শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষি অর্থনীতির নতুন সম্ভাবনা 'কাজু বাদাম'

কাজু বাদামের বীজ এবং কলম উভয় পদ্ধতিতেই বংশ বিস্তার করা যায়। চারা লাগানোর তিন থেকে চার বছরের মধ্যে ফল ধরে। এ বাদাম গাছ ৬০-৭০ বছর পর্যন্ত বাঁচে এবং ৫০-৬০ বছর পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। পূর্ণবয়স্ক গাছ ১০ থেকে ১২ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। ফেব্রম্নয়ারি-মার্চে ফুল ধরে। ফল সংগ্রহ করা হয় মে মাসে। এতে রোগ-বালাইও কম এবং পানি ও পরিচর্যাও কম লাগে। আর এক একটি গাছে জাত ভেদে ৪ থেকে ৪০ কেজি পর্যন্ত বাদাম হয়। সাধারণত পেকে নিচে পড়ে গেলে সংগ্রহ করে শুকানো হয়। আর শুকালে ১ বছর রাখা সম্ভব। বেলে দো-আঁশ মাটি, পাহাড়ের ঢালে ভালো জন্মে। কাজু বাদামের উৎপত্তিস্থল মধ্য আমেরিকা এবং উত্তর-দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর-পূর্ব ব্রাজিল। বর্তমানে প্রধানত ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত, কেনিয়া, মোজাম্বিক, তানজানিয়া, মাদাগাস্কারসহ অনেক দেশে কাজু বাদাম উৎপাদন হয়। আমদানিনির্ভর এ ফলটি কৃষিতে নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে। বাধা শুধু সংরক্ষণে আর প্রসেসিং বা উৎপাদনের পর খাওয়ার উপযোগী করে প্রস্তুতকরণে। উৎপাদন ও চাষাবাদ যে হারে বাড়ছে তাতে খুব শিগগিরই পাহাড়ি অঞ্চলে কাজু বদামের ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠবে
ইমরান সিদ্দিকী
  ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

কিডনি আকৃতির বীজ কাজু বাদাম, গন্ধ ও স্বাদে মিষ্টি-জাতীয়। ওজন হ্রাস, রক্তে শর্করার নিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্যকর হৃদয় গঠন, ডায়াবেটিস ও ক্যানসার প্রতিরোধ, ত্বক ও চুলের সুরক্ষায় এটি এক দারুণ পুষ্টিকর খাবার। দেশের সম্ভাবনাময় রপ্তানি পণ্যের তালিকায় বাদাম জাতীয় ফসলে কাজু বাদাম শীর্যে রয়েছে। এ ফসলের যেমন রয়েছে অর্থনৈতিক গুরুত্ব তেমনি রয়েছে পুষ্টিগুণও- যা স্বাস্থ্যের জন্য বেশ চমকপ্রদ। কাজু বাদাম হৃৎপিন্ডের জন্য শক্তিদায়ক, ডায়াবেটিক রোগের জন্য উপকারী, হজমে সহায়ক, ক্যানসার প্রতিরোধে সাহায্য করে, পিত্তথলি ও কিডনিতে পাথর তৈরিতে বাধা দেয়, রক্ত শূন্যতায় কাজ দেয়, হাঁড় ও দাঁত গঠনে সাহায্য করে, বস্নাড প্রেসার কমায়, অবসাদ দূর করে ভালো ঘুম আনয়নে সাহায্য করে।

কাজু বাদাম একটি বাদাম জাতীয় ফল। এটি একটি উষ্ণমন্ডলীয় ফল। বৃক্ষ জাতীয় ফসলের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কাজু বাদামের স্থান তৃতীয়। বর্তমানে কাজু বাদামের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য রয়েছে প্রায় ১৪.৯ বিলিয়ন ডলার- যেখানে ভিয়েতনাম এককভাবে ৪ বিলিয়ন ডলারের কাজু বাদাম রপ্তানি করে থাকে। বাংলাদেশে বর্তমানে ভিয়েতনাম ও ভারত কাঁচা কাজু বাদাম রপ্তানি করেছে মাত্র ৩ দশমিক ৫৭ লাখ ডলারের, সেখানে প্রস্তুত বাদাম আমদানিই করেছে ভিয়েতমান থেকে ৮৫৭ টন। ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, সিলেট ও রংপুর অঞ্চলে কাজু বাদাম চাষের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। এ গাছের একটি বৈশিষ্ট এটি মাটিকে আকরে ধরে রাখে ফলে ভূমিক্ষয় অনেকাংশে রোধ হয়। কাজু বাদাম হতে পারে অর্থনৈতির নতুন সম্ভাবনা। অনাবাদি জমিতে পরিকল্পিতভাবে কাজু বাদাম চাষের যথেষ্ট সুযোগ আছে। বাদামজাতীয় ফসলের মধ্যে কাজু বাদাম প্রথম স্থানে। আমাদের দেশে এক কেজি প্রক্রিয়াজাত করা প্যাকেটজাত কাজু বাদামের মূল্য প্রায় ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা।

দেশের পাহাড়ি অঞ্চলকে কাজু বাদাম চাষ সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের দ্বার বলা যায়। দেশের এক দশমাংশ এলাকাজুড়ে এ পার্বত্য অঞ্চল রয়েছে। এ অঞ্চলের আবহাওয়া জলবায়ু মাটি সবই কাজু বাদাম চাষের জন্য বেশ উপযোগী। দেশে যে পরিমাণ কাজু বাদাম উৎপন্ন হয় তার অর্ধেক আসে বান্দরবান পার্বত্য জেলা থেকে। কাজু বাদাম পচনশীল নয় বলে পাহাড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও চাষ করার সুযোগ রয়েছে। কাজু বাদামের কদর বাড়ছে দিনে দিনে। দীর্ঘ ২০ থেকে ৩০ বছর আগে থেকেই এই কাজু বাদাম পাহাড়ে চাষ হয়ে আসছে অনেকটা অবহেলিত অবস্থায়। এখন এর চাহিদা বেড়ে এখন আকাশচুম্বী। আন্তর্জাতিক বাজারেও এর চাহিদা ব্যাপক। ফলে রপ্তানির একটা অমিত সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু বিশ্ববাজারে রপ্তানি করতে হলে এর গুণগতমান ঠিক রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে কাজু বাদামের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।

পাহাড়ি এলাকায় অনাবাদি বা পতিত জমিতে কাজু বাদাম চাষের সম্ভাবনা দেখে কৃষি মন্ত্রণালয় কাজু বাদামের আবাদ বাড়াতে মাঠপর্যায়ে কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও সহায়তা দিচ্ছে। প্রক্রিয়াজাত কারখানার উদ্যোক্তাদের নীতিসহায়তাও দিচ্ছে মন্ত্রণালয়। উদ্যোক্তারা আশা করছেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী আবাদ এবং কারখানা গড়ে তোলা গেলে রপ্তানি আয়ে ভালো সম্ভাবনা দেখাবে এই অপ্রচলিত কৃষিপণ্য। কাজু বাদামের উৎপাদন একদিকে যেমন অর্থনীতিতে সমৃদ্ধি আনবে তেমনি কাজু বাদাম খাওয়ার মাধ্যমে মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোগ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। কাজু বাদামের দুটি অংশ। কাজু যাকে আপেল বলা হয় আর অন্যটি বাদাম যা দেখতে অনেকটা মানুষের কিডনির মতো। আপেল সরাসরি খাওয়া যায়। বাদাম প্রক্রিয়াজাত করে খাওয়ার উপযোগী করা হয়। লাভের দিক বিবেচনা করলে কাজু বাদাম একটি লাভজনক ফসল। কাজু বাদাম শুধু বাদাম নয়। এর বহুমাত্রিক ব্যবহার বিদ্যমান। দামের খোসা থেকে উৎপাদিত তৈল দিয়ে উৎকৃষ্টমানের জৈব বালাইনাশক, ভিনেগার, এলকোহল তৈরি করা যায়। বাদামের সঙ্গে লাগোয়া উপরের ফল থেকে জুস তেরি করা হয়। যার গড় বাজারমূল্য প্রতি কেজি ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা। আর খোসাযুক্ত বাদামের কৃষক পর্যায়ে মূল্য ৫০ থেকে ৬০ টাকা।

কাজু বাদামের বীজ এবং কলম উভয় পদ্ধতিতেই বংশ বিস্তার করা যায়। চারা লাগানোর তিন থেকে চার বছরের মধ্যে ফল ধরে। এ বাদাম গাছ ৬০-৭০ বছর পর্যন্ত বাঁচে এবং ৫০-৬০ বছর পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। পূর্ণবয়স্ক গাছ ১০ থেকে ১২ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। ফেব্রম্নয়ারি-মার্চে ফুল ধরে। ফল সংগ্রহ করা হয় মে মাসে। এতে রোগ-বালাইও কম এবং পানি ও পরিচর্যাও কম লাগে। আর এক একটি গাছে জাত ভেদে ৪ থেকে ৪০ কেজি পর্যন্ত বাদাম হয়। সাধারণত পেকে নিচে পড়ে গেলে সংগ্রহ করে শুকানো হয়। আর শুকালে ১ বছর রাখা সম্ভব। বেলে দো-আশঁ মাটি, পাহাড়ের ঢালে ভাল জন্মে। কাজু বাদামের উৎপত্তিস্থল মধ্য আমেরিকা এবং উত্তর দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর পূর্ব ব্রাজিল। বর্তমানে প্রধানত ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত, কেনিয়া, মোজাম্বিক, তানজানিয়া, মাদাগাস্কারসহ অনেক দেশে কাজু বাদাম উৎপাদন হয়। আমদানিনির্ভর এ ফলটি কৃষিতে নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে। বাধা শুধু সংরক্ষণে আর প্রসেসিং বা উৎপাদনের পর খাওয়ার উপযোগী করে প্রস্তুতকরণে। উৎপাদন ও চাষাবাদ যে হারে বাড়ছে তাতে খুব শিগগিরই পাহাড় অঞ্চলে কাজু বদামের ইন্ডাস্ট্রি গড়ে ওঠবে।

২০২০ সালের উৎপাদন হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে কাজু বাদামের ফলন প্রতি হেক্টরে ১ দশমিক ৩২৩ টন। ২০২২ সালে বিশ্বের শীর্ষ প্রক্রিয়াজাত কাজু বাদাম রপ্তানিকারক দেশ হচ্ছে ভিয়েতনাম এবং শীর্ষ আমদানিকারক দেশ আমেরিকা। আফ্রিকার দেশগুলো বছরে প্রায় ২৫ লাখ টন কাঁচা কাজু বাদাম উৎপাদন করে কিন্তু প্রক্রিয়াজাতের তেমন আধুনিক ব্যবস্থা না থাকায় উৎপাদিত কাঁচা কাজু বাদামের ৯০ শতাংশই রপ্তানি করে।

পাকা ফল গাছ থেকে ঝরে পড়লে সেখান থেকে বীজ সংগ্রহ করা বেশ ভালো। এপ্রিল-মে মাসে পাকা ফলের বাদাম সংগ্রহ করে ৩-৪ দিন রোদে শুকিয়ে নিতে হয়। শুকনো বীজ ২৪-৩৬ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে অংকুরিত বীজ জুন মাসে বপন করলে অংকুরোদগম বেশি হয়। জুলাই- অক্টোবর মাস পর্যন্ত কলম করা যায়। ২-৬ মাসের চারাকে আদি জোড় হিসেবে নেয়া হয়। কাঙ্ক্ষিত গাছের সায়ন ফাটল জোড় পদ্ধতিতে স্থাপন করে নতুন চারা তৈরি করা যায়। জুন-আগষ্ট মাস চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। মে-জুন মাসে প্রথমবার এবং সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের দ্বিতীয়বার গাছের গোড়ায় রিং পদ্ধতিতে সার প্রয়োগ করতে হবে। ১ বছর বয়সি গাছের গোড়ায় ২ বারে গোবর বা জৈবসার ১০ কেজি, ইউরিয়া সার ২৫০ গ্রাম, টিএসপি ২০০ গ্রাম এবং পটাশ ১৫০ গ্রাম প্রয়োজন। পরবর্তী সময়ে ২য় বছরে ১ম বছরের দ্বিগুণ, ৩য় বছরে তিনগুণ, ৪র্থ বছরে চারগুণ এভাবে সারের মাত্রা বাড়াতে হবে। তবে কাঙ্ক্ষিত ফলনের জন্য গাছের চাহিদামতো যুক্তিসংগত মাত্রায় সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন।

খাদ্য মানের দিক দিয়ে কাজু বাদাম অতি পুষ্টিকর এবং স্বাস্থ্যকর। এ বাদামে শতকরা ২১ ভাগ আমিষ, ৪৭ ভাগ স্নেহ, ২২ ভাগ শকর্রা, ২.৪ ভাগ খনিজ পদার্থ, ০.৪৫ ভাগ ফসফরাস, ০.৫৫ ভাগ ক্যালসিয়াম এবং প্রতি ১০০ গ্রাম বাদামে ৫ মিলিগ্রাম লৌহ ৭৩০ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি-১, ১১০ মিলিগ্রাম রাইবোফ্লোবিন রয়েছে। প্রচুর শকর্রা, আমিষ, স্নেহ, খনিজ পদার্থ, ভিটামিনসহ অন্যান্য উপকারী অনেক ফাইটো ক্যামিক্যালস রয়েছে- যা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। কাজু বাদামের খোসা থেকে উৎপাদিত তেল দিয়ে উৎকৃষ্টমানের জৈব বালাইনাশক উৎপাদন করা যায়। যা নিরাপদ ফসল এবং খাদ্য উৎপাদনে অত্যন্ত জরুরি। অপরদিকে মানবদেহ এবং পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর রাসায়নিক কীটনাশক আমদানি করতে হবে না বরং আমদানি প্রতিহত করে হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করবে। বাদামের খোসার তৈল শিল্প কাজে ব্যবহৃত মূল্যবান দ্রব্য। পেইন্টিং ফ্যাক্টরির মূল্যবান কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, কৃষিপণ্য বহুমুখীকরণের যে পদক্ষেপ সরকার নিয়েছে, তাতে কাজু বাদামকে সম্ভাবনাময় ফসল হিসেবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয় কাজু বাদাম আবাদের জন্য চারা লাগানোসহ কৃষকদের সহায়তা করছে। আবার প্রক্রিয়াজাত কারখানার জন্য উদ্যোক্তাদের নীতিগত সহায়তা দিচ্ছে। কাজু বাদাম আবাদ বৃদ্ধির জন্য ভিয়েতনাম থেকে উচ্চফলনশীল জাতের চারা আমদানির করা হবে। প্রক্রিয়াজাতসহ অন্যান্য সমস্যা সমাধানে সরকার সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। প্রয়োজনে খামারিদের বিদেশে অভিজ্ঞতা অর্জন ও প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করা হবে। ভিয়েতনামের উন্নজাতের চারা আমদানির ক্ষেত্রে প্রয়োজনে আর্থিক প্রণোদনা দেয়া হবে। ভিয়েতনাম ১৯৮৮ সালে কাজু বাদাম চাষ শুরু করে এবং ১৯৯৮ সালে বাণিজ্যিক চাষে গিয়ে আজ তারা বিশ্বে এক নাম্বার হলে আমরা কেন পারব না। বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার কৃষির জন্য যা যা করার সব করবে। কৃষিপণ্যটি রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্ভাবনাময় রপ্তানি পণ্যের তালিকায় উঠে এসেছে এই কৃষিপণ্যটি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে