শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

হলুদ চাষে লাভ বেশি খরচ ও পরিশ্রম কম

হলুদের জমি আগাছামুক্ত রাখতে হবে, সেক্ষেত্রে জমির অবস্থা বুঝে ৩-৪ বার আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে। পানি নিষ্কাশন এবং রাইজোমের সঠিক বৃদ্ধির জন্য ২-৩ বার হলুদের দুই সারির মাঝে থেকে মাটি তুলে গাছের গোড়ায় দিতে হবে এতে কন্দের বৃদ্ধি ভালো হবে।
আলতাব হোসেন
  ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

মসলা ফসলের মধ্যে হলুদ একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। আমাদের প্রতিদিনের রান্নায় হলুদের ব্যবহার হয় সবচেয়ে বেশি। মসলা হিসেবে ব্যবহার ছাড়াও অনেক ধরনের প্রসাধনী কাজে, রূপচর্চার ক্ষেত্রেও হলুদের নানাবিধ ব্যবহার রয়েছে। এটি এমনই একটি ফসল- যার চাহিদা থাকে সারা বছরই। কাটা সাড়াতেও চুন-হলুদ ম্যাজিকের মতো কাজ করে, পাশাপাশি রয়েছে আরও নানান ঔষধি গুণ। রং শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে হলুদ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ৪৫ হাজার ৫ শত ৫০ একর জমিতে ৭ লাখ ৭ হাজার ৩০০ টন হলুদ উৎপন্ন হয়। যা চাহিদার তুলনায় কম। ফলন কম হওয়ার মূল কারণ উচ্চফলনশীল জাত এবং উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতির অভাব। উচ্চফলনশীল জাত এবং উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি ব্যবহার করা হলে হলুদের ফলন দ্বিগুণেরও বেশি করা সম্ভব। দেশে টাঙ্গাইল, রাজশাহী, নওগাঁ, পাবনা, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, ময়মনসিংহ, নীলফামারী ও পার্বত্য জেলাগুলোতে হলুদের ব্যাপক চাষাবাদ হয়। হলুদ বিশেষত উষ্ণ এলাকার ফসল। উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়াতে হলুদ খুব ভালো জন্মায়। যেসব স্থানে রোদ বেশি সেইসব এলাকায় হলুদের কন্দ ভালো হয়। প্রায় সব ধরনের মাটিতেই হলুদ চাষ করা যায়। তবে উর্বর দো-আঁশ মাটি বা বেলে দো-আঁশ মাটি হলুদ চাষের জন্য বেশি উপযোগী। পাশাপাশি আপনি চাইলে হলুদকে সাথী ফসল হিসেবেও চাষ করতে পারেন।

বছরে তারপরেও আমদানি করতে হয় ৭০ হাজার টন হলুদ। মসলা ফসলের মধ্যে হলুদ একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য। এতে আমিষ, চর্বি এবং প্রচুর ক্যালসিয়াম, লৌহ ও ক্যারোটিন থাকে। প্রতিদিনের রান্নায় হলুদের ব্যবহার হয় সবচেয়ে বেশি। মসলা হিসেবে ব্যবহার ছাড়াও অনেক ধরনের প্রসাধনী কাজে ও রং শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে হলুদ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এছাড়া পাকস্থলীর গ্যাস, মূত্রনালির রোগ ও ব্যথা নিবারণে এবং ক্ষত শুকানোসহ নানা সমস্যায় ব্যবহৃত হয় ভেষজগুণের এই হলুদ। কাঁচা হলুদ খেলে চর্মরোগ দূর হয়। গরম চুন ও হলুদ মিশ্রণের প্রলেপ ব্যথা কমায়। হলুদ রক্ত পরিষ্কার করে এবং হজমে সহায়তা করে। গ্যাসজনিত কারণে পেটের ব্যথা হলে ও বাতজনিত রোগ সারাতে হলুদ ব্যবহার হয়। হলুদ হলো লাভজনক ফসল। দিন যতই যাচ্ছে, এখানে হলুদের চাষ ততই বাড়ছে। হলুদ চাষে কোনো ঝুঁকি নেই। খরচও কম লাগে। খেতে কোনো পোকা আক্রমণ করে না। পরিচর্যাও তেমন করা লাগে না। ডিমলা ও সিন্দুরী নামে বাংলাদেশে দু'টি উন্নত জাত রয়েছে। ডিমলা জাতটি স্থানীয় জাতের তুলনায় ৩ গুণ ফলন বেশি দেয়। সাধারণত লাগানোর ৯-১০ মাস পর পাতা শুকিয়ে গেলে হলুদ সংগ্রহ করা হয়। প্রতি হেক্টরে ২৫-৩০ টন কাঁচা হলুদ পাওয়া যায়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩৯ হাজার ৩০৭ হেক্টর জমি চাষ করে ২ লাখ ১৯ হাজার ৫৮০ টন হলুদ উৎপাদন করা হয়। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরের হিসেবে দেশে ৮২ একর জমিতে হলুদ চাষ করে উৎপাদন হয় ২ লাখ ৮৬ হাজার টন। বর্তমানে বছরে দেশের মানুষের চাহিদা পূরণে লাগে ২ লাখ ২৪ হাজার টন হলুদ। এ হিসেবে দেশে ৫ হাজার টন হলুদ উদ্বৃত্ত থাকার কথা। কিন্তু সংগ্রহের সময় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ অপচয়ের কারণে ঘাটতি থেকে যায় প্রায় ৭০ হাজার টন হলুদ। অথচ সঠিক পরিকল্পনায় প্রতি ইঞ্চি জমির সুষ্ঠু ব্যবহারে উন্নত জাতের হলুদ চাষে সহজেই এ চাহিদা পূরণ করা যায়।

কৃষিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের আয়তনের এক-দশমাংশ স্থান দখল করে রেখেছে বসতবাড়ি। দেশের প্রায় প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় রয়েছে বহুবর্ষী বৃক্ষ। একে বহুবিধ ব্যবহারের আওতায় আনতে হলুদ চাষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এসব স্থান ছায়াযুক্ত হওয়ায় অন্য ফসল চাষ করা অসম্ভব, সেখানে হলুদ চাষ করা যায় অনায়াসে। এদিকে অধিক জনসংখ্যার চাপে দিনদিন আবাদি জমি কমছে। এ প্রেক্ষাপটে জমির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি। এরই প্রেক্ষিতে স্বল্প পরিশ্রমে অল্প খরচে, পানি জমে থাকে না, এমন ছায়াযুক্ত স্থানে অতি সহজে হলুদ চাষ করা সম্ভব। ছায়াযুক্ত পরিবেশে দেশি বা উন্নত জাতের হলুদ চাষ করা যায়। তবে উন্নত জাতের হলুদ চাষে ফলন বেশি হয় এবং তাতে আয়ও বেশি হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, নানা জাতের হলুদ রয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট দুইটি জাতের হলুদ উদ্ভাবন করেছে। এ দু'টি জাত ডিমলা ও সুন্দরী। এ দু'টি জাতের চাষাবাদ পদ্ধতি প্রায় একই রকমের চৈত্র মাসের শুরু থেকে বৈশাখের মাঝামাঝি পর্যন্ত হলুদ বীজবপন করা যায়। কৃষকদের মতে ৬শ' থেকে ৭শ' টাকা খরচে প্রতি শতাংশ জমিতে হলুদ চাষ করা সম্ভব। ফলন হয় ৩ থেকে ৪ মণ। কাঁচা হলুদ জমি থেকে সংগ্রহ করার পর বাজারে বিক্রি করলে প্রতিমণ হলুদ বিক্রি হয় ৮শ' থেকে ১২শ' টাকা। কিন্তু একই হলুদ ধান সিদ্ধ করে চাল প্রক্রিয়াজাত করার মতো শুকানো হলে প্রতিমণ হলুদ বিক্রি হয় ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। এতে লাভবান হওয়ায় কাঁচা হলুদ বিক্রি না করে শুকানোর প্রতি মনোযোগ বেশি হলুদ চাষিদের।

হলুদের গ্রাম বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার গরিবপুরের মানুষ এখন আর গরিব নেই। হলুদ চাষ করে অনেক পরিবারেই ফিরে এসেছে আর্থিক সচ্ছলতায়। কেউ নিজের জমিতে হলুদ চাষ করছে, আবার যাদের জমি নেই তারা কাঁচা হলুদ কিনে এনে সিদ্ধ করে শুকিয়ে বাজারে বিক্রি করছে। হলুদের ব্যবসা করে তারা এখন আর্থিকভাবে সচ্ছল। রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আড়ানিতে গড়ে উঠেছে শতাধিক চাতাল। দিন-রাত এসব চাতালে চলছে কাঁচা হলুদ প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজ। চাতালে ভালো মানের কাঁচা হলুদ প্রতিমণ ৮০০ থেকে ১২শ' টাকায় কেনা হয়। শুকানোর পরে সেগুলো বিক্রি হয় ৪ থেকে ৫ হাজার টাকায়। কাঁচা হলুদ কেনা, সিদ্ধ, শুকানো ও অন্যান্য প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন শ' শ' কৃষক-কৃষানি। হলুদের সোনা রঙে জীবনের রং বদলে যাচ্ছে তাদের।

ভালো ফলনের জন্য গভীরভাবে ৪ থেকে ৫টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে এবং আগাছা পরিষ্কার করে ঢেলা ভেঙে ভালোভাবে জমি তৈরি করে নিতে হবে। হলুদ খরিপ মৌসুমে রোপণ করা হয়। মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত রোপণ করা ভালো। বীজবপন করার আগে বীজ শোধন করে নিলে খুব ভালো। তাহলে হলুদের কন্দ পচা রোগ থেকে রক্ষা পাবে। বীজ শোধন করার আগে এক লিটার পানিতে ২০ গ্রাম ব্যাভিস্টিন বা ডারথেন এম ছত্রাকনাশক গুলে নিতে হবে। তারপর তাতে হলুদের কন্দ ভিজিয়ে রাখতে হবে। ৩০ মিনিট ভিজিয়ে রাখার পর সেগুলো পানি থেকে তুলে নিতে হবে এবং শুকোতে হবে ছায়ার মধ্যে। তবেই এগুলো জমিতে রোপণের উপযোগী হবে। বীজ সারিতে বপন করতে হবে। এক সারি থেকে আর এক সারির দূরত্ব হবে ৫০ সেমি, এক বীজ থেকে আর এক বীজের দূরত্ব হবে ২৫ সেমি। বীজ ৫ থেকে ৬ সেমি গভীরে রোপণ করতে হবে। সাধারণত এক হেক্টর জমিতে ২৫০০ কেজি কন্দ প্রয়োজন হয়ে থাকে। কন্দ লাগানোর পর ভেলী দিতে হবে।

উন্নত ফলন পেতে হলে জমির উর্বরতা অনুযায়ী সার প্রয়োগ করতে হবে। এক্ষেত্রে এক হেক্টর জমিতে গোবর দিতে হবে ৪-৬ টন, ইউরিয়া দিতে হবে ২০০-২৪০ কেজি, টিএসপি দিতে হবে ১৭০-১৮০ কেজি, এমওপি দিতে হবে ১৬০-১৮০ কেজি, জিপসাম দিতে হবে ১০৫-১২০ কেজি। জমি তৈরি করার সময় গোবর সার, টিএসপি ও জিপসাম মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। জমিতে কন্দ লাগানোর ৫০-৬০ দিন পর ১০০-১২০ কেজি ইউরিয়া প্রয়োগ করে দিতে হবে। প্রয়োজনে ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগ করার পর জমির মাটি হালকাভাবে কুপিয়ে দিতে হবে। বীজবপন করার ৯-১০ মাস পর হলুদ গাছের পাতা শুকিয়ে যাওয়ার পর হলুদ সংগ্রহ করা যায়। সাধারণত জানুয়ারি মাসের শেষ হতে মার্চ মাসের প্রথম পর্যন্ত হলুদ সংগ্রহ করা যায়। ঠিক উপায়ে চাষ করতে পারলে সাধারণত এক হেক্টর জমি থেকে ২৫-৩০ টন কাচা হলুদ পাওয়া যায়। প্রতি ১০০ কেজি কাঁচা হলুদ থেকে ২৫-৩০ কেজি করে শুকনা হলুদ পাওয়া যায়।

এরপর লৌহ অথবা মাটির পাত্রে ফুটন্ত পানিতে ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা হলুদগুলো সিদ্ধ করতে হবে। অতিরিক্ত সিদ্ধ করলে রং নষ্ট হয় এবং কম সিদ্ধ করলে হলুদ ভঙ্গুর হয়। সিদ্ধ হলুদগুলোকে একটি পাত্রে রেখে, ২ থেকে ৩ ইঞ্চি উপর পর্যন্ত পানি দ্বারা পূর্ণ করতে হবে। এই পানিতে চুন বা সোডিয়াম কার্বোনেট বা সোডিয়াম বাইকার্বোনেট মিশিয়ে অ্যালকালাইন দ্রবণ তৈরি করতে হবে। এখন হলুদগুলোকে পাত্র থেকে তুলে নিয়ে ২০ গ্রাম সোডিয়াম বাইসালফেট ও ২০ গ্রাম হাইড্রোক্লোরিক এসিডের জলীয় দ্রবণে ১৫ মিনিট যাবত ভিজিয়ে রাখার পর দ্রবণ থেকে ছেঁকে নিয়ে রোদে শুকানোর ব্যবস্থা করতে হবে। হলুদ ঠিকমতো সিদ্ধ হবে তখন, যখন আঙুল দিয়ে টিপলে নরম মনে হয় এবং ভোতা কাঠের টুকরো দিয়ে ছিদ্র করা যায়। হলুদ রাইজোমগুলোকে সিদ্ধ করার পরপরই রোদে শুকানো উচিত। সিদ্ধকৃত রাইজোমকে ৫ থেকে ৭ ইঞ্চি পুরু করে মোটা বাঁশের চাটাই অথবা মেঝের উপর ১০ থেকে ১৫ দিন পর্যন্ত শুকানো হয়। সন্ধ্যার পূর্বেই হলুদকে ঢেকে রাখা দরকার। চূড়ান্ত পর্যায়ে হলুদের আদ্রতা ৫ থেকে ১০ ভাগে এ নিয়ে আসতে হবে। হাত দিয়ে ভাঙলে যদি কট? করে শব্দ হয় তাহলে বোঝা যাবে হলুদ পুরোপুরি শুকিয়েছে।

হলুদের জমি আগাছামুক্ত রাখতে হবে, সেক্ষেত্রে জমির অবস্থা বুঝে ৩-৪ বার আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে। পানি নিষ্কাশন এবং রাইজোমের সঠিক বৃদ্ধির জন্য ২-৩ বার হলুদের দুই সারির মাঝে থেকে মাটি তুলে গাছের গোড়ায় দিতে হবে এতে কন্দের বৃদ্ধি ভালো হবে। মাটি শুষ্ক হলে হালকা সেচ দিতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে পানি কোনোভাবেই জমিতে না জমে থাকে। জমে থাকা পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। জমিতে রস সংরক্ষণ এবং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য মালচিং (শুকনো পাতা বা খড়) দিতে হবে। এতে করে আগাছার পরিমাণও কম হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে