শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষিতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার

কৃষি তথ্য সার্ভিস থেকে পরিচালিত 'কৃষিকল সেন্টার' থেকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ১৬১২৩ নম্বরে ফোন করে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে যে কেউ কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিষয়ক সমস্যার সমাধান পেতে পারেন। শুক্রবার ও সরকারি ছুটির দিন ছাড়া সপ্তাহের অন্যান্য দিন সকাল ৯টা থেকে ৫টা পর্যন্ত এই সেবা পাওয়া যায়। অন্যদিকে, তৃণমূল পর্যায়ে তথ্য বিস্তারের জন্য সরকারিভাবে কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এখান থেকে কৃষক ও কৃষি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তথ্যসেবা গ্রহণ করতে পারেন।
প্রফেসর আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ
  ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

আধুনিক লাগসই প্রযুক্তি কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে ই-কৃষি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ই-কৃষি হলো- ইলেকট্রনিক প্রবাহের মাধ্যমে কৃষি বিষয়ক তথ্য সরবারহের একটি আধুনিক প্রক্রিয়া। যেখানে ইন্টারনেট, রেডিও, টেলিভিশন ও মোবাইল ফোন ইত্যাদি ইলেকট্রনিক যন্ত্রের মাধ্যমে দ্রম্নততার সঙ্গে কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য নির্ভরযোগ্যভাবে কৃষক, সম্প্রসারণকর্মী, ভোক্তা এবং সংশ্লিষ্ট সবার কাছে পৌঁছে দেয়া যায়।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট কৃষকের জন্য বিনামূল্যে অনলাইন সার সুপারিশ সেবা চালু করেছে। ফসলের প্রয়োজন অনুযায়ী সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগের লক্ষ্যে একটি অনলাইন ফার্টিলাইজার রিকমেন্ডেশন সিস্টেম উদ্ভাবন করে এই প্রতিষ্ঠানটি। এই সফটওয়্যার ব্যবহার করে মাটির পুষ্টিমানের তথ্য, ফসলের পুষ্টি চাহিদা ও সারে পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ বিশ্লেষণ করে সার প্রয়োগের নির্দেশনা পাবে কৃষক। এর ফলে ফসলভেদে ২০ থেকে ৩০ ভাগ ফলন বাড়বে। মাটি ও গাছের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে। রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ কম হবে এবং উৎপাদন খরচ হ্রাস পাবে।

তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষক কীভাবে লাভবান হতে পারেন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো- আলুর নাবীধসা রোগে আবহাওয়ার পূর্বাভাস প্রদান। নাবীধসা আলুর একটি মারাত্মক রোগ- যার দরুন প্রতি বছর আলু ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। শীতকালে ঘনকুয়াশা পড়লে বা আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে এই রোগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে এবং দুয়েএক দিনের মধ্যে সম্পূর্ণ ফসল বিনষ্ট হয়ে যায়। প্রতিষেধক ব্যবস্থা হিসেবে বিভিন্ন ছত্রাকনাশক স্প্রে করে এই রোগ থেকে আলুকে রক্ষা করা যায়। এ রোগ দমনের জন্য আলু চাষিদের মোবাইল ফোনে ক্ষুদে বার্তা প্রেরণের মাধ্যমে এবং আবহাওয়ার পূর্বাভাস প্রদান করে ক্ষতি থেকে রক্ষা করা যায়। ঠিক একইভাবে আমরা আম, লিচু, কলা ও তরমুজসহ বিভিন্ন ফল, শাকসবজি ও দানা ফসল, মাছ, ডিম, মাংস ও দুধ উৎপাদন বৃদ্ধিতে ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, স্মার্টফোন, ট্যাব, রেডিও এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ব্যবহার করে কৃষির টেকসই উন্নয়নে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি। নানাবিদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেমন ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব প্রভৃতির মাধ্যমে আমরা কৃষি বিষয়ক তথ্য তরুণ সমাজের কাছে ছড়িয়ে দিতে পারি। এজন্য এসব ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি কৃষকের কাছে সহজলভ্য হতে হবে এবং এগুলোর ব্যবহার সম্পর্কে কৃষক ভাইদের যথেষ্ট জ্ঞান ও দক্ষতা থাকতে হবে।

কৃষি তথ্য সার্ভিস থেকে পরিচালিত 'কৃষিকল সেন্টার' থেকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ১৬১২৩ নম্বরে ফোন করে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে যে কেউ কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিষয়ক সমস্যার সমাধান পেতে পারেন। শুক্রবার ও সরকারি ছুটির দিন ছাড়া সপ্তাহের অন্যান্য দিন সকাল ৯টা থেকে ৫টা পর্যন্ত এই সেবা পাওয়া যায়। অন্যদিকে, তৃণমূল পর্যায়ে তথ্য বিস্তারের জন্য সরকারিভাবে কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এখান থেকে কৃষক ও কৃষি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তথ্যসেবা গ্রহণ করতে পারেন। বর্তমানে বাংলাদেশের সব কৃষি বিষয়ক সরকারি প্রতিষ্ঠানের বাংলায় ওয়েবসাইট রয়েছে। এসব ওয়েবসাইট থেকে সংশ্লিষ্ট কৃষির বিভিন্ন বিষয়ে প্রযুক্তিগত তথ্য সারাদেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে যে কেউ বিনামূল্যে সংগ্রহ করতে পারেন। যেমন, বিএডিসি'র ওয়েবসাইট থেকে আমরা বীজ, সার ও সেচ সংক্রান্ত নানাবিদ তথ্য ও সেবা পেতে পারি। কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষি পণ্যের প্রতিদিনের বাজারদরের তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়াও কৃষির নানাবিদ বিষয়ভিত্তিক অ্যাপস রয়েছে, যেগুলো থেকে কৃষকরা তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য ও সেবা পেতে পারেন। বর্তমানে ইউনিয়ন পর্যায়ে ই-কৃষি সেবা কার্যক্রম সম্প্রসারিত হয়েছে। সরকারি ই-কৃষি সেবাগুলোর মধ্যে রয়েছে কৃষি তথ্য যোগাযোগ কেন্দ্র, কৃষি আলাপনি, কমিউনিটি রেডিও, প্রমোশনান টিভি ও রেডিও অনুষ্ঠান, ভিডিও কনফারেন্সিং প্রভৃতি।

বর্তমানে সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি নানাবিধ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কৃষিতে তথ্যপ্রযুক্তি সেবা প্রদান করে আসছে। দেশে কৃষির উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগ, প্রসার ও কৃষকের সমস্যা নিয়ে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি রেডিও ও টেলিভিশনে নিয়মিত কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান সম্প্রচার হয়ে আসছে। এসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কৃষকরা কৃষিবিষয়ক নতুন নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে অবগত হচ্ছেন এবং তা মাঠে প্রয়োগ করে উপকৃত হচ্ছেন। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কৃষককে যেসব তথ্যপ্রযুক্তি দিচ্ছে তা কৃষকরা কতটুকু মাঠে প্রয়োগ করছেন তার ওপরই নির্ভর করছে এর সফলতা। তাই তথ্যসেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে কৃষকের চাহিদার বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১২ কোটি ১৮ লাখ মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করছেন। আর ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন ৪ কোটি ২৭ লাখ মানুষ। এর মধ্যে ৪ কোটি ১৩ লাখ মানুষ মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। এ ছাড়া স্মার্ট ফোন ব্যবহারের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। তাই মোবাইল ফোন ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি তথ্যপ্রযুক্তি সম্প্রসারণের বিশাল দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। যেহেতু কৃষি এ দেশের উন্নয়নের চাবিকাঠি এবং প্রায় ৫০ ভাগ মানুষের জীবনজীবিকা এর সঙ্গে জড়িত, তাই গ্রামীণ অর্থনীতিকে বেগবান ও গতিশীল করার জন্য কৃষিতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই।

লেখক: চেয়ারম্যান, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে