বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ছোলা চাষে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকের

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটউটের ডাল গবেষণা কেন্দ্র সূত্র জানায়, ২০০০-০১ অর্থবছরে ১৬ হাজার হেক্টর জমিতে ১২ হাজার টন ছোলা উৎপাদন হয়। আর ২০১৩-১৪ অর্থবছরে আট হাজার হেক্টর জমিতে ছোলা উৎপাদন হয় ৯ হাজার টন। এদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আমদানি ও রপ্তানি উইং সূত্র জানায়, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১৩ হাজার ৪শ টন, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দুই লাখ আট হাজার ৩৫০ টন ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এক লাখ ৭২ হাজার ২২০ টন ছোলা আমদানি হয়। কৃষকরা এখন হিসাব করেন জমি থেকে কত দ্রম্নত ফসল ঘরে তুলতে পারবেন। এ কারণে চাষিরা স্বল্পমেয়াদি ফসল, বিশেষ করে সবজি চাষের দিকে বেশি ঝুঁকছেন। যদি স্বল্পমেয়াদি জাতের ছোলা চাষ করা যেত তাহলে ভালো হতো। কিন্তু স্বল্পমেয়াদি ছোলা চাষে ফলন কম হয়। এছাড়া কিছু রোগ ও ছোলার ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ বেশি দেখা দেয়। এখান থেকেও কৃষকরা আগ্রহ হারাচ্ছেন। সব মিলিয়ে কমে যাচ্ছে ছোলা চাষ। বারি সূত্র জানায়, চার মাসমেয়াদি ছোলা চাষ শুরু হবে। প্রায় নয় জাতের ছোলা চাষাবাদ হয় আমাদের দেশে। রাজশাহী, যশোর, নাটোর, ঈশ্বরদীসহ কয়েকটি অঞ্চলে ছোলা চাষ বেশি হয়।
ইমরান সিদ্দিকী
  ১৫ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

ছোলা একটি ডাল জাতীয় ফসল। বাজারে দামও বেশ ভালো। ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজি বিক্রি হয়। বাংলাদেশের মাটি ছোলা চাষের বেশ উপযোগী। তাই আগাম প্রস্তুতি নিয়ে লাভজনক ফসল ছোলা চাষ করতে পারেন। ছোলা অত্যন্ত পুষ্টিকর খাদ্য। এতে প্রায় শতকরা ২২.৫ ভাগ আমিষ জাতীয় উপাদান আছে। পবিত্র রমজান মাসসহ অন্যান্য সময়ে মুখরোচক খাদ্য হিসেবে ছোলা ব্যবহার হয়। আমাদের দেশে ছোলা রবি শস্য হিসেবে চাষ করা হয়। একই জমিতেই কম খরচে ছোলা চাষ করা যায়। আমন তোলার পর পরই ছোলা চাষের উপযুক্ত সময়। এটি একটি লাভজনক ফসলও বটে। প্রায় সবরকম মাটিতেই ছোলা চাষ করা যায়। তবে দো-আঁশ ও বেলে মাটিতে ছোলার চাষ ভালো হয়। এঁটেল মাটিতেও ছোলা চাষ করা যায়। জলভাবযুক্ত বেশি জমিতে ছোলা ভালো জন্মায় না। ছোলা আবার মিশ্রচাষ হিসেবে চাষ করা যায়।

প্রথমে জমি বাছাই করতে হবে। জমিতে কোনো আগাছা থাকা চলবে না। জমিতে তিন চারবার চাষ দিতে হবে। এরপর খুব ভালো করে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। তারপর মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে সমতল করে নিতে হবে। জমি তৈরির সময় একর প্রতি পাঁচ থেকে ছয় টন গোবর সার প্রয়োগ করে মাটির সঙ্গে খুব ভালো করে মিশিয়ে দিতে হবে। বাংলা বছরের কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাস ছোলা চাষের উপযুক্ত সময়। প্রতি কিলোগ্রাম বীজের সঙ্গে তিন গ্রাম হারে এগ্রোসন জি-এন ও দেড় গ্রাম থাইরাম বা ট্রাইকোডারমা ভিরিডি মিশিয়ে বীজ শোধন করে নিতে হবে। বীজ হাতে ছিটিয়ে বা সারিতে বোনা যায়। তবে কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, বীজ সারিতে বোনাই ভালো। এক ফুট অন্তর সারি করে বুনতে হবে। অনেক সময় আমন ধান তোলার তিন সপ্তাহ আগে জমিতে ছোলার বীজ ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে ছোলা চাষের খরচ অনেক কমে যায়।

সাধারণত ছোলা চাষের জন্য জমিতে সার খুব একটা লাগে না। তবে ভালো ফলনের জন্য কৃষি বিশেষজ্ঞরা একর প্রতি আট কিলোগ্রাম নাইট্রোজেন ও ১৬ কিলোগ্রাম ফসফরাস ও ৮ কিলোগ্রাম পটাশিয়াম প্রয়োগ করার পরামর্শ দেন। জমি তৈরির সময় শেষ চাষের আগে সার প্রয়োগ করে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। গাছে ফুল আসার আগে দু'শতাংশ ডিএপি স্প্রে করলে ফলন বৃদ্ধি পায়। ছোলা গাছ বড় হলেই বিভিন্ন পোকামাকড় আক্রমণ করে। বিশেষ করে ছত্রাকঘটিত রোগ যেমন ধসা, মরচে ও ঢলে পড়া রোগ প্রভৃতি। এই রোগ দমনের জন্য প্রতি লিটার পানিতে ২.৫ গ্রাম ইন্দোফিল বা ডাইথেন এম-৪৫ পানিতে গুলে জমিতে স্প্রে করতে হবে। শুটি ছিদ্রকারী পোকা দমনের জন্য প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলিলিটার থায়োডান ৩৫ ইসি বা ফলিথায়োন ৫০ ইসি জলে গুলে স্প্রে করতে হবে। প্রতি একরে ১৫০-২০০ লিটার ওষুধ গোলা পানি লাগবে। পাশাপাশি মাঝে মাঝেই জমির আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হবে।

ছোলা পাকতে ১২০ থেকে ১৩০ দিন সময় লাগে। ফাল্গুন বা চৈত্র মাসে গাছের পাতা হলুদ হলে গাছ কেটে বা শিকড়সহ উপড়ে তোলা হয়। কাটা গাছ অন্তত সাত দিন রোদে শুকিয়ে গরু দিয়ে মাড়িয়ে বা লাঠি দিয়ে পিটিয়ে বীজ আলাদা করা হয়। সেচবিহীন জমিতে সাত থেকে আট কুইন্টাল পর্যন্ত ফলন দেয়। সেচ যুক্ত জমিতে ফলন আরও বেশি পাওয়া যায়। নামমাত্র খরচে ফলন ভালো হয় বলে সরকার ছোলা চাষে কৃষকদের উৎসাহ দিচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, দেশে আশঙ্কাজনক হারে কমছে ছোলার চাষ ও উৎপাদন। এক যুগের ব্যবধানে অর্ধেকে নেমেছে ছোলা চাষের জমির পরিমাণ। উৎপাদন কমেছে তিন হাজার টন। আর গত দুই বছরের ব্যবধানে আমদানি বেড়েছে ১০ গুণের বেশি। এ অবস্থায় গবেষকরা মনে করছেন, আমদানিনির্ভর হতে যাওয়া এ পণ্যটির চাষ ও উৎপাদনে এখনই যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। না হলে এক সময় পুরোপুরি আমদানিনিভর্র হয়ে যেতে হবে। এতে প্রভাব পড়বে কৃষি অর্থনীতিতে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটউটের ডাল গবেষণা কেন্দ্র সূত্র জানায়, ২০০০-০১ অর্থবছরে ১৬ হাজার হেক্টর জমিতে ১২ হাজার টন ছোলা উৎপাদন হয়। আর ২০১৩-১৪ অর্থবছরে আট হাজার হেক্টর জমিতে ছোলা উৎপাদন হয় ৯ হাজার টন। এদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আমদানি ও রপ্তানি উইং সূত্র জানায়, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১৩ হাজার ৪শ টন, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দুই লাখ আট হাজার ৩শ ৫০ টন ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এক লাখ ৭২ হাজার ২২০ টন ছোলা আমদানি হয়। কৃষকরা এখন হিসাব করেন জমি থেকে কত দ্রম্নত ফসল ঘরে তুলতে পারেন। এ কারণে চাষিরা স্বল্পমেয়াদি ফসল, বিশেষ করে সবজি চাষের দিকে বেশি ঝুঁকছেন। যদি স্বল্পমেয়াদি জাতের ছোলা চাষ করা যেত তাহলে ভালো হতো। কিন্তু স্বল্পমেয়াদি ছোলা চাষে ফলন কম হয়। এছাড়া কিছু রোগ ও ছোলার ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ বেশি দেখা দেয়। এখান থেকেও কৃষকরা আগ্রহ হারাচ্ছেন। সব মিলিয়ে কমে যাচ্ছে ছোলা চাষ। বারি সূত্র জানায়, চার মাস মেয়াদি ছোলা চাষ শুরু হবে। প্রায় নয় জাতের ছোলা চাষাবাদ হয় আমাদের দেশে। রাজশাহী, যশোর, নাটোর, ঈশ্বরদীসহ কয়েকটি অঞ্চলে ছোলা চাষ বেশি হয়।

গবেষকরা বলছেন, দেশে ছোলা চাষ বাড়াতে নতুন অঞ্চল বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে কাজ করতে হবে স্বল্পমেয়াদি জাত নিয়েও। এছাড়া যেসব এলাকায় পতিত জমি আছে সেসব এলাকায় ছোলা চাষ নিয়ে কাজ করার সুযোগ আছে। যেমন কুমিলস্না, নোয়াখালীসহ বিভিন্ন এলাকায় এক থেকে দুই ফসলি জমি বেশি রয়েছে। এসব জমিতে ছোলা চাষ করা যায়।

দেশে জনপ্রিয় জাত হচ্ছে বারি ছোলা-২ (বড়াল) গাছের রং সবুজ। বীজ স্থানীয় জাতের চেয়ে বড়। হাজার বীজের ওজন ১৪০-১৫০ গ্রাম। বীজের রং হালকা বাদামি। বীজের আকার বড় হওয়ায় এ জাতের ছোলা কৃষক ও ক্রেতার কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য। ডাল রান্না হওয়ার সময়কাল ৩০-৩৫ মিনিট। আমিষের পরিমাণ ২৩-২৭ শতাংশ। বারি ছোলা-২ এর জীবনকাল ১২০-১৩০ দিন। হেক্টরপ্রতি ফলন ১.৩-১.৬ টন। এ জাত নুয়ে পড়া বা উইল্ট রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন।

বারি ছোলা-৩ বরেন্দ্র এ জাতের গাছ খাড়া প্রকৃতির। রং হালকা সবুজ, পত্রফলক বেশ বড় এবং ডগা সতেজ। বীজের আকার বেশ বড়। হাজার বীজের ওজন ১৮৫-১৯৫ গ্রাম। ডাল রান্না হওয়ার সময় ৪০-৪৪ মিনিট। আমিষের পরিমাণ ২৩-২৬ শতাংশ। সঠিক সময়ে বুনলে পাকতে সময় লাগে ১১৫-১২৫ দিন। এ জাতটি রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে আবাদের জন্য বেশি উপযোগী। ফলন হেক্টর প্রতি ১.৮-২.০ টন পাওয়া যায়।

বারি ছোলা-৪ জোড়াফুল গাছ মাঝারি খাড়া এবং পাতা গাঢ় সবুজ। কান্ডে খয়েরি রংয়ের ছাপ দেখা যায়। বীজের পার্শ্ব দিক সামান্য চেপ্টা, ত্বক মসৃণ। বীজের রং হালকা বাদামি। হাজার বীজের ওজন ১৩২-১৩৮ গ্রাম। গাছের উচ্চতা ৫০-৬০ সেমি। ডাল রান্না হওয়ার সময় ৩২-৩৮ মিনিট। আমিষের পরিমাণ ১৮-২১ শতাংশ। জীবনকাল ১২০-১২৫ দিন। ফলন হেক্টরপ্রতি ১.৯-২.০ টন। এ জাতটি ফিউজেরিয়াম উইল্ট রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন।

চাষের সময় সমুদয় সার প্রয়োগ করতে হয়। অপ্রচলিত এলাকায় আবাদের জন্য সুপারিশ মতো নির্দিষ্ট অণুজীব সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। প্রতি কেজি বীজের জন্য ৮০ গ্রাম হারে অণুজীব সার প্রয়োগ করতে হয়। ইনোকুলাম সার ব্যবহার করলে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হয় না। বপনের ৩০-৩৫ দিনের মধ্যে একবার আগাছা দমন করা প্রয়োজন। অতি বৃষ্টির ফলে যাতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি না হয় সেজন্য অতিরিক্ত পানি বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। জমিতে পর্যাপ্ত রস না থাকলে বপনের পর হালকা সেচ দিতে হবে। পোকার কীড়া (শুককীট) কটি পাতা, ফুল ও ডগা খায়। ফল বড় হওয়ার সময় ছিদ্র করে ভেতরের নরম অংশ খায়। একটি কীড়া পূর্ণাঙ্গ হওয়ার পূর্বে ৩০-৪০টি ফল খেয়ে ফেলতে পারে। এ রোগে ছোলার উৎপাদন অনেক হ্রাস পায়। গুদামজাত করার আগে দানা ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হয়। ডালের দানা শুকিয়ে পানির পরিমাণ ১২ শতাংশ এর নিচে আনতে হবে। বীজের জন্য টন প্রতি ৩০০ গ্রাম ম্যালাথিয়ন বা সেভিন ১০ শতাংশ গুড়া মিশিয়ে পোকার আক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়। ফসটক্সিন ট্যাবলেট ২টি বড়ি প্রতি ১০০ কেজি গুদামজাত ডালে ব্যবহার করতে হয়। এ বড়ি আবদ্ধ পরিবেশে ব্যবহার করতে হয়। চৈত্রের প্রথম সপ্তাহ থেকে মধ্য-চৈত্র (মধ্য-মাচের্র শেষ) সময়ে ফসল সংগ্রহ করতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে