শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পোলট্রি বর্জ্যে নতুন দুয়ার খুলছে

খুবই সহজ কিছু পদ্ধতি এবং সাধারণ কিছু প্রযুক্তি ব্যবহার করে পোলট্রি লিটার রিসাইকেল করে জৈব সার উৎপাদন করা হচ্ছে এমনকি প্যাকেটজাত অবস্থায় বাজারজাতও করা হচ্ছে। তবে এটিই শেষ কথা নয়। পোলট্রি বর্জ্য থেকে যে কত কী উৎপাদিত হচ্ছে তা না জানলে অনেক কিছুই অজানা থেকে যাবে। এই নিউজের দেওয়া এক তথ্য মতে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের পোলট্রি ইন্ডাস্ট্র্রিতেই বছরে প্রায় ১১ বিলিয়ন পাউন্ড ওজনের বর্জ্য উৎপাদিত হয়। অবশ্য এটি ক'বছর আগের পরিসংখ্যান, বর্তমানে এ পরিমাণ আরও বেশি। ২০১৫ সালের এক পরিসংখ্যান মতে শুধু আলবামা রাজ্যেই বছরে ১০ লাখ টন চিকেন ওয়েস্ট উৎপাদিত হয়েছে। ২০১১ সালের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে- গেস্নাবাল পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিতে প্রতি বছর বর্জ্য হিসেবে উৎপাদিত হয় প্রায় ২ মিলিয়ন টন মুরগির পালক! কারও কারও মতে, এ পরিমাণ প্রায় ৫ মিলিয়ন টন
মো. সাজ্জাদ হোসেন
  ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

শিল্প বর্জ্য ও দূষণ বর্তমান ও আগামী পৃথিবীর ভয়াবহ একটি হুমকির নাম। বিশ্বের বাঘা বাঘা পরিবেশ বিজ্ঞানীরা হন্যে হয়ে ছুটছেন এর সমাধানের পেছনে। কারণ শিল্প দূষণে মাটি, পানি, বাতাস এমনকি সামগ্রিক প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপন্ন হয়ে পড়ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, মানুষের রকমারি চাহিদা পূরণ, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা, শিল্পবিপস্নব, আর্থিক মুনাফা, বাণিজ্যিক আগ্রাসন সবকিছু মিলিয়ে এমন এক জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যে, এর থেকে পরিত্রাণের উপায় খুব সহজ নয় বলেই মনে করছেন বিশ্ব নেতারা।

শিল্পবিপস্নবের এ যুগে ঘরোয়া পরিবেশে পালিত মুরগিও যখন বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হয়, অতি সাধারণ একটি কুটির শিল্প যখন বৃহৎ শিল্পের মর্যাদা লাভ করে তখন অনেক পরিবেশবাদির ভ্রূ কুঁচকে যাবে সেটাই স্বাভাবিক। উন্নত দেশগুলোর মুরগির খামারগুলোতে বছরে যখন লাখ লাখ টন পোলট্রি লিটার, প্রসেসিং পস্ন্যান্টগুলোতে যখন মিলিয়নস অব টন ওয়েস্ট জমা হতে শুরু করে তখন এগুলোর অপসারণ ডাম্পিং কিংবা সঠিক ব্যবস্থাপনা রীতিমতো মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

অবশ্য এ মাথাব্যথার ওষুধ আবিষ্কার করতে খুব বেশি সময় লাগেনি। আর সে কারণেই শিল্প বর্জ্য নিয়ে বিশ্ব জুড়ে যে হইচই চলছে সেখানে পোলট্রি বর্জ্য বড় কোনো আলোচনায় আসে না। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে পোলট্রি বর্জ্য অভিশাপ তো নয়ই বরং আশীর্বাদ হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিশ্বের বড় বড় দেশ- যেখানে কৃষি জমির পরিমাণ অনেক- যেমন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল প্রভৃতি দেশে জমির উর্বরতা বাড়াতে কম্পোস্ট সার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে পোলট্রি লিটার।

খুবই সহজ কিছু পদ্ধতি এবং সাধারণ কিছু প্রযুক্তি ব্যবহার করে পোলট্রি লিটার রিসাইকেল করে জৈব সার উৎপাদন করা হচ্ছে এমনকি প্যাকেটজাত অবস্থায় বাজারজাতও করা হচ্ছে। তবে এটিই শেষ কথা নয়। পোলট্রি বর্জ্য থেকে যে কত কী উৎপাদিত হচ্ছে তা না জানলে অনেক কিছুই অজানা থেকে যাবে। এই নিউজের দেয়া এক তথ্য মতে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের পোলট্রি ইন্ডাস্ট্র্রিতেই বছরে প্রায় ১১ বিলিয়ন পাউন্ড ওজনের বর্জ্য উৎপাদিত হয়। অবশ্য এটি ক'বছর আগের পরিসংখ্যান, বর্তমানে এ পরিমাণ আরও বেশি। ২০১৫ সালের এক পরিসংখ্যান মতে শুধু আলবামা রাজ্যেই বছরে ১০ লাখ টন চিকেন ওয়েস্ট উৎপাদিত হয়েছে। ২০১১ সালের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে- গেস্নাবাল পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিতে প্রতি বছর বর্জ্য হিসেবে উৎপাদিত হয় প্রায় ২ মিলিয়ন টন মুরগির পালক! কারও কারও মতে, এ পরিমাণ প্রায় ৫ মিলিয়ন টন।

একবার ভাবুন তো, যদি এভাবে বর্জ্য জমা হতে থাকে তবে মানুষ কিংবা পরিবেশের কি অবস্থা হবে? বিজ্ঞানীরা অবশ্য বলছেন, দুশ্চিন্তার কিছু নেই বরং আছে সুখকর সংবাদ! কারণ পোলট্রি বর্জ্য এখন রিসাইকেল করে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ভ্যালু অ্যাডেড প্রোডাক্ট।

ডিমের খোসার ওপর সূক্ষ্ণ কারুকার্য করা কিংবা ঘর সাজাতে ডিমের খোসার ব্যবহার অনেক আগে থেকে শুরু হলেও হাল জামানায় পোলট্রি শিল্পের বর্জ্য নিয়ে চলছে বিস্তর গবেষণা। এখন বলা হচ্ছে পোলট্রি শিল্পে বর্জ্য বলে কিছু নেই।

পোলট্রি নিয়ে পৃথিবীজুড়েই আগ্রহের যেন শেষ নেই। সারা দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষের জন্য ডিম ও মুরগির মাংসের জোগান দিতে কৃষিভিত্তিক এ শিল্পের যেন কোনো বিকল্প নেই। পোলট্রি বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীরা ডিম ও মুরগির মাংসের উপকার নিয়ে নানাবিধ গবেষণা করছেন। এমনকি নানাবিধ ভ্যালু অ্যাডেড প্রোডাক্ট তৈরিরও চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছেন- যেমন ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ ডিম। জাপানের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এডভান্সড ইন্ডাস্ট্রিয়াল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির একদল গবেষক ২০১৭ সালের অক্টোবরে দাবি করেছেন যে, দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়ক ডিম উৎপাদনেও তারা সফলতা পেয়েছেন। তবে শুধু খাদ্য হিসেবেই নয়, পোলট্রি এখন গুরুত্ব পাচ্ছে দারুণ সব পণ্য তৈরির উপকরণের প্রয়োজনীয় কাঁচামালের জোগানদার হিসেবেও। পোলট্রির বিষ্টা বা লিটার থেকে এখন তৈরি হচ্ছে জৈব সার। রাসায়নিক সারের নেতিবাচক প্রভাবে বিশ্ব যখন বিকল্প খুঁজছে, তখন এমন একটি আবিষ্কার স্বস্তিদায়ক তো বটেই উপরন্তু কৃষির জন্যও আশির্বাদ! বাংলাদেশেও শুরু হয়েছে পোলট্রি লিটার থেকে জৈব সারের উৎপাদন। শুধু তাই নয়, পোলট্রি লিটার থেকে তৈরি হচ্ছে বায়োগ্যাস এবং বিদু্যৎ।

বাংলাদেশের প্যারাগন পোলট্রি, কাজী ফার্মস প্রভৃতি দেশীয় কোম্পানিগুলো নিজস্ব খামারে বিদু্যতের চাহিদা মেটাতে অভিনব এ পদ্ধতিকে কাজে লাগাচ্ছে। পোলট্রি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০ হাজার মুরগির একটি ব্রয়লার খামার থেকে প্রায় ৪০ হাজার পাউন্ড বিস্টা বা লিটার পাওয়া যায়।

বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি)-এর হিসাব মতে দেশে বর্তমানে দৈনিক প্রায় ৪ হাজার টন মুরগির মাংস এবং প্রায় ৫ কোটি ডিম উৎপাদিত হচ্ছে। কাজেই বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না যে আমাদের দেশে কী পরিমাণ মুরগির বিস্টা উৎপাদিত হচ্ছে প্রতিদিন। আর এ বর্জ্যকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে কৃষি প্রধান এবং স্বল্প আয়ের এ দেশে কী যে বৈপস্নবিক পরিবর্তন ঘটে যেতে পারে তা বলাই বাহুল্য।

বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই পোলট্রি বর্জ্যের রিসাইক্লিং শুরু হয়েছে। প্যারাগন পোলট্রি ও কাজী ফার্মসসহ বেশ কিছু কোম্পানি তাদের নিজস্ব খামারে উৎপাদিত মুরগির বিস্টা বা লিটারকে কাজে লাগিয়ে বায়োগ্যাস ও জৈবসার উৎপাদন করছে। প্যারাগন আরও একধাপ এগিয়ে মুরগির বিস্টা থেকে বায়োগ্যাস এবং সেখান থেকে বিদু্যৎ উৎপাদন করছে এবং তা নিজস্ব খামারে ব্যবহারও করছে।

মুরগির পালক দিয়েও তৈরি হচ্ছে দারুণ সব পণ্য! মুরগির পেটের দিকের নরম পালক দিয়ে তৈরি 'ফেদার পিলো' বা বালিশ ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে ফেদার ফাইবার- যা উলের মতই আরামদায়ক, হালকা এবং স্থিতিস্থাপক। বায়োফাইবারের ব্যবহার বহুবিধ। পলিমার কম্পোজিট তৈরিতে এর ব্যবহার উৎপাদন খরচ অনেক কমিয়ে দিয়েছে। পস্নাস্টিক, কাঠ, কংক্রিট এবং কার্ডবোর্ডে বায়োফাইবার ব্যবহারের ফলে ওজন অনেক কমছে বা হালকা হচ্ছে। এটি তাপ শোষণ করে এবং শব্দ লঘু করণেও দারুণ কার্যকর- বলছেন বিজ্ঞানীরা।

নেবরাসকা-লিংকইন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক উইকি ইয়াং মুরগির পালক থেকে পস্নাস্টিক তৈরির জন্য কাজ করছেন। তার মতে, এ পস্নাস্টিক হবে পচনশীল এবং পরিবেশবান্ধব। মুরগির পালক তৈরি হয় কেরাটিন দিয়ে। এই কেরোটিন হচ্ছে এমন এক প্রোটিন যা উল, চুল, হাতের নখ, খুর ইত্যাদি শক্ত করতে সহায়তা করে। উইকি ইয়াংয়ের অপর এক সহযোগী নরেন্দ্র রেড্ডী বলেছেন, তাদের তৈরি প্রোডাক্টটি আসলে থার্মোপস্নাস্টিক। একে তাপ দিয়ে গলিয়ে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করা সম্ভব। কেবল একবার নয়, বহুবার গলানো এবং শক্ত করা যায়। পেট্রোলিয়াম- বেজ থার্মোপস্নাস্টিকে ফসিল ফুয়েল ব্যবহার করা হলেও মুরগির পালক থেকে তৈরিকৃত থার্মোপস্নাস্টিক উৎপাদনে ফসিল ফুয়েল ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে না। এ থার্মোপস্নাস্টিক দিয়ে নাকি কাপ, পেস্নট থেকে শুরু করে ফার্নিচার সবকিছুই তৈরি করা যায়।

নবায়নযোগ্য বিকল্প জ্বালানির সন্ধানে: যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের বেশ কিছু বিদু্যৎ উৎপাদন কেন্দ্রে প্রাথমিক জ্বালানি হিসেবে পোলট্রি এবং টার্কি লিটার ব্যবহার করা হচ্ছে। আয়ারল্যান্ডে বায়োমাস এনার্জির উৎস হিসেবে পোলট্রি লিটার ব্যবহৃত হচ্ছে। ব্রয়লার হাউসের তাপ বা উষ্ণতা বাড়াতে আগে যেখানে ফসিল ফুয়েল বা এলপিজি গ্যাস ব্যবহার করা হতো এখন সেখানে এর পরিবর্তে পোলট্রি লিটার ব্যবহার করা হচ্ছে। 'এডভান্স ফাইবারস অ্যান্ড পাউডারস'র মতো বড় বড় কোম্পানি তাদের ইলেকট্রিক্যাল ও হিটিং অ্যাপিস্নকেশনে জ্বালানি হিসেবে পোলট্রি লিটার ব্যবহার করছে। এর পাশাপাশি তারা একটিভেটেড কার্বন এবং সারও তৈরি করছে।

পোলট্রি ফেদার মিল থেকে বায়োডিজেল: নেভাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা 'চিকেন ফেদার মিল' থেকে এক নতুন ধরনের বায়োডিজেল ফুয়েল তৈরি করেছেন। নেভাদা'র প্রফেসর মনোরঞ্জন মিশ্রা ও তার সহকর্মীরা লক্ষ্য করেন যে, চিকেন ফেদার মিলে মুরগির পালক ছাড়াও রক্তসহ প্রসেসিংয়ের সময় মুরগির শরীর থেকে ছড়ে যাওয়া আরও কিছু অংশ থাকে। চিকেন ফেদার মিলে প্রচুর পরিমাণ প্রোটিন উপাদান মিশ্রিত থাকে। আরও থাকে নাইট্রোজেন। সেজন্যই পশুখাদ্য এবং জৈব সার তৈরিতে এর ব্যবহার বাড়ছে। তবে চিকেন ফেদার মিল সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের আগ্রহ অন্য কারণে। আর তা হলো প্রায় ১২ শতাংশ ফ্যাট কনটেন্ট (চর্বি)। বিজ্ঞানীদের অনুমান- শুধু যুক্তরাষ্ট্রের পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিতেই যে পরিমাণ ফেদার মিল তৈরি হয় তা দিয়ে বছরে প্রায় ১৫৩ মিলিয়ন গ্যালন বায়োডিজেল উৎপাদন সম্ভব। আর সারাবিশ্বে যে পরিমাণ ফেদার মিল উৎপাদিত হয় তা দিয়ে বছরে প্রায় ৫৯৩ মিলিয়ন গ্যালন বায়োডিজেল উৎপাদন করা সম্ভব।

লেখক: মো. সাজ্জাদ হোসেন: যোগাযোগ ও মিডিয়া উপদেষ্টা, বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্র্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে