শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বোরো ধানের উৎপাদন হেক্টরে দুই টন বাড়ানো সম্ভব

এবার বোরো ধানের উৎপাদন বাড়াতে কৃষিবিদরা বলছেন, ব্রি হাইব্রিড ধান-৮ বোরো মৌসুমের জন্য একটি সুপার জাত। জীবনকাল ১৪৫-১৪৮ দিন। ফলন প্রতি হেক্টরে ১০ দশমিক ৫ থেকে ১১ টন। বোরো মৌসুমে বীজ উৎপাদনের সক্ষমতা প্রতি হেক্টরে ১ দশমিক ৮ থেকে ২ দশমিক ২ টন। এই উচ্চফলনশীল ধানগাছটির আরেকটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো এর কান্ড শক্ত ও মজবুত হওয়ার কারণে রোপণ থেকে শুরু করে ধান উত্তোলন পর্যন্ত পুরো মৌসুমজুড়ে গাছ হেলে পড়বে না। ঝড়ের মধ্যেও দাঁড়িয়ে থাকবে। হাইব্রিডের ফলন বেশি। স্বল্প জমি থেকে বেশি উৎপাদনের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় এখন হাইব্রিডের জাত উদ্ভাবন ও আবাদ বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চল বা লবণাক্ত এলাকা লবণাক্ত এলাকায় কৃষকরা অনেক সময় স্থানীয় জাত চাষ করে। সে ক্ষেত্রে লবণাক্ততা সহিষ্ণু ব্রি ধান ৪৭, ব্রি ধান ৬৭, ব্রি ধান ৯৭, ব্রি ধান ৯৯, বিনা ধান ৮ ও বিনা ধান ১০ চাষ করতে পরামর্শ দিয়েছেন কৃষিবিদরা
ইমরান সিদ্দিকী
  ২৯ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা আর বিশ্ব মন্দা মোকাবিলায় এবার বোরো মৌসুমে জোর দিচ্ছে সরকার। বোরো ধানের আবাদ ও উৎপাদন বাড়ানোর জন্য প্রায় ১৭০ কোটি টাকার প্রণোদনা দিয়েছে সরকার। সারাদেশের ২৭ লাখ কৃষক এ প্রণোদনার আওতায় বিনামূল্যে বীজ ও সার পাচ্ছেন। বোরো মৌসুমে দেশের মোট ধান উৎপাদনের প্রায় ৬০ ভাগ আসে বোরো থেকে। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বোরো ধানের গড় ফলন হেক্টর প্রতি ২ টন পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব- যা জাতীয় উৎপাদনে বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে। উচ্চফলনশীল ধানের জাতগুলো খাদ্য ঘাটতির দেশকে আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছে। ধান উৎপাদন বিশ্বে বাংলাদেশ এখন তৃতীয়।

কৃষকরা বলছেন, সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বোরো ধানের আবাদ করলে গড় ফলন হেক্টর ১.৫ থেকে ২.০ টন পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। তবে কৃষকরা বোরো আবাদে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন। তাই ফলন বাড়াতে এলাকায় মৌসুমি জমির ধরন অনুসারে লাগসই জাত নির্বাচন করা জরুরি। গুণগত মানসম্মত বীজ ব্যবহার করে সুস্থ সবল চারা উৎপাদন করতে হবে। অধিক ফলন প্রাপ্তির জন্য জাত নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গে সঠিক ফসল ব্যবস্থাপনা অপরিহার্য। ভালো বীজে ভালো ফলন, ভালো বীজ ব্যবহারের মাধ্যমে ২০ শতাংশ পর্যন্ত ফলন বৃদ্ধি করা সম্ভব। এখন মাঠে মাঠে বোরো ধান রোপণ চলছে।

এ দিকে কৃষিমন্ত্রীকে বোরোর উৎপাদন বাড়ানোর নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বোরোর চাষযোগ্য কোনো জমি যাতে খালি না থাকে সে ব্যাপারে কৃষকদের উৎসাহ দেওয়ার কথা বলেছেন। এদিকে, বোরোর উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে মাঠ থেকে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত সব কর্মকর্তাকে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়ে কৃষিমন্ত্রী ডক্টর মো. আব্দুর রাজ্জাক। তিনি আরও বলেন, চলতি বোরোর যে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তা অর্জন করতে হবে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কৃষকের পাশে থাকতে হবে। এমনিতেই এ বছর আমন ধানের ভালো দাম পাওয়ায় চাষিরা খুশি ও উৎসাহ-উদ্দীপনায় আছে। অন্যদিকে, আমরা কৃষকদের যে বোরো ধানের উন্নত বীজ, সার, সেচসহ বিভিন্ন কৃষি উপকরণ এবং বন্যার ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় প্রণোদনা দিচ্ছি তা সুষ্ঠুভাবে বিতরণ নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই এ লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে।

তিনটি ক্যাটাগরিতে দেওয়া হচ্ছে এই প্রণোদনা। হাইব্রিড ধানের উৎপাদন বাড়াতে প্রায় ৮২ কোটি টাকার প্রণোদনার আওতায় ১৫ লাখ কৃষকের প্রত্যেককে দেওয়া হচ্ছে বিনামূল্যে ২ কেজি ধানবীজ। উচ্চফলনশীল জাতের উৎপাদন বাড়াতে প্রায় ৭৩ কোটি টাকার প্রণোদনার আওতায় উপকারভোগী কৃষক ১২ লাখ। এতে একজন কৃষক এক বিঘা জমিতে চাষের জন্য প্রয়োজনীয় ৫ কেজি বীজ, ১০ কেজি ডিএপি ও ১০ কেজি এমওপি সার বিনামূল্যে পাবেন। এ ছাড়া কৃষিযন্ত্র ব্যবহারের সুবিধার্থে একটি মাঠে একই সময়ে ধান লাগানো ও কাটার জন্য ১৫ কোটি টাকার প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। এর আওতায় ৬১টি জেলায় ১১০টি বস্নক বা প্রদর্শনী স্থাপিত হবে। প্রতিটি প্রদর্শনী হবে ৫০ একর জমিতে, খরচ হবে ১৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা। কৃষি মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত বাজেট কৃষি পুনর্বাসন সহায়তা খাত থেকে এ প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে।

এবার উচ্চফলনশীল হাইব্রিড ধানের আবাদ বাড়ানো হচ্ছে। সব মিলিয়ে ৫৯ লাখ ৭৭ হাজার ৬০০ হেক্টর জমি বোরো চাষের আওতায় আনা হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, গত বছর বোরোর উৎপাদন এর আগের বছরের তুলনায় ১১ লাখ টনেরও বেশি হয়েছে। সে বছর উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ৯৬ লাখ টন। গত বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি উৎপাদন হয়েছে। এবার ২০২২ সালে বোরোতে ২ কোটি ৫ লাখ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। সব মিলিয়ে এ উৎপাদন দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

এবার বোরো ধানের উৎপাদন বাড়াতে কৃষিবিদরা বলছেন, ব্রি হাইব্রিড ধান-৮ বোরো মৌসুমের জন্য একটি সুপার জাত। জীবনকাল ১৪৫-১৪৮ দিন। ফলন প্রতি হেক্টরে ১০ দশমিক ৫ থেকে ১১ টন। বোরো মৌসুমে বীজ উৎপাদনের সক্ষমতা প্রতি হেক্টরে ১ দশমিক ৮ থেকে ২ দশমিক ২ টন। এই উচ্চফলনশীল ধানগাছটির আরেকটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো এর কান্ড শক্ত ও মজবুত হওয়ার কারণে রোপণ থেকে শুরু করে ধান উত্তোলন পর্যন্ত পুরো মৌসুমজুড়ে গাছ হেলে পড়বে না। ঝড়ের মধ্যেও দাঁড়িয়ে থাকবে। হাইব্রিডের ফলন বেশি। স্বল্প জমি থেকে বেশি উৎপাদনের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় এখন হাইব্রিডের জাত উদ্ভাবন ও আবাদ বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চল বা লবণাক্ত এলাকা লবণাক্ত এলাকায় কৃষকরা অনেক সময় স্থানীয় জাত চাষ করে। সে ক্ষেত্রে লবণাক্ততা সহিষ্ণু ব্রি ধান ৪৭, ব্রি ধান ৬৭, ব্রি ধান ৯৭, ব্রি ধান ৯৯, বিনা ধান ৮ ও বিনা ধান ১০ চাষ করতে পরামর্শ দিয়েছেন কৃষিবিদরা।

ব্রি ধান ৬৩ বোরো মৌসুমের একটি প্রিমিয়াম কোয়ালিটি রাইস। এ জাতটির চাল সুরু এবং গুণাগুণ বালাম চালের মতো বলে জাতটি সরু বালাম নামে পরিচিতি। এ জাতের পাকা ধানের রং সোনালি চালের আকার আকৃতি বাসমতির মতো লম্বা ও চিকন চালে আমাইলোজের পরিমাণ ২৫.০ শতাংশ চালে প্রোটিনের পরিমাণ ৮.২ শতাংশ ১০০০টি পুষ্ট ধানের ওজন প্রায় ২২.১ গ্রাম। এ ধানটি ব্রিধান ৫০ এর চেয়ে ৫-৭ দিন আগাম। ব্রি ধান ৬৩ জাতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো শিষ থেকে ধান ঝরে পড়ে না। ব্রি ধান ৬৩ চালের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো রান্নার পর ভাত লম্বায় বাড়ে। এ ধানটি ব্রি ধান ২৮-এর মতো একই পরিচর্যায় করা যাবে। এ ধান চাষ করে কৃষক অধিক লাভবান হবেন। এ জাতের জীবনকাল- এ জাতের গড় জীবনকাল ১৪৮-১৫০ দিন। ফলন- ব্রি ধান ৬৩ উপযুক্ত পরিচর্যায় হেক্টরে ৬.৫-৭.০ টন ফলন দিতে সক্ষম। ব্রি ধান ২৮ বোরো মৌসুমের একটি আগাম জাত। এ জাত ১৯৯৪ সালে চাষাবাদের জন্য অনুমোদিত হয়। এ জাতের জীবনকাল ব্রি ধান ২৯-এর চেয়ে প্রায় তিন সপ্তাহ কম। আগাম ফসল কাটতে চান তাদের জন্য এ জাতটি বিশেষভাবে উপযোগী। এ জাত আগাম বিধায় বন্যাপ্রবণ এলাকায় যেখানে পাকা ধান পানিতে তলিয়ে যায় সেসব এলাকার জন্যও উপযোগী। এ জাতের জীবনকাল ১৪০ দিন এবং স্বাভাবিক ফলন হেক্টরপ্রতি ৫.৫-৬.০ টন।

\হব্রি ধান ২৯ বোরো মৌসুমের একটি নাবি জাতের ধান। এটি একটি উচ্চফলনশীল ক্ষমতাসম্পন্ন জাত। ব্রি ধান ২৯ জাতের বৈশিষ্ট্য হলো- গাছের উচ্চতা ৯৫ সেন্টিমিটার, কান্ড মজবুত তাই হেলে পড়ে না এবং এর চাল মাঝারি চিকন ও সাদা। গুণে ও মানে ব্রি ধান ২৯ সব আধুনিক ধানের সেরা। বলা যেতে পারে বোরো মৌসুমে ব্রি ধান ২৯ সবচাইতে জনপ্রিয় জাত। এর ফলনের পরিমাণ সর্বোচ্চ। তবে উচ্চফলন দেওয়ার জন্য এর সার গ্রহণ ক্ষমতাও বেশি। ব্রি ধান ২৯ পাতা পোড়া ও খোল পোড়া রোগ প্রতিরোধশীল। এর জীবনকাল ১৬০ দিন এবং গড় ফলন হেক্টরপ্রতি ৭.৫ টন। অনেক কৃষকের মতে, ব্রি ধান ২৯ হলো বাংলাদেশের সেরা হাইব্রিড ধান। ব্রি ধান ৪৫ বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট জাতটি সংকরায়ন করে উদ্ভাবন করেছে। এটি ২০০৫ সালে বোরো মৌসুমে চাষাবাদের জন্য জাতীয় বীজ বোর্ডের অনুমোদন লাভ করে। ব্রি ধান ২৮-এর সমান জীবনকাল কিন্তু ফলন বেশি। এ জাতের বৈশিষ্ট্য- গাছ ব্রি ধান ২৮-এর চেয়ে অধিক মজবুত, গাছের উচ্চতা ৯৫-১০০ সেন্টিমিটার, ডিগপাতা লম্বা এবং খাড়া, ১০০০ ধানের ওজন ২৬ গ্রাম, চাল মাঝারি মোটা এবং সাদা, ভাত ঝরঝরে ও সুস্বাদু এবং চালে প্রোটিনের পরিমাণ ৭.২ শতাংশ। এ জাতটির জীবনকাল ১৪০-১৪৫ দিন এবং উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে হেক্টরপ্রতি ৬.০-৬.৫ টন ফলন দিয়ে থাকে।

এ দিকে বোরো মৌসুমে বেশি সার প্রয়োজন হয়। তাই সরকার সারের পর্যাপ্ত মজুত রেখেছে। বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, বছরে সারাদেশে ২৫ লাখ টন ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত বোরো মৌসুমের জন্য প্রয়োজন হয় প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ টন সার। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হয় তিন লাখ ৯৬ হাজার টন। ফেব্রম্নয়ারিতে সার লাগে ৪ লাখ ১১ হাজার টন আর মার্চ মাসে প্রয়োজন হয় দুই লাখ ২৩ হাজার টন। ইতোমধ্যে সরকার বোরো মৌসুমের জন্য ১৫ লাখ টন সারের মজুত করেছে। কৃষি অঞ্চলগুলোতে কৃষকের সেচ কাজে ডিজেল ও নিয়মিত বিদু্যৎ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) হিসাবে, বোরো মৌসুমে দেশে ডিজেল চালিত ১৭ লাখ ৯২ হাজার ৬৩০টি নলকূপ রয়েছে। এর মধ্যে বিদু্যতে চলে এক লাখ ৮৬ হাজার ৪০০টি। অগভীর নলকূপ বিদু্যতে চলে এক লাখ ৫০ হাজার। ডিজেলে চলে ১০ লাখ ৭০ হাজার। গভীর নলকূপের মধ্যে ১২ হাজার ডিজেলে এবং ২৬ হাজার বিদু্যতে চলে। সরকার বিদু্যৎ চালিত পাম্পে ২০ শতাংশ করে ভর্তুকি দিচ্ছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে