শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সরিষার চেয়ে উন্নত সূর্যমুখীর তেল

নাহিদ বিন রফিক
  ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

মানুষ সৌন্দর্যের পূজারি। এমন উৎসের মধ্যে ফুল অনন্য। আর তা যদি হয় মানবদেহের জন্য হিতকর। তাহলে তো কথাই নেই। যাকে বলে সোনায় সোহাগা। একদিকে মানসিক প্রশান্তি। অন্যদিকে, শারীরিক পুষ্টি। সে কাঙ্ক্ষিত পণ্যের নাম সুর্যমুখী। অনেকেই ফুল হিসেবে চেনেন। আসলে এটি তেল শস্য। সূর্যমুখীর বীজে ৪০-৪৪ শতাংশ তেল থাকে। খাদ্যমান বিবেচনায় এর তেল সরিষার চেয়েও উন্নত। এতে প্রচুর পরিমাণ লিনোলিক এসিড রয়েছে- যা শরীরের জন্য খুবই উপকারী। পক্ষান্তরে নেই ক্ষতিকর ইউরিক এসিড। নানা প্রকার রান্নায় এবং ডালডা তৈরিতে সূর্যমুখীর তেল ব্যবহার করা যায়। সূর্যমুখীর খৈল গরু ও মাছের উৎকৃষ্ট খাবার। চিনাবাদামের মতোই এর বীজ ভেজে খাওয়া যায়।

সূর্যমূখী অন্য যে কোনো তেলজাত ফসলের তুলনায় উৎপাদন বেশি হয়। যদিও শতভাগ আমদানিনির্ভর সয়াবিনতেলের ওপর আমরা এখন অনেকটাই নির্ভরশীল। অথচ এক সময় সরিষা ছিল বাঙালিদের ভোজ্যতেলের চাহিদা পূরণের প্রধান উৎস। সে সঙ্গে তিল, তিসি এবং বাদামও ছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, সয়াবিনতেল এবং পামওয়েলে ক্ষতিকর দিক রয়েছে। কিন্তু সূর্যমুখীর তেল পুরোটাই নিরাপদ। অন্যান্য তেলও স্বাস্থ্যসম্মত। আসলে সূর্যমুখীর স্বাস্থ্যঝুঁকিহীন তেল আমাদের জন্য আশীর্বাদ। যেহেতু দেশের মোট চাহিদার শতকরা ৮০ ভাগ খাবার তেল বিদেশ থেকে আসে আর এর পেছনে প্রতিবছরে ব্যয় হয় প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। তাই অন্যান্য তেল ফসলের পাশাপাশি এর চাষাবাদ বাড়াতে হবে। তবেই ভোজ্যতেলের ঘাটতি পূরণে সূর্যমুখী রাখতে পারবে বিশেষ ভূমিকা। কেননা, অন্য তেল ফসল একবার আবাদ হলেও সূর্যমুখী বছরে দুই বার চাষ করা যায়।

সূর্যমুখীর তেল অত্যন্ত পুষ্টিকর। ফ্যাটসমৃদ্ধ এই তেল শরীরের জন্য নিরাপদ। আছে ক্যালসিয়াম, কপার, আয়রন, জিঙ্ক ও ম্যাগনেসিয়াম। আরো রয়েছে ভিটামিন-ই এবং ভিটামিন-কে। বনস্পতি এই তেল ভেষজগুণেও ভরপুর। এতে সেলেনিয়াম থাকায় ক্যানসার প্রতিরোধ করে। তেলে আছে শরীরের জন্য হিতকর ওমেগা-৬, ওমেগা-৯। মানুষের রক্তের কোলেস্টেরল, উচ্চরক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। শরীরের দুর্বলতা কাটায়। মানসিক চাপ কমায়। মস্তিষ্ক ঠান্ডা রাখে। মাইগ্রেনের সমস্যা দূর করে। হাঁপানি, গ্যাস্টিক, আলসার এবং হাড়ের জোড়ায় ব্যথা নিরাময় করে। শিশুদের রোগপ্রতিরোধে অনন্য। শুধু কী তাই! ত্বকের যত্নেও রয়েছে বিশেষ গুণ। অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি থাকায় মুখের ব্রণ প্রতিরোধ করে। সূর্যের আল্ট্রা-ভায়োলেট রশ্মি থেকে ত্বককে সুরক্ষা রাখে। এছাড়া এর ফুল পাখি ও কীটপতঙ্গকে আকৃষ্ট করে। এতে সুর্যমুখী ছাড়াও আশপাশের বিভিন্ন ফসলে পরাগায়নে হয় বাড়তি সুবিধা। ফলে উৎপাদন বাড়ে।

সুর্যমুখী চাষের জন্য রাশিয়া, ইউক্রেন আর আর্জেন্টিনা বিশ্বখ্যাত। অন্যান্য দেশেও আবাদ হয়। তবে আমাদের দেশে কেউ কেউ সখের বশে বাড়ির আঙিনায় দু'একটি গাছ লাগিয়ে থাকেন। যদিও বাংলাদেশে স্বাধীনতাপরবর্তী সময় থেকেই সূর্যমুখী তেল ফসল হিসেবে চাষ হচ্ছে। কিন্তু এর সম্প্রসারণ কাঙ্ক্ষিত নয়। দেশে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি জেলা এবং যশোর, কুষ্টিয়া, গাজীপুর, টাঙ্গাইল আর কুমিলস্নায় সীমিত পরিসরে আবাদ হচ্ছে। অন্য এলাকায় তেমন একটা দেখা যায় না। অথচ সূর্যমুখী সব ধরনের মাটিতে চাষযোগ্য। তবে দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি উত্তম। মধ্যম মাত্রা লবণাক্ততা সহ্য করার ক্ষমতাও রয়েছে।

দেশে চাষ উপযোগী ইনব্রিড জাতগুলো হলো: কিরণী (ডি এস-১), বারি সূর্যমুখী-২ এবং বারি সূর্যমুখী-৩। আমদানিকৃত কিছু জাতও রয়েছে। এর মধ্যে হাইসান ৩৩ অন্যতম। কিরণী (ডিএস-১) জাতটি রবি মৌসুমে ভাদ্র-আশ্বিন (মধ্য আগস্ট-মধ্য অক্টোবর) মাসে বীজবপন করলে ফসল পরিপক্ব হতে সময় লাগবে (৯০-১০০) দিন আর কার্তিক-অগ্রহায়ন (মধ্য অক্টোবর-মধ্য ডিসেম্বর) মাসে বপন করা হলে ফসল তুলতে সময় লাগবে (১০০-১১০) দিন। এর হেক্টরপ্রতি ফলন (১.৬-১.৮) টন। জাতটি 'অল্টারনেরিয়া বস্নাইট' রোগের ক্ষেত্রে কিছুটা সহনশীল। বারি সূর্যমুখী-২ রবি মৌসুমের অগ্রহায়ণ মাস অর্থাৎ মধ্য নভেম্বর থেকে মধ্য ডিসেম্বর আর খরিফে ভাদ্র মাস অর্থাৎ মধ্য আগস্ট থেকে মধ্য সেপ্টেম্বর বীজবপন করতে হবে। রবি মৌসুমে হেক্টরপ্রতি ফলন (২.০-২.৩) টন এবং খরিফ মৌসুমের ফলন (১.৫-১.৮) টন। এটি পাতা ঝলসানো রোগসহনশীল। বারি সূর্যমুখী-৩ : খাটো আকৃতির এ জাতটি জীবনকাল ৯০-১০৫ দিন। এ জাত ব্যবহারের জন্য রবি মৌসুমের অগ্রহায়ণ মাস অর্থাৎ মধ্য নভেম্বর থেকে মধ্য ডিসেম্বরে বীজবপন করা উত্তম। হেক্টরপ্রতি এর ফলন ১.৫-২.০ টন। জাতটি পাতা ঝলসানো এবং ঢলে পড়া রোগ প্রতিরোধ করে। হাইসান-৩৩ : এটি বাংলাদেশে চাষযোগ্য একটি হাইব্রিড জাত। এর জীবনকাল (১১০-১২০) দিন। হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ৩ টন প্রায়।

প্রথমে গভীরভাবে চাষ আর মই দিয়ে জমি এমনভাবে প্রস্তত করতে হবে যেন- মাটি ঝুরঝুরে হয়। এরপর লাইন টেনে ১ ইঞ্চি গভীর করে প্রতি গর্তে ২ থেকে ৩টি বীজ বপন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব ২০ ইঞ্চি এবং বীজ থেকে বীজের দূরত্ব হবে ১০ ইঞ্চি। এজন্য জাতভেদে হেক্টরপ্রতি বীজ দরকার ১০-১২ কেজি। বীজবপনের আগে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে বীজত্বক নরম করে নেওয়া উত্তম। যে কোনো তেল ফসলের মানসম্পন্ন বীজ ও তেল পেতে জৈব ও অন্যান্য রাসায়নিক সারের পাশাপাশি জমিতে জিপসাম ও বোরন ব্যবহার করা জরুরি। সূর্যমুখীর ক্ষেত সবসময় আগাছামুক্ত রাখতে হবে। চারা প্রতিষ্ঠালাভের পর একই স্থানে একটি সবল চারা রেখে বাকিগুলো তুলে ফেলতে হয়। লাইনের চারার সংখ্যা কম হলে অতিরিক্ত চারা দিয়ে সে স্থান পূরণ করা জরুরি। কাজটি বিকাল বেলা করা উচিত। রোপণকৃত চারার গোড়ায় কয়েকদিন পানি দিতে হবে। রবি মৌসুমে সূর্যমুখীর জমিতে সেচের প্রয়োজন হয়। খরিফ মৌসুমে জলাবদ্ধতা দেখা দিলে নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। মৌসুম ও জাতভেদে ফসলের জীবনকালের ভিন্নতা রয়েছে। তাই পরিপক্ব হয়েছে তখনই বুঝতে হবে; যখন পাতাগুলো হলদে হয়ে যায়, মাথাসহ গাছ নুয়ে পড়ে, দানাগুলো পুষ্ট ও শক্ত হয়ে কালো বর্ণ ধারণ করে। ওই সময় ফসল সংগ্রহ করতে হবে।

লেখক: নাহিদ বিন রফিক: টেকনিক্যাল পার্টিসিপেন্ট, কৃষি তথ্য সার্ভিস,

আঞ্চলিক কার্যালয়, খামারবাড়ি, বরিশাল।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে