শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
মধুপুর গড় যেন আবিমা'র কৃষি রাজ্য

মধুপুরের লাল মাটিতে নতুন জাতের ফল ও ফসল

সমতল এলাকার পাতা ঝরা শাল গজারি, সেগুন, আজুলি বহেড়া, হরীতকী, নিম নিশিগন্ধা, সর্পগন্ধা, শিমুল, জারুল, খাড়াঝরা, অর্জুন, সিদা মেহগনি, বানর নড়ি, আনাইগোটা, তিতিজাম, ঢাকি পিলস্নাগোটা, গাদিলা ও আমলকীর রাজ্য ক্ষীণ হতে থাকে। বাড়তে শুরু করে বাণিজ্যিক কৃষি চাষাবাদ। জুম কিন্তু অনেক আগে বিদায় নিয়েছে লাল মাটির আবিমা থেকে। জুম চাষ আর মধুপুর বনের আদি চিরচেনা লাগসই বৃক্ষরাজি এখন শুধুই স্মৃতি। যদিও বন বিভাগ বিভিন্ন প্র্রকল্পের মাধ্যমে অতীতের বনের অবয়ব ফিরানো জন্য চেষ্টা করছে। এ অঞ্চলের মাটিতে এমন কোনো ফসল হয় না- হবে না, এ কথা মানতে নারাজ এলাকার কৃষকরা। তাদের ধারণা ও বিশ্বাস সব ধরনের কৃষি ফসল হবে এ এলাকার আবিমার উর্বর লাল মাটিতে
হাবিবুর রহমান
  ২৯ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

'আনারস, কলা, চালা-বাইদ, শাল গজারির অবারিত বন, মধুপুরের লাল মাটি আবিমা'র গর্বের ধন'। দেশের বিভিন্ন কৃষি অঞ্চলের মধ্যে লাল মাটির মধুপুর গড় অন্যতম। গড় এলাকার মাটি ভূ-প্রকৃতি বৈশিষ্ট্য বৈচিত্র্যে রয়েছে অন্য সব কৃষি এলাকা থেকে ভিন্নতর। এক দিকে উর্বর মৃত্তিকা, অম্স্নত্ব, উঁচু বন্যামুক্ত। রস, কষ, শক্তি ও সামর্থ্যে বৈচিত্র্যময়। কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু। কোথাও বাইদ, কোথাও চালা। যা হোক মধুপুরের মাটি, পরিবেশ, প্রতিবেশ ও প্রকৃতি সব মিলে যেন এক কৃষির নৈসর্গিক লীলাভূমি।

বলছিলাম আবিমা'র কথা কৃষি রাজ্য নিয়ে। দেশের ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা ও টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়ে রয়েছে গারোদের বসবাস। ম্যাস লাইন মিডিয়া সেন্টার (এমএমসি)-এর উদ্যোগে সম্ভবত ২০০৬ সালে ময়মনসিংহ প্রেস ক্লাবে ৭ দিনের প্রশিক্ষণের সুযোগ হয়। এ প্রশিক্ষণ বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ৬ জেলার গারোদের এলাকায় ফিল্ড ভিজিট করার সুযোগে তাদের বৈচিত্র্যময় বর্ণাঢ্য সংস্কৃতি খাদ্যপ্রণালি জীবনধারা জানা শোনা ও দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। তারপর আমার জন্মের পর বেড়ে ওঠা বসবাস মধুপুরে। আমার এলাকায়ও রয়েছে গারোদের বসবাস।

বলছিলাম আবিমা'র কথা। আবিমা একটি আচিক বা গারো শব্দ। এর অর্থ মাটির মা। গারোদের আচ্চু আম্বি (দাদা-দাদি, নানা-নানি) ও প্রবীণদের সঙ্গে সাংবাদিকতার কারণে নানা সময় নানা কাজে অনুষ্ঠান পর্ব, পার্বণে, বিয়ে-সাদীতে গিয়ে গল্প-আড্ডায় গবেষণার কাজে গিয়ে জানলাম আবিমা কী। আমার ২০ বছরের ঘুরাঘুরি। যখন গারোরা মেঘালয়সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে জুম চাষ করতো তখন তাদের পূর্ব পুরুষরা জুমের ফসল ফলনের দিক বিবেচনা করে মধুপুর অঞ্চলকে আবিমা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। জুম চাষ থেকে পাওয়া শব্দ আবিমা। মধুপুরের মাটির উর্বরতার কারণে তারা আবিমা অর্থাৎ মাটির মা বলে অভিহিত করেছে।

এক সময় মধুপুরে আনারস আর দেশি জাতের কিছু কলা, আদা, হলুদ, কচু ও পেঁপেসহ নানা কৃষি ফসল চাষ হতো। বাণিজ্যিক চাষাবাদ ছিল না। বেশির ভাগ স্থলে ছিল শাল গজারির বন। দিন দিন বন উজাড়ের ফলে সংকুচিত হয় ইতিহাস ঐতিহ্যখ্যাত সমতল এলাকার পাতা ঝরা শাল গজারি, সেগুন, আজুলি বহেড়া, হরীতকী, নিম নিশিগন্ধা, সর্পগন্ধা, শিমুল, জারুল, খাড়াঝরা, অর্জুন, সিদা মেহগুনি, বানর নড়ি, আনাইগোটা, তিতিজাম, ঢাকি পিলস্নাগোটা, গাদিলা ও আমলকীর রাজ্য ক্ষীণ হতে থাকে। বাড়তে শুরু করে বাণিজ্যিক কৃষি চাষাবাদ। জুম কিন্তু অনেক আগে বিদায় নিয়েছে লাল মাটির আবিমা থেকে। জুম চাষ আর মধুপুর বনের আদি চিরচেনা লাগসই বৃক্ষরাজি এখন শুধুই স্মৃতি। যদিও বন বিভাগ বিভিন্ন প্র্রকল্পের মাধ্যমে অতীতের বনের অবয়ব ফিরানো জন্য চেষ্টা করছে। এ অঞ্চলের মাটিতে এমন কোনো ফসল হয় না- হবে না, এ কথা মানতে নারাজ এলাকার কৃষকরা। তাদের ধারণা ও বিশ্বাস সব ধরনের কৃষি ফসল হবে এ এলাকার আবিমা'র উর্বর লাল মাটিতে। হচ্ছেও তাই।

গত কয়েক বছর আগে টাঙ্গাইলের সংবাদকর্মী ইফতেখারুল অনুপম আমাকে ফোনে বললেন গারো বাজারের ছানোয়ার হোসেন নামের এক কৃষক কফি চাষ করেছে তার কফি চাষ নিয়ে প্রতিবেদন করতে হবে। আমি তার পরদিন বাইক নিয়ে গারোবাজারের পথ ধরলাম। গারোবাজারে তার বাড়ি গেলাম। ছানোয়ার ভাই ঘুরে ঘুরে দেখালেন তার এক খন্ড কৃষির রাজ্য। মাল্টা, ড্রাগন, পেয়ারা, আনারস, কফি, বাতাবি লেবু (জাম্বুরা) ও লেবুসহ নানা ফল ফসলে গড়ে তোলেছেন তার কৃষি বৈচিত্র্যময় এক খন্ড রাজ্য। তার সঙ্গে কথা বলে তথ্য নিয়ে এসে প্রতিবেদন করলাম। সংবাদসহ কয়েক পত্রিকায় তার কৃষির রাজ্য নিয়ে খবর ছাপা হলো। পরে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল তাকে নিয়ে প্রতিবেদন করতে শুরু করে। সব মিলে গারো বাজারের কৃষক ছানোয়ার সাহেব এ বছর বঙ্গবন্ধু কৃষি পদক পেলেন।

তারপর, মধুপুর পিচঢালা পথ ধরে ছুটে চললাম শোলাকুড়ির দিকে। পীরগাছা থেকে বামে থানার বাইদ গ্রামে। সেখানে সুলতান নামের এক শিক্ষিত যুবক গড়ে তোলেছেন মাল্টা, কমলা, রাজশাহীর আম, কুল ও কলার খন্ড খন্ড রাজ্য। তার বাগানে ঘুরে ঘুরে দেখে বিস্মিত হলাম। তখন আমের মৌসুম। আম খেয়ে মনে হলো পৃথিবীর সব চেয়ে সুস্বাদু ও মিষ্টি আম। স্বাদ আর মিষ্টির কারণ জানতে নানা জনের সঙ্গে কথা বললাম। জানা গেল শুধু আমই নয়, কুলসহ সব ফসল মিষ্টি হয় মধুপুরের মাটির কারণে। তখন মনে হলো আবিমা'র নামের তাৎপর্য।

সেখান থেকে বেরিয়ে সারা দিন বন এলাকার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে ঘুরে দেখলাম কৃষি আর কৃষির বৈচিত্র্য। কৃষকের ঘামে অর্জিত নানা ফসলের গড়ে ওঠা খন্ড খন্ড রাজ্য। পীরগাছা মিশন থেকে পূর্ব দিকে চুনিয়া গ্রাম। এ গ্রামে গারো রাজা প্রয়াত পরেশ চন্দ্র মৃ'র বাড়ি। এ গ্রামে আদি সাংসারেক গারো জনিক নকরেকেরও বাড়ি। তিনি আজীবন সাংসারেক গারো রীতি অনুযায়ী পূজা পার্বণ করতেন। গারোদের রীতি অনুযায়ী প্রতি বছর নতুন ফসল ঘরে তোলে বক্ষণের আগে তাদের শস্য দেবতা মিসি শালজংকে উৎর্সগের মাধ্যমে তারা খেয়ে থাকে। এতে তাদের মঙ্গল হবে এ মন্ত্র থেকে করে থাকে। এ পর্বকে তারা ওয়ানগালা বলে থাকে। ওয়ানগালা তাদের সামাজিক সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানও বটে। এ অনুষ্ঠানে তারা তাদের আবিমা অঞ্চলে উৎপাদিত কৃষি ফসল তাদরে শস্য দেবতাকে উৎর্সগ করে থাকে। বিভিন্ন গ্রাম থেকে সবাই একত্র হয়ে আগে দিনক্ষণ ঠিক করা স্থানে সবাই মিলিত হয়ে তাদের খামাল (পুরোহিত) দ্বারা মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে ওয়ানগালা করে থাকে। এ সময় ধান, কুমড়া, কচু, আলু, আদাসহ নানা কৃষি ফসল তাদের দেবতাকে উৎসর্গ করে।

দিন দিন মধুপুরের লাল মাটিতে আবাদ হচ্ছে নতুন নতুন ফল ও ফসল। কৃষি ফসলের বহরে যোগ হচ্ছে নতুনধারা। সম্প্রতি মধুপুর-ধনবাড়ী আসন থেকে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য কৃষিমন্ত্রী ডক্টর আব্দুর রাজ্জাক এমপি সুদুর ফিলিপাইন থেকে উন্নত জাতের আনারস চাষের নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচন করেছেন। আনারসের জাতের নাম এমডি-২। কৃষি ও কৃষকের আশা, এ জাতের আনারসের ফলন ভালো হলে মধুপুর কৃষি অঞ্চলে নতুন মাত্রা যোগ হবে। সম্প্রতি মধুপুরের লাল মাটিতে কফি ও কাজু বাদাম চাষ সম্প্রসারণের জন্য কৃষি বিভাগ কাজ করে যাচ্ছে। কফি ও কাজু বাদামের চাষ সম্প্রসারণ ও বাগান দাঁড়িয়ে উঠলে শুধু দেশ নয়, বৈদেশি মুদ্রাও অর্জন করবে দেশ ও লাল মাটির কৃষকরা। কৃষি বিভাগ মাঝে বিনামূল্যে চারা, সার অন্যান্য উপকরণ ও প্রশিক্ষণ প্রদানের মধ্য দিয়ে কৃষকদের প্রশিক্ষিত করছে।

মধুপুরে এখন উচ্চফলনশীল জাতের নানা ফসলের বাণিজ্যিক বাগান গড়ে উঠেছে আবিমা'য়। আবিমা অঞ্চল বুঝানো হয় জামালপুর জেলার কিছু অংশজুড়ে গাজীপুর পর্যন্ত লাল মাটি। বন আলু, বনের নানা ভেষজ বৃক্ষ গারোদের প্রিয় খাবারের অংশ ও ভেষজ চিকিৎসার উপকরণ। শুধু মধুপুর উপজেলায় ৩৭০.৮৪ বর্গমাইল আয়তনের মধ্যে ১১টি ইউনিয়নে রয়েছে ছোট বড় মাঝারি প্রান্তিক চাষি। কৃষক পরিবারের সংখ্যা প্রায় ৫৪ হাজার ৯৫০ এর মতো। উপজেলা মোট কৃষি জমির পরিমাণের মধ্যে রয়েছে এক ফসলি, দুই ফসলি, তিন ফসলি ও তিন ফসলের অধিক ব্যবহারিত জমি। এক সঙ্গে এলাকায় কোনো কোনো কৃষক ৬ থেকে ৭টি ফসল চাষ করে থাকে। স্থানীয় এ ফসলকে 'সাথী ফসল' বা মিশ্রণ ফসলের চাষ বলে থাকে। এলাকার অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি কৃষি। এলাকার আনারস সারাদেশব্যাপী আবিমা অঞ্চলের খ্যাতি ও ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। আবিমা অঞ্চলের মহিষমারা, কুড়ালিয়া, আউশনারা, বেরিবাইদ, অরণখোলা, কুড়াগাছা, ফুলবাগচালা ও শোলাকুড়ি ইউনিয়ন খন্ড খন্ড কৃষি রাজ্য।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে