বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্ত জলাশয়ে কমছে দেশি মাছ!

আলতাব হোসেন
  ০৮ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

মৎস্য খাতে বাংলাদেশে বৈপস্নবিক পরিবর্তন এসেছে। মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশের সাফল্য আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও স্বীকৃতি পেয়েছে। একই সঙ্গে দেশের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন, রপ্তানি বাণিজ্যের প্রসারে অবদান রাখছে মৎস্য খাত। এছাড়াও দেশের মানুষের প্রাণিজ আমিষের চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশ জোগান দিচ্ছে মাছ।

মাছের উৎপাদন বাড়ানোর আরো সুযোগ রয়েছে দেশের। কিন্তু দিনের পর দিন দেশের অভ্যন্তরে কমে যাচ্ছে মুক্ত জলাশয়ের মৎস্যসম্পদ। গত এক দশকে বিভিন্ন ধরনের ৫৪ প্রজাতির মাছের নাম এসেছে বিলুপ্তির তালিকায়। মুক্ত জলাশয়ের মধ্যে আছে পস্নাবন ভূমি, নদী, খাল, বিল, হাওর, কাপ্তাই হ্রদ ও সুন্দরবন। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সংগৃহীত মাছের শতকরা ৪১.৩৬ ভাগ সরবরাহ আসে মুক্ত জলাশয় থেকে। দেশে উন্মুক্ত জলাশয়ের আয়তন ৪০.৪৭ লাখ হেক্টর, যা মোট অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের শতকরা ৮৮.৪৬ ভাগ।

বাংলাদেশের জলাশয়ে ২৬০ প্রজাতির দেশীয় মাছ, ১২ প্রজাতির বিদেশি মাছ এবং ২৪ প্রজাতির চিংড়ি রয়েছে। জাতীয় অর্থনীতিতে মৎস্যখাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। স্থূল জাতীয় উৎপাদনে এ খাতের অবদান শতকরা প্রায় ৪ ভাগ এবং কৃষির উৎপাদনে শতকরা ২১ ভাগ। জাতীয় রপ্তানি আয়ে মৎস্যখাতের শরিকানা শতকরা প্রায় ৪ ভাগ। আমাদের নিত্যদিনের খাদ্য তালিকায় প্রাণিজ আমিষের শতকরা ৫৮ ভাগ সরবরাহ আসে মাছ থেকে। এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকান্ডে প্রায় ১৩ লাখ শ্রমিক সার্বক্ষণিকভাবে এবং ১ কোটি ২৫ লাখ শ্রমিক খন্ডকালীনভাবে নিয়োজিত আছে। আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে, কর্মসংস্থানে, দারিদ্র্যমোচনে এবং প্রাণিজ আমিষের ঘাটতি দূরীকরণে মৎস্যখাতের উন্নয়ন অপরিহার্য।

মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ স্থান দখল করেছে। এখাতে বিপুল সাফল্যও অর্জন করেছে। পাশাপাশি গবেষণার মাধ্যমে হারিয়ে যাওয়া বহু প্রজাতির মাছচাষে বিপস্নব ঘটছে। তবে দিন দিন পানি দূষণের বিপদ বাড়ায় উন্মুক্ত জলাশয় হুমকিতে পড়েছে। বিশেষত, কৃষিজমিতে ব্যাপকহারে কীটনাশক ও মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারে নদী-নালা, খাল-বিলসহ উন্মুক্ত জলাশয়ের মিঠা পানি প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে। আর বিষাক্ত পানির কারণে দেশীয় মাছ আশঙ্কাজনকহারে কমে যাচ্ছে। বর্ষার শুরুতে বেড়জাল ও কারেন্টজাল দিয়ে মা মাছ নিধণের ফলেও বিলুপ্ত হচ্ছে দেশীয় মাছ। একটি অসাধু চক্র মাছে ডিম ও পোনা মাছ ধরেও দেশীয় মাছের সংকট সৃষ্টি করছে। বিদেশি বিভিন্ন প্রজাতির হাইব্রিড মাছ চাষের ফলে দেশীয় অর্ধশতাধিক প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হচ্ছে। দেশীয় প্রজাতির মাছ বিশেষ করে মাগুর, চাপিলা, শিং, পাবদা, টাকি, রুই, কাতল, মৃগেল, চিতল, রিটা, গুজি আইড়, কৈ, বোয়াল, খৈলসার মতো সুস্বাদু মাছগুলো এখন আর তেমনটা চোখে পড়ে না। দেশি সরপুঁটি, গজার, এলং, বামাশ, টাটকিনি, তিতপুঁটি, বাঘা আইড়, গুলশা, কাজলি, গাং মাগুর, চেলা, বাতাসি, বউরাণী, টেংরা, কানি পাবদা, পুঁটি, মলা, কালোবাউশ, শোল, মহাশোল, রিটা, তারা বাইম, বেলেসহ ৪০ থেকে ৫০টি জাতের মাছ হারিয়ে যেতে বসেছে। হাটবাজারে গেলেও দেশীয় মাছের দেখা মেলে না। পুকুরে চাষ করা হাইব্রিড মাছে সয়লাব মাছের বাজার।

জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়া, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার, সেচ দিয়ে মাছ শিকার, মুক্ত জলাশয়ের মাছের জন্য নিরাপদ ও নির্বিঘ্নে চলাচলে বাধাগ্রস্ত এবং অবাধে মৎস্য নিধনের কারণে বিলুপ্ত হচ্ছে দেশীয় মাছ। বিলুপ্ত প্রায় মাছের প্রজাতিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে মহাবিপন্ন, সংকটাপন্ন ও বিপন্ন প্রজাতি। মহাবিপন্ন প্রজাতি মাছের মধ্যে রয়েছে টাটকিনি, ঘারুয়া, বাঘাইড়, রিটা, রানী, পাঙ্গাশ, বামোশ, নাফতানি, চিতল, ও চাকা। সংকটাপন্ন প্রজাতির মাছের মধ্যে রয়েছে বাচা, ছেপচেলা, ঢেলা, বাঁশপাতা, কুঁচে, নাপতে কই, বাতাসিয়া টেংরা, ফলি ও গুজিআইড়। বিপন্ন প্রজাতির মাছের মধ্যে রয়েছে গুলশা, গনিয়া, দাড়কিনা, আইড়, বড়বাইম, গজার, তারাবাইম, তিতপুঁটি, নামা চান্দা ও কালোবাউশ।

বাংলাদেশে মৎস্যসম্পদ আশঙ্কাজনক হারে দেশীয় মাছ কমার জন্য বিশেষজ্ঞরা বেশ কিছু কারণ শনাক্ত করেছেন। অবাধে মুক্ত জলাশয় ভরাট হওয়া, কারেন্ট জালের ব্যবহার, প্রজনন মৌসুমে ডিমওয়ালা মাছ ধরা, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, পানি সেচের মাধ্যমে সব মাছ তুলে ফেলা, পাটি বাঁধ দিয়ে সব মাছ ধরা, কলকারখানার বর্জ্য জলাশয়ে ফেলা, জলাশয়ে বিষ প্রয়োগ।

কারেন্ট জাল ব্যবহারে আইন করেছে সরকার, তবে সে আইন মানা হয় না তেমন। শুধু কারেন্ট জাল নয়, নির্ধারিত ফাঁসজাল যদি বন্ধ করা যায়, তাহলে মাছের বিলুপ্তি রোধ করা অনেকটা সম্ভব এবং সেই সঙ্গে মাছের উৎপাদনও বেড়ে যাবে। গবেষণায় দেখা গেছে, বছরে যে পরিমাণ জাটকা ধরা পড়ে, তার মাত্র শতকরা ২৫ ভাগ যদি রক্ষা করা যায়, তাহলে বছরে দেড় লাখ টন ইলিশ উৎপাদন সম্ভব, যার বাজারমূল্য ৬০০ কোটি টাকা। শুধু ইলিশ নয়, বর্ষা মৌসুমে এসব জালের অবাধ ব্যবহারে ডিমওয়ালা মাছও ধরা পড়ছে অবাধে। ফলে বংশবৃদ্ধি হচ্ছে না অধিকাংশ মাছের।

রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও কারখানার বর্জ্যের প্রভাবে অপেক্ষাকৃত নাজুক প্রকৃতির মাছের প্রজনন, বিচরণ এবং খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। কিছু মাছ, যেমন: কই, শিং, মাগুর, পুঁটি, শোল, টাকি, গজার, বেলে, টেংরা এসব মাছ সাধারণত কম পানিতে বা ধানিজমিতে ডিম দেয় এবং বাচ্চা লালন করে। কাতলা, রুই, মৃগেল, কালিবাউশসহ অন্যান্য মাছের ছোট পোনা নিচু জমির ধানখেতকে লালনভূমি হিসেবে ব্যবহার করে। রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও কলকারখানার বর্জ্যের কারণে মাছের পাশাপাশি জলজ অন্যান্য প্রাণীর প্রজনন, বিচরণ ও লালনক্ষেত্র দূষিত হচ্ছে।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট দেশীয় বিলুপ্ত ছোট মাছের আয় ৬১টি জাতের মধ্যে ১৭টি জাতকে গবেষণার মাধ্যমে ফিরিয়ে এনেছে। আরও বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন মৎস্য বিজ্ঞানীরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য এখনই কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। অন্যথায় অদূর ভবিষ্যতে দেশে আমিষের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া বিভিন্ন মৎস্যসম্পদের পাশাপাশি জলজ সম্পদও বিলুপ্ত হতে পারে, ফলে প্রকৃতি হারাতে পারে ভারসাম্য। এজন্য কারেন্ট জালের ব্যবহার রোধ করা, প্রজনন মৌসুমে ডিমওয়ালা মাছ না ধরা, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ না করা, জলাশয় সংলগ্ন রাসায়নিক সারের ব্যবহার রোধ করাসহ প্রয়োজনী ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

মৎস্য বিজ্ঞানী আজিজুল ইসলাম বলেন, মুক্ত জলাশয় বলতে দেশের নদনদী, হাওর-বাঁওড়, খাল-বিল এবং বর্ষায় পস্নাবিত জমি যেখানে মাছ প্রাকৃতিক উৎস থেকে খাদ্য গ্রহণ করে বড় হয় এবং বংশ বৃদ্ধি করে। বাংলাদেশ পূর্বে অসংখ্য নদী-নালা, হাওর-বাঁওড়, খাল-বিল, পুকুর, ডোবায় ভরপুর ও সমৃদ্ধ ছিল। এছাড়া দেশে রয়েছে কাপ্তাই লেক এবং সুন্দরবন এলাকাসহ অসংখ্য মুক্ত জলাশয়। দেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, মৌলভীবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ জেলার প্রায় ৪১১টি হাওর রয়েছে। যার আয়তন প্রায় ৮০০০ বর্গকিলোমিটার। এ ছাড়া দেশে রয়েছে প্রায় ৮৭টি বাঁওড়। যার আয়তন প্রায় ৫৪৮৮ বর্গকিলোমিটার। বড় বাঁওড়গুলো যশোর অঞ্চলেই বেশি। বাঁওড়গুলো স্থানীয়ভাবে বিল হিসেবে পরিচিত। দেশে বিদ্যমান প্রসিদ্ধ বিলগুলো হলো চলন বিল, আড়িয়ল বিল, গোপালগঞ্জ, খুলনা বিল। ১৯ শতকের শুরুর দিকে চলন বিলের আয়তন ছিল প্রায় ১০৮৫ বর্গকিলোমিটার। যা বর্তমানে কমে ৩৬৮ বর্গ কিলোমিটার। তবে সারা বছর জলমগ্ন থাকে মাত্র ৮৫ বর্গকিলোমিটার। দেশে বিদ্যমান ৩১০টি নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪০০০ কি.মি.। বর্ষায় দেশের ৫০-৭০ শতাংশ জমি পস্নাবিত হয়। এ ছাড়া দেশে পুকুর-ডোবার সংখ্যা প্রায় ১.৩০ মিলিয়ন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে