সোমবার, ২৭ মার্চ ২০২৩, ১৩ চৈত্র ১৪২৯
walton

হাঁস পালন :কম পুঁজিতে বেশি লাভ

ইমরান সিদ্দিকী
  ০৫ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

হাঁস পালন অপেক্ষাকৃত কম পুঁজিতে বেশি লাভ। বিল, জলাশয় ও নদীতে উন্মুক্ত পানি থাকায় সেখানে হাঁস পালন বাণিজ্যিক রূপ লাভ করেছে। নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, ভোলা, গাইবান্ধা ও সিরাজগঞ্জ জেলার বিভিন্ন গ্রামে হাঁস পালন করে অনেকেই সচ্ছল জীবন ফিরে পেয়েছেন। উন্নত জাতের একটি হাঁস বছরে ৩০০টি পর্যন্ত ডিম দিয়ে থাকে। এ হাঁসের নাম হলো খাকি ক্যাম্ববেল। নদীর তীর, পুকুর পাড় ও আর্দ্র ভূমিতে হাঁস পালন খুবই লাভজনক। হাঁস একটি গৃহপালিত পাখি। দেশের গ্রাম অঞ্চলে অধিকাংশই হাঁস পালন করে থাকে। বাড়িতে হাঁস পালন করা খুবই সহজ। বর্তমানে হাঁস পালন করে অনেক বেকার যুবক তাদের আর্থিক সচ্ছলতা এনেছে।

বাংলাদেশে বছরে হাঁসের উৎপাদন হয় প্রায় পাঁচ কোটি এবং রোগ বালাইয়ের ঝুঁকি কম থাকার পাশাপাশি খাদ্য খরচ কম বলে এ খাতটিকে সম্ভাবনাময় বলে মনে করছেন খামারিরা। গত দু'দশকে যমুনার চর, গোপালগঞ্জ, ভোলা, গাইবান্ধা ও সিরাজগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জের বিস্তৃত হাওড় এলাকায় হাঁস চাষে নীরব বিপস্নব ঘটেছে।

হাঁস মূলত জলচর প্রাণি। এ দেশের আবহাওয়া হাঁস পালনে খুবই উপযোগী। হাঁস পালন করলে একদিকে যেমন আর্থিক সচ্ছলতা এবং অন্যদিকে ডিম ও মাংস উভয়ই পাওয়া যায়। মাছের সঙ্গে হাঁসের চাষ একটি সমন্বিত খামার পদ্ধতি। একে অন্যের সহায়ক। পুকুরে মাছ ও হাঁস পালন পদ্ধতির সমন্বয় ঘটাতে পারলে সীমিত জায়গায় উৎপাদন বেশি পাওয়া যায়। এ চাষ পদ্ধতি সবার জানা থাকলে বাংলাদেশের অনেকেই দ্বিগুণ ফসল ফলাতে পারবেন। অল্প জায়গায় মাছ ও হাঁস পালন পদ্ধতি অনেক উন্নত এ দেশে চালু আছে। তাইওয়ান, হংকং, চীন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ইত্যাদি দেশে এর ব্যাপক প্রসার হয়েছে। হাঁসকে পুকুরে জৈবসার উৎপাদনকারী মেশিন বলা যেতে পারে। মাছ চাষের জন্য পুকুরে হাঁস পালন করলে খুব কম খরচে অনবরত জৈবসার পাওয়া যায়।

বিশ্বে অনেক প্রজাতির হাঁস রয়েছে। এদের জাত যেমন ভিন্ন তেমনি নামও ভিন্ন ভিন্ন। তবে আমাদের দেশেও বেশ কিছু জাতের হাঁস পালন করা হয়ে থাকে। আমাদের দেশে প্রচলিত হাঁসের জাতগুলো হলো খাকি ক্যাম্পেবেল, ইন্ডিয়ান রানার, বেইজিং, সিলেট মিটি ও নাগেশ্বরী ও দেশি হাঁস ইত্যাদি। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলা, ময়ময়নসিংহের শুম্ভুগঞ্জ, কিশোরগজের তাড়াইল থেকে হাঁসের বাচ্চা সংগ্রহ করা যায়। নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় কেন্দ্রীয় হাঁসের খামার, কিশোরগঞ্জ, খুলনার দৌলতপুর হাঁসের খামারসহ বিভিন্ন বেসরকারি হাঁস-খামার থেকে বাচ্চা সংগ্রহ করা যায়। এ ছাড়াও এখন বেশ কয়েকটি বেসরকারি বাচ্চা উৎপাদনকরী প্রতিষ্ঠান হাঁসের বাচ্চা সরবরাহ করছে।

হাঁসের তেলতেলে পালকগুলি তার দেহে চাটুর মতো সাজানো থাকার জন্য গায়ে পানি লাগে না। দেহে পানি না বসার আরো একটা কারণ হলো হাঁসের চামড়ার নিচে আছে চর্বির একটা পর্দা। এই কারণে হাঁস ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানিতে থাকলেও ওদের দেহের নামমাত্রও ক্ষতি হয় না। হাঁসের আরেক বিশেষত্ব ওর পায়ে। পায়ের তিনটি আঙুল একটা পাতলা চামড়ায় মোড়া। নৌকার বৈঠার মতো কাজ করে। আঙুল শেষ নখে। কোনো কোনো জাতের হাঁসের নখ আত্মরক্ষার কাজ করে। হাঁসের ঠোঁটটাও লক্ষ্য করার মতো। লাল থেকে কমলালেবুর রঙা। শক্তপোক্ত। ওই শক্ত ঠোঁটটার নিচে রয়েছে ঝিলিস্ন। ওই নরম ঝিলিস্ন আটকে দেয়া ওপরের শক্ত ঠোঁটের আবরণীর সাহায্যে পানির মাঝের নানা ধরনের খাবার- শেওলা, কীটপতঙ্গ, মাছের ডিম থেকে ডিম পোনা, ধানিপোনা এমন কি ফুলধনি পর্যন্ত। অর্থাৎ যা আটকাবে সব চলে যাবে সটান পাকস্থলীর মধ্যে। হাঁসের ঠোঁট আত্মরক্ষার কাজেও সাহায্য করে। মুরগি দিনে ডিম পাড়ে। হাঁস পাড়ে সমস্ত রাত ধরে এবং সকাল ৯টা পর্যন্ত। এর জন্যই গৃহস্থ সকাল ৯টার আগে হাঁস পুকুরে ছাড়তে চায় না। হাঁসকে কাছে থেকে লক্ষ্য করলে বুঝা যায়- হাঁস খুবই বুদ্ধিমান পাখি। অনেক রহস্যের চাবি কাঠি আছে ওর কাছে। বিলেত ও আমেরিকার মানুষ শুধু হাঁসের জলকি দেখেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটিয়ে দেয়। শুধু সৌন্দর্যের জন্য এক বিশেষ জাতের হাঁস মানুষ সৃষ্টি করেছে।

গবেষক ও খামারিরা বলছেন, হাঁস একেবারে প্রাকৃতিক পানি থেকেই মাছ, ঝিনুক, শামুক, পোকামাকড়, জলজ উদ্ভিদ ইত্যাদি খেয়ে থাকে বলে তাদের অন্য খাদ্যের প্রয়োজন খুব কম। আবার পুকুরে হাঁস চাষ করলে সার ও মাছের খাদ্য ছাড়াই মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব। অনেকেই বাণিজ্যিকভাবে হাঁস চাষে এগিয়ে আসছেন এবং প্রধান পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন হাঁস চাষ। মৎস্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের মতে, পুকুরে হাঁস ও মাছের সমন্বিত চাষ পদ্ধতি অবলম্বন করলে খুব সহজে বেশি লাভবান হওয়া সম্ভব। হাঁস চাষে অনেক সুবিধা রয়েছে যেমন- মাছের জন্য পুকুরে তেমন বাড়তি সার ও খাদ্য দিতে হয় না। হাঁস থাকলে মাছ দ্রম্নত বৃদ্ধি পায়। হাঁসের রোগবালাই তুলনামুলক খুবই কম। তাছাড়া খাবারের তেমন অভাব হয় না। দেশি মুরগি যেখানে গড়ে বছরে ৫৫টি ডিম দেয়, দেশি হাঁস সেখানে ৯০টির বেশি ডিম দিয়ে থাকে। আর উন্নত জাত হলে বছরে ২৫০-৩০০টি ডিম দিয়ে থাকে।

হাঁস পালনের জন্য ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ আয়তনের একটি পুকুর লাগবে। ১০০ থেকে ২০০টি হাঁস এবং হাঁসের ঘর তৈরি করে নিতে হবে। এসব পরিকল্পিতভাবে করলে ভালো হবে। পাহারাদারের ঘরটি হাঁসের ঘরের দক্ষিণ পাশে হলে ভালো হয়। হাঁসের জাত নির্বাচন করার ক্ষেত্রে যে জাতের হাঁস বেশি ডিম দেয় সে জাতের হাঁস নির্বাচন করতে হবে। এক্ষেত্রে খাকি ক্যাম্পেবেল, ইন্ডিয়ান রানার, সিলেট মিটি ও নাগেশ্বরী জাত নির্বাচন করা যেতে পারে। এ জাতের হাঁস ৫ মাস বয়স থেকে ২ বছর পর্যন্ত ডিম দেয়।

হাঁস বিভিন্ন পদ্ধতিতে পালন করা যায়। এর মধ্যে একটি হচ্ছে মুক্ত জলাশয়ে হাঁস পালন। এ পদ্ধতিতে ২৫-১০০টি হাঁস মুক্ত পুকুরে, লেকে অথবা ধান কাটার পর পরিত্যক্ত জমিতে পালন করা যায়। অপরটি হচ্ছে ইনটেনসিভ হাঁস পালন। এ পদ্ধতিতে ১ থেকে ১০ লাখ হাঁস পালন করা সম্ভব। দিনের বেলায় হাঁস পানিতে থাকতে পছন্দ করে। শুধু রাত যাপনের জন্য ঘরের প্রয়োজন।

পুকুরপাড়ে কিংবা পুকুরের ওপর ঘরটি তৈরি করতে হবে। ঘরের উচ্চতা ৫-৬ ফুট হলে ভালো হয়। ঘর তৈরিতে বাঁশ, বেত, টিন, ছন, খড় ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে ইট দিয়ে মজবুত করে ঘর তৈরি করতে পারলে ভালো হবে। ঘরটি খোলামেলা হতে হবে এবং সাপ ও ইঁদুর থেকে মুক্ত রাখতে হবে। শহরে বিভিন্ন মাপের চৌবাচ্চায় হাঁস পালন করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে বড় ছাদ থাকলে সুবিধা বেশি। ছাদের একপাশে ঘর অপর পাশে চৌবাচ্চা নির্মাণ করতে হবে। প্রজননের জন্য আটটি হাঁসের সঙ্গে একটি পুরুষ হাঁস রাখা দরকার। এরপর দেশি মুরগির সাহায্যে অথবা ইনকিউবেটরে হাঁসের ডিম ফোটানো যায়।

হাঁস চাষে সুবিধা হলো হাঁস খাল-বিল-পুকুর থেকে তার কিছু খাবার সংগ্রহ করে নেয়। তাছাড়া বাজারে হাঁসের তৈরি খাবার কিনতে পাওয়া যায়। শুকনো খাদ্য না দিয়ে হাঁসকে সব সময় ভেজা খাদ্য দেয়া উচিত। খাদ্যে আমিষের পরিমাণ ডিম দেয়া হাঁসের ক্ষেত্রে ১৭-১৮ শতাংশ ও বাচ্চা হাঁসের ক্ষেত্রে ২১ শতাংশ রাখা উচিত। হাঁস দানা, খইল, ভুসি, ঝিনুকের গুঁড়ো, ডিমের খোসা, কেঁচোসহ অন্যান্য খাবার বেশি পছন্দ করে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মাছের পুকুরে হাঁস পালন করলে কৃষকরা বেশি লাভবান হন। এ চাষে হাঁস বেশি প্রোটিন পায়। ২০-৪০ শতাংশের একটি পুকুরে ১০০-২০০টি হাঁসের জন্য এ প্রকল্প শুরু করলে সব মিলে খরচ হবে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। সঠিক পরিচর্যা আর যত্ন নিতে পারলে প্রথম বছরে যাবতীয় খরচ বাদ দিয়ে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব।

হাঁস ও মাছ চাষের প্রধান সুবিধাগুলো হচ্ছে- একটি হাঁস প্রতি মাসে ৩-৪ কেজি জৈবসার পুকুরে ছড়িয়ে দিতে পারে। ৩-৪টি হাঁসের জৈব সার থেকে ১ কেজি বাড়তি মাছ উৎপন্ন হতে পারে। হাঁস পুকুরের অবাঞ্ছিত আগাছা খেয়ে মাছ চাষে সাহায্য করে। শামুক, ব্যাংগাচি, পোকা-মাকড়- যা মাছের কোনো কাজে আসে না এমন জিনিস খেয়ে হাঁস ডিম উৎপাদন করে। পুকুরে মাছ ও হাঁসের চাষ একসঙ্গে করে বছরে প্রতি হেক্টরে ১-১৫ টন (মাছ হাঁস) উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। হাঁসের বাচ্চা পালনের ক্ষেত্রে সর্বদা খেয়াল রাখতে হবে। বাচ্চা যেখানে থাকবে সেখানে যেন তাপমাত্রা সব সময় সঠিক অনুপাতে থাকে।

নাটোরের গুরুদাসপুরে চলনবিল এলাকায় হাঁসের খামারির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। খামারিরা বলছেন, হাঁস পালন অপেক্ষাকৃত কম পুঁজিতে বেশি লাভ। বিল-জলাশয় ও নদীর উন্মুক্ত পানি থাকায় সেখানে হাঁস পালন বাণিজ্যিক রূপ লাভ করেছে। ভোলার চরাঞ্চলে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে হাঁস পালন। বাহারি রংয়ের নানা প্রজাতির এ হাঁস পালনে ভাগ্য বদল হয়েছে অনেক খামারির। দুর্গম চরে নিজ বাড়ির আঙিনায় বা সুবিধা মতো স্থানে খামার তৈরি করে হাঁস পালনে ঝুঁকে পড়েছেন চরের মানুষ। মাঠে ঘাটে দেখা যায় হাঁসের ঝাঁক।

চরের মাঠ-ঘাটে, খাল-বিল, ডোবা বা ফসলের ক্ষেতে হাঁস চড়ানো হয়। সেখানেই দল বদলে ছুটে চলে শত শত হাঁস। খাবার সংগ্রহ করে আবার দিন শেষে খামারে ফিরে আসে দলবেঁধে। খামারিরা হাঁস পালন করে বেশ খুশি। চরের খামারিরা জানালেন, চরে হাঁসের খাবার এবং হাঁস চড়াতে কোনো ঝমেলা নেই। হাঁস পালন করে অনেকেই হয়েছেন সামলম্বী। দারিদ্রতা দূর করে অনেকেই ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। কর্মসংস্থান হয়েছে অনেকের। সারা বছরই হাঁস পালন করা যায়- তবে শীতের সময় হাঁস এবং হাসের ডিমের চাহিদা বেশি থাকায় এ সময়টাতে হাটবাজারে হাসের জমজমাট কেনা বেচা হয়ে থাকে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে