মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সূর্যমুখী ফুল চাষে ঝুঁকছেন কৃষক

সূর্যমুখী থেকে হতে পারে স্বাস্থ্য সুরক্ষার তেল সূর্যমুখীর তেল সুস্বাস্থ্যের কারিগর, সবচেয়ে অন্য রকম- যা হতে পারে সূর্যমুখী আমাদের জীবন সংসারে, তা হচ্ছে শৌখিন সূর্যমুখীর উপস্থিতি রাখা নিজেদের অঙ্গনে। শহর হোক, গ্রাম হোক আমাদের বসবাসকারী বাড়ির উঠানের সামনে এক চিলতে খালি জায়গায় সমৃদ্ধ আঙিনায় সবখানে অনায়াসে সূর্যমুখীর দু/একটি চারা রোপণ করেও এমন সৌন্দর্যের মুখোমুখি হতে পারি। মন ভালো হয়ে যাওয়া ফুল আসলেই সূর্যমুখী
ম ইমরান সিদ্দিকী
  ২৪ জুলাই ২০২২, ০০:০০

সূর্যমুখী এক ধরনের একবর্ষী ফুলগাছ। সূর্যমুখী দেখতে শুধু রূপময় নয়- গুণেও অনন্য। সূর্যমুখীর বীজের তেল স্বাস্থ্যের জন্য অসাধারণ। মিষ্টি বাদাম জাতীয় এই বীজে রয়েছে প্রচুর স্বাস্থ্য উপাদান। যেমন- খনিজ পদার্থ, ভিটামিন ও প্রয়োজনীয় ফ্যাটি এসিড। সূর্যমুখীর বীজ শরীরের নানা রোগ সারিয়ে তোলে ও নানাভাবে শরীরকে সুরক্ষিত রাখে। ১৯৭৫ সাল থেকে সূর্যমুখী একটি তেল ফসল হিসেবে বাংলাদেশে চাষাবাদ হচ্ছে। তেলের উৎস হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সূর্যমুখীর ব্যাপক চাষ হয়।

সূর্যমুখী তেলে আছে মানবদেহের জন্য উপকারী ওমেগা-৯ ও ওমেগা-৬, আছে অলিক এসিড। সূর্যমুখীর তেলে আছে শতকরা ১০০ ভাগ উপকারী ফ্যাট। আরও আছে কার্বোহাইড্রেট প্রোটিন ও পানি। সূর্যমুখীর তেল সম্পূর্ণ ক্ষতিকারক কোলেস্টেরলমুক্ত। আছে ভিটামিন 'ই',-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন ও মিনারেল। মুখের যত্নে দাঁতের জন্য উপকারী একমাত্র তেল। হৃদরোগী, ডায়াবেটিসের রোগী উচ্চ রক্তচাপের রোগী, কিডনি রোগীর জন্যও সূর্যমুখীর তেল নিরাপদ। চমৎকার এনার্জির উৎসও সূর্যমুখীর তেল।

সূর্যমুখীই হতে পারে স্বাস্থ্য রক্ষার গুণসম্পন্ন তৈলবীজ। আমরা যেভাবেই তার তেল আহরণ করি না কেন, তা নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত। আমাদের তেলসংক্রান্ত জটিল সব অসুখের হাত থেকে মুক্তি পেতে, তেলের ব্যবহার বাদ দিতে হয় খাবারে, তেলেরও দরকার আছে শরীরের জন্য। সেই অর্থে সূর্যমুখীর তেল হতে পারে আমাদের জন্য আশীর্বাদ। সূর্যমুখীর তেল ঘিরে বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়- যা বনস্পতি তেল নামে পরিচিত। এই তেল অন্যান্য রান্নার তেলের চেয়ে ভালো। এতে কোলেস্টেরলের মাত্রা অত্যন্ত কম থাকায় হৃদরোগীর জন্য বেশ কার্যকর। এছাড়া এতে ভিটামিন এ, ডি ও ই রয়েছে। সূর্যমুখীর বীজে রয়েছে উন্নতমানের ভিটামিন 'ই'- যা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। নিয়মিত এটি খেলে অস্টিওআর্থারাইটিস, অ্যাজমা ও বাতরোগ নিরাময় হয়। হাড়ের সুস্থতার জন্য ম্যাগনেশিয়াম ও ক্যালশিয়াম দুটোই খুব জরুরি। সূর্যমুখীর বীজ খনিজ পদার্থের খুব ভালো উৎস, তাই এটি সুস্থ হাড় গঠনে সহায়তা করে। সূর্যমুখীর বীজে আছে উচ্চমানের ফাইটোস্টেরল ও লিগন্যান্স- যা ক্যানসার কোষ তৈরি হতে দেয় না। সূর্যমুখীর বীজে রয়েছে ভিটামিন বি-৬ যা মাথার ত্বকে অক্সিজেন সরবরাহ করে। এতে করে চুল পড়া কমে ও স্বাস্থ্যোজ্জ্বল নতুন চুল জন্মায়। এতে থাকা ম্যাগনেশিয়াম শরীরের অতিরিক্ত ক্যালশিয়ামের মাত্রা কমিয়ে স্নায়ুতন্ত্রকে সঠিকভাবে কাজ করাতে সাহায্য করে। এই বীজ আমাদের দেহের ক্ষতিকারক কোলেস্টেরল দূর করে আমাদের হৃৎপিন্ডকে ভালো রাখে। হাড়ের জোড়ায় ব্যথা, গ্যাস্ট্রিক আলসার, দেহের চামড়ায় জ্বালা-পোড়া, হাঁপানি ইত্যাদি রোগ সারিয়ে তুলতে সূর্যমুখীর তেল খুবই উপকারী। প্রচুর পরিমাণে খাদ্যশক্তি থাকায় সূর্যমুখী বীজের তেল দুর্বলতা কাটাতে কার্যকরী। সেইসঙ্গে দেহের কার্যক্ষমতা বাড়াতে এবং দীর্ঘদিন কর্মক্ষম রাখতেও সূর্যমুখীর ভূমিকা অনন্য। সূর্যমুখী তেলে থাকা ম্যাগনেসিয়াম উপাদান মানসিক চাপ দূর করে। মাইগ্রেনের সমস্যা এবং মস্তিষ্ককে শান্ত রাখতে সাহায্য করে এই তেল।

অন্যান্য তেলবীজে যেসব ক্ষতিকারক উপাদান (বিশেষ করে কোলেস্টেরল) থাকে সূর্যমুখীতে তা নেই। বরং আরও উপকারী উপাদান ও পুষ্টিগুণ বিদ্যমান। ঢাকাসহ দেশের মেট্রো সিটিগুলোর চেইন মার্কেটে ও সাধারণ মুদিদোকানে এমনকি সারাদেশের শহর-গ্রামের বাজারের প্রসিদ্ধ কিছু কিছু মুদিদোকানগুলোতে বোতলজাত সূর্যমুখীর তেল দেখতে পাওয়া যায়। এগুলো ব্যক্তিমালিকানাধীন বহুজাতিক কোম্পানির নিজস্ব উৎপাদিত ও বিদেশ থেকে আমদানি করা। দাম অনেক, তাই সাধারণের খাদ্যতালিকায় সূর্যমুখী তেলের প্রচলন নেই। সুস্বাস্থ্যের জন্য সূর্যমুখী তেলের বিকল্প নেই। ভারতে এই তেল খুবই জনপ্রিয় ও প্রচলন আছে চোখে লাগার মতো। অন্য তেলের চেয়ে যদিও একটু দাম বেশি, তা সহনশীল ভারতের বাজারে। তাই ভারতীয় জনগোষ্ঠীর মাঝে অঞ্চলভেদে সূর্যমুখী তেলের ব্যবহার লক্ষণীয়। উৎপাদনও ভারতে সূর্যমুখীর মন্দ নয়। সব কটি তেলবীজের তালিকায় সূর্যমুখীও ভারতীয় উৎপাদিত তেলবীজের অন্তর্ভুক্ত ও প্রচলিত মোটামুটি সহজলভ্য তেলবীজ- যা আমাদের দেশে সূর্যমুখী তেল সাধারণের সঙ্গে সাধারণ পরিচয় ঘটাতে এখনো অসফল। বাংলাদেশের আবহাওয়া, জল, মাটি সূর্যমুখী চাষের অনুকূলে। বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে, প্রসার লাভ করছে না সে রকমভাবে সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে তার দাম। অথচ বাংলাদেশে সূর্যমুখীর সম্ভাবনা উজ্জ্বল। আমরা বিদেশ থেকে রিফাইন্ড সয়াবিন তেল আমদানি করি, তাতে আছে ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান। অথচ আমরা যদি দেশীয়ভাবে সূর্যমুখীর বীজকে প্রধান্য দিয়ে রিফাইন্ড না করেও শুধু ঘানিতে সূর্যমুখীর বীজ থেকে তেল সংগ্রহ করি। আমাদের এই ভোজ্যতেলও হতে পারে পুষ্টিসমৃদ্ধ ও সুস্বাস্থ্যকর।

বাংলাদেশের অসংখ্য চরাঞ্চল ও হাওরের জমিতেও সূর্যমুখী উৎপাদন করা যেতে পারে বাণিজ্যিকভাবে। বিভিন্ন প্রতিকূলতায় অনেক জমিতেই প্রধান খাদ্যশস্য ধান উৎপাদন করা সম্ভব হয় না। এসব জমিতে কৃষি বিভাগের পরামর্শ নিয়ে সূর্যমুখী উৎপাদনে আগ্রহী হতে পারেন কৃষকরা। বাংলাদেশের কৃষিতে বিপস্নব এসে গেছে। বাংলাদেশ সরকারের কৃষি বিভাগ, কৃষি গবেষণা বিভাগ এখন অনেক স্বয়ংসম্পূর্ণ, কৃষিতে ভর্তুকিও চোখে লাগার মতো। কিন্তু কৃষকদের উন্নতি হলেও সে রকমভাবে হয়নি। কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে কৃষকরা বরাবরই বঞ্চিত বলা চলে। কৃষকদের দরিদ্রতা দূর করা না গেলে কৃষিতে আগ্রহ হারাবে পেশা হিসেবে জীবিকা নির্বাহকারী কৃষক শ্রেণি। কৃষকদের বীজ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে অন্তত কৃষকদের দিয়ে সূর্যমুখী উৎপাদন করিয়ে, সূর্যমুখীর বীজ যদি সরকারিভাবে ন্যায্যমূল্য পরিশোধে ক্রয়নীতি বাস্তবায়ন করা যায়, যাতে করে মধ্যস্বত্বভোগীরা সেখানে অশুভ ছায়া ফেলতে না পারে। তাহলেই কৃষক উৎসাহ নিয়ে কাজটা করতে পারবেন। বাংলাদেশের কৃষক অত্যন্ত পরিশ্রমী ও নিষ্ঠাবান। তাদের উদ্যমী করা গেলে দারুণ সুফল আশা করা যায়। সূর্যমুখী দেখতে যেমন হাসিখুশি, সূর্যমুখীর বীজের তেলও সুস্বাস্থ্যকর। পুষ্টিগুণে অন্য সব তেলবীজ থেকে শ্রেষ্ঠ।

সূর্যমুখী উৎপাদনে বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ হতে পারে সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার অনুকূলে- যা শারীরিক সুস্থতার বিষয়টি মাথায় রেখে। সরকারিভাবে রিফাইন্ড মেশিনারি সরঞ্জাম আমদানির মাধ্যমে স্থাপন করা গেলেও সূর্যমুখীর বীজ থেকে তেল সংগ্রহ ও রিফাইন্ড সূর্যমুখী তেল বোতলজাত, বাজারজাত করা গেলে, প্রয়োজনে সরকারি ভর্তুকি দিয়ে হলেও সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা গেলে, তেল সহজলভ্য হবে। বিশাল জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা হবে। আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠী ভোজ্যতেলের চাহিদা মেটাতে আমদানি করা সয়াবিন তেলের ওপর নিভর্রশীল। এই তেলে রয়েছে স্বাস্থ্যর জন্য ক্ষতিকারক অনেক উপাদান- যা আমাদের স্থানীয়ভাবে ঘানিতে ভাঙানো সরিষার তেলেও ছিল না। সরিষার তেলই ছিল বাঙালির তেলের চাহিদা পূরণের প্রধান তৈলবীজ।

ভারতের একরের পর একর জমিতে যখন সূর্যমুখীর ফুল হেসে ওঠে আপন স্বভাবজাত হাসিতে, বাংলাদেশেরও কোনো কোনো অঞ্চলে মাঠে ফোটে সূর্যমুখী, এই বাণিজ্যিক চাষবাস সূর্যমুখীর খেত দেখে সবার মন ভরে ওঠে। হলুদ রং আমার পছন্দ নয় কিন্তু হলুদ সূর্যমুখী আমাকে পাগল করে দেয় তার রূপবৈচিত্র্য দিয়ে। বাণিজ্যিক সূর্যমুখীর চাষ, যেন প্রকৃতিকে ঢেলে সাজিয়েছে নতুন করে কেউ। সূর্যমুখী ফুলের চোরা গন্ধ বাতাসে দোল খেয়ে যখন নাকের ভেতর ঢোকে, কী মাদকতা হৃদয়জুড়ে জাগিয়ে তোলে মনভোলানো অনুভব। প্রকৃতি মা তুমি আসলেই তুলনাহীন। সূর্যমুখীর তেল সুস্বাস্থ্যের কারিগর, সবচেয়ে অন্য রকম- যা হতে পারে সূর্যমুখী আমাদের জীবন সংসারে, তা হচ্ছে শৌখিন সূর্যমুখীর উপস্থিতি রাখা নিজেদের অঙ্গনে। শহর হোক, গ্রাম হোক আমাদের বসবাসকারী বাড়ির উঠানের সামনে এক চিলতে খালি জায়গায় সমৃদ্ধ আঙিনায় সবখানে অনায়াসে সূর্যমুখীর দু/একটি চারা রোপণ করেও এমন সৌন্দর্যের মুখোমুখি হতে পারি। মন ভালো হয়ে যাওয়া ফুল আসলেই সূর্যমুখী। আমাদের বসার ঘরে বারান্দায় এমনকি শোবার ঘরে, বাড়ির ছাদের টবে রাখতে পারি সূর্যমুখীর অস্তিত্ব।

সূর্যমুখী আমরা যেখানে যেভাবেই রাখি হয়ে উঠবে সুন্দরের মায়াময় প্রকৃতি, এতটাই সুন্দরের সামর্থ্য আছে এই ফুলটির গতরে। রূপেগুণে অনন্য এই সূর্যমুখী আমাদের জীবনের পরম প্রাকৃতিক বন্ধু। তাকে ভালোবাসতে জানলে সে তার প্রতিদান দিতে পিছপা হয় না। সূর্যমুখীর রূপ ও গুণ বলে শেষ করা যাবে না। প্রকৃতির সন্তান হিসেবে অবশ্যই অকৃত্রিম বন্ধু মানুষের এই সূর্যমুখী। এ ফুল সৌন্দর্য পিপাসুদের প্রাণভ্রমরা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে