্দিন আহমদ, আবদুল আলিম, আবদুল জব্বার অন্যতম। কিন্তু সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে দেশাত্মবোধক গান এতটাই মধুর মতো ভালো লাগা শোনায় যে, সেটাতে খাঁটি অকৃত্রিম ও অসম্ভব দেশপ্রেম ছুঁয়ে যায়।
রুনা লায়লা যেমন বেশির ভাগ চটুল ও যৌনাত্মক গান দিয়ে শ্রোতাপ্রিয়তা পেয়েছেন বিপরীতে সাবিনা ইয়াসমিন মাটি ও মানুষের গান গেয়ে অসামান্য জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। সাবিনা ইয়াসমিন এ পর্যন্ত প্রায় বারো হাজার প্লে-ব্যাক করেছেন। এই গানগুলোর কোনোটিতে আছে মানবিক প্রেম, কোনোটিতে রোমান্টিকতা কিংবা কোনোটিতে দুঃখ-কষ্ট ও বিরহের গান; কোনোটিতে বা নিখাঁদ দেশপ্রেম। তবে চটুল গানে খুব বেশি সারা পাননি সাবিনা ইয়াসমিন। তাই যায়যায়দিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমিও সিনেমায় কিছু হালকা ও চটুল গানে কণ্ঠ দিয়েছি। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, আমার কোনো চটুল গানই শ্রোতাপ্রিয় হতে পারেনি।’
সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠ এতটাই অন্তরছোঁয়া দরদমাখানো মানবিক যে, সেখানে নিছক দেহপ্রেমমূলক যৌনাত্মক চটুল গান তার জন্য সাবলীল হতে পারেনি। এ যেন তার কণ্ঠ প্রকৃতির সঙ্গেই মেলে না। ফলে সিনেমায় তার যেসব চটুল প্লে-ব্যাক হয়েছে সেগুলো শ্রোতারাও বিপুলভাবে নেয়নি। হয়ত শ্রোতাদের কাছেও তার কণ্ঠের ইমেজ এমনইভাবে তৈরি হয়েছে, সেখানে শ্রোতাদের মনে তার কোনো চটুল গান সহজভাবে ঠাঁই করে নিতে পারেনি। আবার যেহেতু প্রায় সব শ্রোতার কাছে ক্ষণিকের জন্য হলেও শ্রুতিমধুর চটুল গান ভালো লাগে এবং সেদিক থেকে আরেক বরেণ্য কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়লা ছিলেন প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী, তাই তার শ্রোতাপ্রিয়তা সাবিনা ইয়াসমিনের চাইতে কিছুটা বেশি হয়ে যায়।
তবে সংখ্যার দিক থেকে কালজয়ী এবং সেরা গানের কণ্ঠশিল্পী হিসেবে সাবিনা ইয়াসমিনকেই অন্য সবার চাইতে এগিয়ে রাখতে হবে। তবে এ দু’জন যখন ডুয়েট প্লে-ব্যাক করেছেন তখন শ্রোতারাও দ্বিধায় পড়ে যান কার কণ্ঠ সবচেয়ে বেশি শ্রুতিমধুর। ‘প্রতিনিধি’ সিনেমায় গাজী মাজহারুল আনোয়ারের কথায় ‘তুমি বড় ভাগ্যবতী’ গানে দু’জনের গাওয়া ডুয়েট গান থেকেও শ্রোতাদের সবাই এটা অনুভব করেছেন। তবে মাস্তি-মাস্তি গানেও কম যান না সাবিনা ইয়াসমিন। যদিও কথা ও সুর তেমনই দুর্দান্ত মাস্তিময় হয়। যেমন তার কণ্ঠে গাওয়া ১৯৭৩ সালে নির্মিত এক সময়ের অসম্ভব শ্রোতাপ্রিয় হওয়া ‘রংবাজ’ সিনেমার ‘ঐ হৈ হৈ রঙিলা, রঙিলারে’ গানটি। এই সিনেমা ও গানটি এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে, পরবর্তী সময়ে ১৯৯৭ সালে আবার এই সিনেমা ও গানের রিমেক হয় ওমর সানী এবং মৌসুমী অভিনীত ‘রঙ্গিন রংবাজ’ নামে। গানটির জন্য সাবিনা ইয়াসমিন এতটাই অনিবার্য ছিলেন যে, নতুন রিমেক গানটির জন্য সাবিনা ইয়াসমিনের বিকল্প হিসেবে আর কাউকেই ভরসা করতে পারেননি প্লে-ব্যাকটির সঙ্গীত পরিচালক। তবে ডুয়েট কণ্ঠের পুরুষ শিল্পী হিসেবে মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী’র বিকল্প হিসেবে খালিদ হাসান মিলু এই গানটিতে কণ্ঠ দেন।
শুধু ‘তুমি বড় ভাগ্যবতী’ বা ‘ঐ হৈ হৈ রঙিলা রঙিলারে’ গানই নয়, এমন আরও বহু ডুয়েট গানে কণ্ঠ দিয়েছেন সাবিনা ইয়াসমিন যেখানে তার কণ্ঠ সহশিল্পীর সঙ্গে চমৎকারভাবে মানিয়ে গেছে। তা মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকীই হোক আর তার চেয়ে অনুজ খালিদ হাসান মিলুর সঙ্গেই হোক। এমনিতেই প্লে-ব্যাকে ডুয়েট গানই বেশি হয় সেখানে ডুয়েটে দেওয়া কণ্ঠ আর এককে দেওয়া কণ্ঠ- এ দুটোর মধ্যে কোন গানে কণ্ঠ দিতে বেশি ভালো লাগেÑ এমন কথায় সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘আমার কাছে দুটোই সমান মনে হয়। আলাদাভাবে একক গানে কণ্ঠ দিতে ভালো লাগে বা ডুয়েট গানে কণ্ঠ দিতে ভালো লাগে এমন নয়। গান ভালো হলে ডুয়েট-সিঙ্গেল সব গানই ভালো। সব গানই আনন্দের। ভালো লাগার। ডুয়েট-সিঙ্গেল বুঝি না। গান তো গানই।’
তবে এক সময়ের প্লে-ব্যাকে ডুয়েট-সিঙ্গেল যেমন ছিল, শ্রোতাপ্রিয়তাও পেয়েছিল, তা থেকে এখনকার প্লে-ব্যাকে অনেক পরিবর্তন এসেছে এটা কীভাবে গ্রহণ করছেনÑ এমন প্রশ্নে সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘কিছুটা পার্থক্য তো এসেছেই। তবে এই ধারার গান আমি শুনি না। শুনতে ভালোও লাগে না। তারপরও বাধ্য হয়েই এসব প্লে-ব্যাকেও আমাকে কণ্ঠ দিতে হয়। কিন্তু তারপরও আমি এমন কোনো গানে আমি কণ্ঠ দিই না যেগুলো আমার পছন্দ হয় না। আর এখন ভালো কালজয়ী গান হবেই বা কি করে। এখন তো ভালো মানসম্পন্ন সুরকারই নেই। গানের ভালো কথা হবে, এমন কোনো ভালো গীতিকারও নেই। ভালো মিউজিশিয়ান নেই। এমন সব ডুয়েট গান হচ্ছে তাতে মানুষের রুচিটাও তৈরি হতে পারছে না। অদ্ভুতুড়ে সব কথায় গান হচ্ছে। এখন সব গানই তাৎক্ষণিক। তাৎক্ষণিকও না। গানই হয় না এখন।’
যাযাদি/ এস