শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
জাপান, ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানি হচ্ছে মধু

দেশে মধু চাষের অপার সম্ভাবনা

প্রাচীন কাল থেকে মৌমাছি চাষ করা হলেও ১৮৫৩ সালে বিজ্ঞানী ল্যাং স্ট্রোথ আধুনিক পদ্ধতিতে মৌচাষ শুরু করেন এবং তাকেই আধুনিক মৌচাষের জনক বলা হয়। ১৮৮৪ সালে সর্বপ্রথম একজন ইংরেজ ডকলাস উপমহাদেশে মৌচাষের প্রবর্তন করেন। পরে ডক্টর আক্তার হামিদ খান ১৯৫৮ সালে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম মৌচাষের সূচনা করেন। বাংলাদেশে ১৯৬৩ সালে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন প্রথমবার মানুষকে মৌচাষের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করে এবং এরপর থেকে বিভিন্ন সংস্থা মৌমাছি পালন বিষয়ে মানুষকে প্রশিক্ষণ দেওয়া, মৌবাক্স বিতরণ করা ইত্যাদি কাজ চালিয়ে যায়। বিসিকের প্রচেষ্টার সঙ্গে পরবর্তী সময়ে ৮০'র দশকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সম্পৃক্ত হয়।
ইমরান সিদ্দিকী
  ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

দেশে ও বিদেশে সম্ভাবনাময় মধু শিল্প। মধু খুবই সম্ভাবনাময় একটি খাত। এই খাত থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। যথাযথ নিয়মে মধু সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ করতে পারলে অনেক সম্ভাবনা আছে এই খাতে। বাংলাদেশে উৎপদিত ৫০০ টন মধু জাপান, ভারত ও মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। চাষিরা এখন রপ্তানির জন্য বাণিজ্যিকভাবে মধুচাষে ঝুঁকছেন। দেশের মৌ খামারগুলো থেকে এক লাখ টন মধু আহরণের সুযোগ রয়েছে। সেই লক্ষ্যে কাজ করছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন। বর্তমানে সারাদেশে মধু চাষের ব্যাপ্তি বেড়েছে। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে মৌচাষিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। মৌচাষের জন্য চাষিদের উন্নতমানের বাক্স সরবরাহ করা হচ্ছে।

দেশে মধু চাষের অপার সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে সুজলা সুফলা ষড়ঋতুর বাংলাদেশ। দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে আছে ফসলের মাঠ, বৃক্ষরাজি, সবজি ও ফলবাগান। এখানে প্রায় ছয় তুতে কোনো না কোনো ফুল ফোটে। এসব ফুল থেকে মৌমাছি সারা বছরই মধু আহরণ করতে পারে। বর্তমানে প্রায় তিন হাজার মৌচাষি বাণিজ্যিকভাবে মধু উৎপাদন করছে এবং বছরে প্রায় ১০ হাজার টন মধু উৎপাদিত হচ্ছে। যথাযথ পরিকল্পনা ও আধুনিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে মধুর উৎপাদন লাখ টনে উন্নীত করা সম্ভব। আর মৌমাছি দ্বারা পরাগায়নের ফলে পরাগায়িত ফসলের গড় উৎপাদন ২০ থেকে ৩০ ভাগ বৃদ্ধি পাবে।

বাংলাদেশে যে পরিমাণ জমিতে সরিষা, লিচু আম তিল ইত্যাদি ফসলের চাষ হয় তার মাত্র ১০ ভাগ জমিতে মৌচাষ হয়। তাই বলা যায় যে, মধুচাষে বাংলাদেশের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। শতভাগ জমি যদি মৌচাষের আওতায় আনা সম্ভব হয়, সেক্ষেত্রে ফসল উৎপাদন যেভাবে বাড়বে, মধু উৎপাদনও বাড়বে। মধু উৎপাদনে শীর্ষ দেশ চীন। এশিয়ার মাঝে ভিয়েতনাম এবং ভারতের মধু রপ্তানিতে রয়েছে উলেস্নখযোগ্য স্থান। দেশের বাজারে মধু সরবরাহের পাশাপাশি বাংলাদেশ এখন ভারত, থাইল্যান্ড, আরব আমিরাত ও অন্যান্য দেশে মধু রপ্তানিতে বংলাদেশের অবস্থান ৮৩তম এবং আমদানিতে ৬৬তম।

বিসিক বাণিজ্যিকভাবে ২৫ হাজারের বেশি মৌচাষিকে আধুনিক পদ্ধতিতে মৌচাষের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এই কার্যক্রম প্রসারে মৌমাছি পালন স্থায়ী ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপনের একটি পরিকল্পনা নিয়েছে বিসিক। ক্রমাগতভাবে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নতুন মৌচাষি তৈরি করা হচ্ছে। এ ছাড়া মৌচাষ উপযোগী আরও ১২টি জেলায় বিশেষ খামার সৃষ্টি করে মধু উৎপাদনে কাজ করছে সরকার। মৌচাষিরা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মৌসুমে মৌসুমে সরিষা, ধনিয়া, তিল কালজিরা, লিচু এসব ফসলের জমিতে বা বাগানে মৌবাক্স বসিয়ে মধু আহরণ করে। আধুনিক পদ্ধতিতে বাণিজ্যিকভাবে মৌচাষ করে শত শত টন মধু উৎপাদন করছে। এর ফলে মধু আহরিত শস্য যেমন সরিষা, তিল, কালিজিরা, লিচু ইত্যাদির ফলনও বেড়েছে অনেকগুণ। মৌচাষিরা বিভিন্ন ঋতুতে তাদের মৌবাক্স নিয়ে গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, শেরপুর, সাভার, দিনাজপুর, রাজশাহী, বরগুনা ও সুন্দরবনের সাতক্ষীরায় মধু সংগ্রহে চলে যান। একটা নির্দিষ্ট মৌসুমে তারা অবস্থান করেন এবং মধু সংগ্রহ করে ফিরে আসেন। সংগ্রহকারীর কেউ কেউ স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে মধু বিক্রি করেন। বড় খামারিরা সংগ্রহীত মধু প্রসেসিং পস্ন্যান্টে পরিশোধন করে বাজারজাত করেন। সরিষা, লিচু, তিল ও কালিজিরা ফুল থেকে সংগৃহীত মধু আলাদা আলাদাভাবে বাজারজাত করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, আমাদের দেশে যে মধু উৎপাদন হয় তার গুণগত মান অনেক ভালো। এটা যদি সঠিকভাবে বাজারজাত করতে পারলে দেশের বাজারের চাহিদা মেটানো সম্ভব। তাহলে আর মধু আমদানি করতে হবে না।

দেশে প্রথমবারের মতো এবার মৌচাষের জন্য কৃষি বিভাগ থেকে সারাদেশে মৌচাষিদের এক লাখ ৭১ হাজার ৪৩৩টি বাক্স স্থাপনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে শুধু সরিষা ক্ষেতে বাক্স স্থাপনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় এক লাখ ৪৬ হাজার ৮৪০টি। ইতোমধ্যে এক লাখ এক হাজার ৪৬২টি বাক্সে মৌচাষের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে। যার মধ্যে শুধু সরিষা থেকে অর্জত মৌবাক্সের সংখ্যা হচ্ছে এক লাখ এক হাজার ৩৭টি। প্রতি বছর চাষিরা নিজ উদ্যোগে মৌচাষ করে তিন থেকে চার লাখ কেজি মধু আহরণ করলেও চলতি রবি মৌসুমে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মধু সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছে আট লাখ ৩৬ হাজার ৪৬ কেজি। ডিএইর তথ্য অনুযায়ী, ইতোমধ্যে আট লাখ ৪৮ হাজার ৩১০ কেজি মধু আহরণ বা সংগ্রহ হয়েছে। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। এখনো মধু সংগ্রহের কার্যক্রম চলছে। ধারণা করা হচ্ছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আরও অনেক বেশি মধু সংগ্রহ হবে। যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে।

পুষ্টিগুণ ও উপাদেয়তার দিকটি বিবেচনা তালিকা করলে প্রথম সারিতেই থাকবে মধুর নাম। এটি শরীরের জন্য উপকারী এবং নিয়মিত মধু সেবন করলে অসংখ্য রোগবালাই থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। এটি বৈজ্ঞানিকভাবেই প্রমাণিত। মধুতে প্রায় ৪৫টি খাদ্য উপাদান থাকে। ফুলের পরাগের মধুতে থাকে ২৫ থেকে ৩৭ শতাংশ গস্নুকোজ, ৩৪ থেকে ৪৩ শতাংশ ফ্রুক্টোজ, ০.৫ থেকে ৩.০ শতাংশ সুক্রোজ এবং ৫ থেকে ১২ শতাংশমন্টোজ। আরও থাকে ২২ শতাংশ অ্যামাইনো অ্যাসিড, ২৮ শতাংশ খনিজ লবণ এবং ১১ শতাংশ এনকাইম। এতে চর্বি ও প্রোটিন নেই। ১০০ গ্রাম মধুতে থাকে ২৮৮ ক্যালরি। মধু ভালো শক্তি প্রদায়ী খাদ্য। তাপ ও শক্তির ভালো উৎস। মধু দেহে তাপ ও শক্তি জুগিয়ে শরীরকে সুস্থ রাখে। এতে যে শকরা থাকে, তা সহজেই হজম হয়। কারণ, এতে যে ডেক্সট্রিন থাকে, তা সরাসরি রক্তে প্রবেশ করে এবং তাৎক্ষণিকভাবে ক্রিয়া করে। পেটরোগা মানুষের জন্য মধু বিশেষ উপকারী। মধুতে রয়েছে ভিটামিন বি-কমপেস্নক্স। এটি ডায়রিয়া ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। ১ চা চামচ খাঁটি মধু ভোরবেলা পান করলে কোষ্ঠকাঠিন্যতা দূর হয়। মধু রক্তের হিমোগেস্নাবিন গঠনে সহায়তা করে বলে এটি রক্তশূন্যতায় বেশ ফলদায়ক। কারণ, এতে থাকে খুব বেশি পরিমাণে কপার, লৌহ ও ম্যাঙ্গানিজ। ফুসফুসের যাবতীয় রোগে মধু উপকারী। যদি একজন অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্ট রোগীর নাকের কাছে মধু ধরে শ্বাস টেনে নেওয়া হয়, তাহলে সে স্বাভাবিক এবং গভীরভাবে শ্বাস টেনে নিতে পারবে। অনেকে মনে করে, এক বছরের পুরনো মধু শ্বাসকষ্টের রোগীদের জন্য বেশ ভালো। মধু অনিদ্রার ভালো ওষুধ। শীতের ঠান্ডায় এটি শরীরকে গরম রাখে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি ২০২২-২০২৩ রবি মৌসুমে তিন লাখ ২৩৬ হেক্টর জমিকে মধু চাষের আওতায় আনা হয়েছে। ডিএইর তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে ৮ লাখ ১২৩ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ করেছে। এ ছাড়া, শূন্য দশমিক শূন্য ৭৬ লাখ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখী, শূন্য দশমিক ১০৬ লাখ শতাংশে কালোজিরা, এক লাখ ৮৬৬ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ, শূন্য দশমিক ৪০৩ লাখ হেক্টর জমিতে ধনিয়া, এক লাখ ২৯৪ হেক্টর জমিতে আম এবং শূন্য দশমিক ১২৫ লাখ হেক্টর জমিতে লিচু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। মোট ১১ লাখ ৯৯৪ হেক্টর জমিতে এসব ফসল চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এসব ফসলি জমির মধ্যে তিন লাখ ২৩৬ হেক্টর জমি মৌচাষের আওতায় আনা হয়েছে।

প্রাচীন কাল থেকে মৌমাছি চাষ করা হলেও ১৮৫৩ সালে বিজ্ঞানী ল্যাং স্ট্রোথ আধুনিক পদ্ধতিতে মৌচাষ শুরু করেন এবং তাকেই আধুনিক মৌচাষের জনক বলা হয়। ১৮৮৪ সালে সর্বপ্রথম একজন ইংরেজ ডকলাস উপমহাদেশে মৌচাষের প্রবর্তন করেন। পরে ডক্টর আক্তার হামিদ খান ১৯৫৮ সালে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম মৌচাষের সূচনা করেন। বাংলাদেশে ১৯৬৩ সালে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন প্রথমবার মানুষকে মৌচাষের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করে এবং এরপর থেকে বিভিন্ন সংস্থা মৌমাছি পালন বিষয়ে মানুষকে প্রশিক্ষণ দেওয়া, মৌবাক্স বিতরণ করা ইত্যাদি কাজ চালিয়ে যায়। বিসিকের প্রচেষ্টার সঙ্গে পরবর্তী সময়ে ৮০'র দশকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সম্পৃক্ত হয়।

মধুর প্রধান উপকরণ হলো- সুগার, যার মধ্যে ডেক্সট্রোজ, ম্যালটোজ, গস্নুকোজ, লেভিউলোজ এবং সুক্রোজ রয়েছে। প্রতি ১০০ গ্রাম মধুতে ২৮০-৩০৪ গ্রাম ক্যালরি পাওয়া যায়। মধুতে নিয়সিন, রাইবোফ্লাভিন, ভিটামিন বি, এমাইনো এসিড, প্যান্টোথেনিক রয়েছে, এ ছাড়াও ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ফরফরাস, পটাশিয়াম, দস্তা, তামা ইত্যাদি খনিজে ভরপুর মধু। মধুতে কোনো ফ্যাট বা কোলেস্টেরল থাকে না। মধুতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ অ্যান্টি-অক্সিডেন্টাল, অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল উপাদান- যা আমাদের শরীরকে বিভিন্ন জীবাণু আক্রমণ রোধ করে কিংবা প্রতিকার করতে পারে, দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে