শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

চাষের মাছ উৎপাদনে এগিয়ে বাংলাদেশ

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী করোনার মধ্যেও বিশ্বের যে চারটি দেশ মাছ উৎপাদনে সাফল্য দেখিয়েছে তার মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। বিএফআরআইয়ের তথ্যমতে, গত এক যুগে দেশি ৩৬ প্রজাতির ছোট মাছের চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এর ফলে এ সময়ে চাষের মাছ উৎপাদন ৬৭ হাজার টন থেকে বেড়ে প্রায় আড়াই লাখ টন হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, দেশে স্বাদুপানির ২৬০ প্রজাতির মাছ রয়েছে। তার মধ্যে মাত্র ৩০টি প্রজাতির চাষ বেশি হচ্ছে। বাকিগুলোর চাষ বাড়লে বাংলাদেশের মাছ উৎপাদন ৫০ লাখ টনে পৌঁছাবে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের মুক্ত জলাশয়ের মাছ উৎপাদনে সফলতার ক্ষেত্রে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে। আর চাষের মাছের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মৎস্য বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত মাছের জাতগুলো চাষিদের কাছে দ্রম্নত জনপ্রিয় ও লাভজনক হয়েছে। ফলে তাতে উৎপাদনও বেড়েছে
ইমরান সিদ্দিকী
  ২২ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

মৎস্য খাতে বাংলাদেশে বৈপস্নবিক পরিবর্তন এসেছে। মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশের সাফল্য আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও স্বীকৃতি পেয়েছে। একই সঙ্গে দেশের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন, রপ্তানি বাণিজ্যের প্রসারে অবদান রাখছে মৎস্য খাত। এছাড়াও বর্তমানে দেশের মানুষের প্রাণিজ আমিষের চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশ জোগান দিচ্ছে মাছ। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। বিশ্বে স্বাদুপানির মাছের ১১ শতাংশ এখন বাংলাদেশে উৎপাদন হচ্ছে। চাষের মাছ উৎপাদনে সেরা তিন দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। তালিকার অন্য দুই দেশ

ভিয়েতনাম এবং মিশর।

মৎস্য আহরণ ও উৎপাদনে ব্যাপক সাফল্য বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গৌরবের অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে প্রান্তরীণমুক্ত জলাশয়ে মৎস্য আহরণে বাংলাদেশ তৃতীয়, বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদনে ৫ম, ইলিশ আহরণে ১ম ও তেলাপিয়া উৎপাদনে ৪র্থ অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশে মোট যে পরিমাণ মাছ উৎপাদিত হয়, তার মধ্যে কার্প, অর্থাৎ রুইজাতীয় মাছ ২১ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয় রুই মাছ- ১১ শতাংশ। এরপরে রয়েছে পাঙাশ ১১ দশমিক ৫৫ শতাংশ, তেলাপিয়া ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ, কাতলা পৌনে ৭ শতাংশ ও সিলভার কার্প ৭ দশমিক ৩ শতাংশ।

জনসংখ্যা বৃদ্ধি আর নদনদী, খালবিল দূষণের কারণে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে স্বাদুপানির মাছের উৎপাদন কমছে। চাষের মাছের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা চলছে। এর মধ্যে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হিসেবে চারটি দেশ উৎপাদন বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে।

এর মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার ও উগান্ডা হলো সেই চার দেশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) 'দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার-২০২২' শীর্ষক বৈশ্বিক প্রতিবেদন অনুযায়ী চাষের মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে। এর আগের ছয় বছর ছিল পঞ্চম অবস্থানে। এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম এবং মিসর চাষের মাছে এই সাফল্য দেখিয়েছে। বলা হয়েছে, বিশ্বে স্বাদুপানির মাছের ১১ শতাংশ এখন বাংলাদেশে উৎপাদিত হচ্ছে। যার মোট পরিমাণ প্রায় ১৩ লাখ টন।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী করোনার মধ্যেও বিশ্বের যে চারটি দেশ মাছ উৎপাদনে সাফল্য দেখিয়েছে তার মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। বিএফআরআইয়ের তথ্যমতে, গত এক যুগে দেশি ৩৬ প্রজাতির ছোট মাছের চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এর ফলে এ সময়ে চাষের মাছ উৎপাদন ৬৭ হাজার টন থেকে বেড়ে প্রায় আড়াই লাখ টন হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, দেশে স্বাদুপানির ২৬০ প্রজাতির মাছ রয়েছে। তার মধ্যে মাত্র ৩০টি প্রজাতির চাষ বেশি হচ্ছে। বাকিগুলোর চাষ বাড়লে বাংলাদেশের মাছ উৎপাদন ৫০ লাখ টনে পৌঁছাবে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের মুক্ত জলাশয়ের মাছ উৎপাদনে সফলতার ক্ষেত্রে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে। আর চাষের মাছের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মৎস্য বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত মাছের জাতগুলো চাষিদের কাছে দ্রম্নত জনপ্রিয় ও লাভজনক হয়েছে। ফলে তাতে উৎপাদনও বেড়েছে।

স্বাদুপানির পাখনাযুক্ত মাছ উৎপাদনের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। এসব মাছের মধ্যে ইলিশও রয়েছে। বাংলাদেশে মুক্ত জলাশয় থেকে মোট ১৩ লাখ টন মাছ আহরণ করা হয়। এর মধ্যে ইলিশ প্রায় ছয় লাখ টন। ইলিশ মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম অবস্থানে রয়েছে। পাখনাযুক্ত অন্য প্রধান সাতটি মাছ হচ্ছে রুই, কাতলা, পাঙাশ, তেলাপিয়া, গ্রাসকার্প ও সিলভার কার্প। বিশ্বজুড়ে চাষের ক্ষেত্রে এই সাত মাছকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তবে বাংলাদেশের সামুদ্রিক মৎস্য আহরণে খুব বেশি সাফল্যের চিত্র উঠে আসেনি। এই খাতে বাংলাদেশ ২৮তম অবস্থানে রয়েছে। সামুদ্রিক মাছের উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ পাঁচটি দেশ হচ্ছে চীন, ইন্দোনেশিয়া, পেরু, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ সমুদ্র থেকে ৬ লাখ ৭০ হাজার টন মাছ সংগ্রহ করে। আর শীর্ষ অবস্থানে থাকা চীন ১ কোটি ১৭ লাখ ৭০ হাজার টন সামুদ্রিক মাছ আহরণ করে।

বর্তমানে দেশের মানুষের প্রাণিজ আমিষের চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশ জোগান দিচ্ছে মাছ। মাথাপিছু প্রতিদিন ৬০ গ্রাম চাহিদার বিপরীতে মানুষ এখন ৬২ দশমিক ৫৮ গ্রাম মাছ গ্রহণ করছে। দেশের মোট জিডিপির ৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপির ২৬ দশমিক ৫০ শতাংশ এখন মৎস্য খাতের অবদান। বিগত ১২ বছরে মৎস্য খাতে জিডিপির গড় প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ২ শতাংশ। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে মোট মাছের উৎপাদন ছিল ২৭ দশমিক ১ লাখ টন- যা ২০২০-২১ অর্থবছরে বেড়ে হয়েছে ৪৬ দশমিক ২১ লাখ টন। এর মধ্যে সামুদ্রিক মাছের অবদান ৬ দশমিক ৮১ লাখ টন- যা দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের ১৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে জাতীয় মাছ ইলিশের উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৯৯ হাজার টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৫ লাখ ৬৫ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে।

দেশে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে এবং বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় প্রজাতির মাছ বাঙালির পাতে ফিরিয়ে আনতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় গবেষণা এবং উদ্ভাবনে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট দেশীয় মাছ সংরক্ষণে এ পর্যন্ত ৩৬ প্রজাতির দেশীয় বিলুপ্তপ্রায় মাছের প্রজনন কৌশল ও চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে। এ গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি প্রথমবারের মতো ময়মনসিংহে প্রতিষ্ঠা করেছে দেশীয় মাছের লাইভ জিন ব্যাংক। এই জিন ব্যাংকে এখন পর্যন্ত ১০২ প্রজাতির মাছ সংরক্ষণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় সম্প্রতি দেশের ১০ জেলার ৪৯ উপজেলায় 'দেশীয় প্রজাতির মাছ এবং শামুক সংরক্ষণ ও উন্নয়ন' প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে মৎস্য অধিদপ্তর।

বিশ্বে ইলিশ আহরণকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষে। ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। বাংলাদেশের মোট উৎপাদিত মাছের ১২ দশমিক ২২ শতাংশ আসে শুধু ইলিশ থেকে। দেশের জিডিপিতে ইলিশের অবদান ১ শতাংশের অধিক- যা একক প্রজাতি হিসেবে সর্বোচ্চ। ২০১৭ সালে 'বাংলাদেশের ইলিশ' ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই সনদ লাভ করেছে। এ দিকে বাংলাদেশ থেকে প্রধানত গলদা, বাগদা, হরিণাসহ বিভিন্ন জাতের চিংড়ি; স্বাদুপানির মাছ যেমন- রুই, কাতলা, মৃগেল, আইড়, টেংরা, বোয়াল, পাবদা, কৈ প্রভৃতি এবং সামুদ্রিক মাছের মধ্যে ভেটকি, দাতিনা, রূপচাঁদা, কাটল ফিশ, কাঁকড়া ইত্যাদি রপ্তানি হয়। এছাড়া শুঁটকি মাছ, মাছের আঁশ এবং চিংড়ির খোলসও রপ্তানি হয়। বর্তমানে চাষসহ প্রাকৃতিক উৎস থেকে আহরিত কাঁকড়া ও কুঁচিয়া বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।

এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম জানান, বাংলাদেশে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে সরকার গবেষণার ওপর বেশি নজর দিচ্ছে। একই সঙ্গে নতুন উদ্ভাবিত জাতগুলোকে চাষিদের হাতে পৌঁছে দিতে মাছের রেণু ও পোনা উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। জলাশয় ও নদনদীর দূষণ কমাতে পারলে উৎপাদন আরও বাড়বে। বাংলাদেশের মৎস্য উৎপাদনে অভাবনীয় সাফল্যের মূলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। মন্ত্রী আরো বলেন, ইলিশ সম্পদ রক্ষায় এবং উৎপাদন বাড়াতে সরকার নানা কর্মসূচি নিয়েছে। জাটকা সংরক্ষণে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। পাশাপাশি নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত মৎস্য সংরক্ষণ আইন বাস্তবায়ন এবং জাটকা আহরণ নিষিদ্ধকালে জেলেদের চার মাস ভিজিএফ খাদ্যসহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

এছাড়াও মা-ইলিশ রক্ষায় প্রধান প্রজনন মৌসুমে মোট ২২ দিন দেশব্যাপী ইলিশ আহরণ, বিপণন, পরিবহণ ও মজুত বন্ধে নানা

পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে