রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

দেশীয় ফল লটকনের চাষাবাদ

প্রফেসর আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ
  ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

টক-মিষ্টি স্বাদের লটকন আমাদের দেশি ফল। বর্ষাঋতুর এই লটকন ফল বাঙালির মন জয় করে নিয়েছে। লটকন ফল খেতে যেমন সুস্বাদু তেমনি এর চাষও লাভজনক। দেশের অর্থনীতির সম্ভাবনাময় দেশীয় ফল লটকন দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। কদর বেড়েছে দেশেও। অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে লটকন ফলের আবাদ।

বর্তমানে টক-মিষ্টি সুস্বাদু এ ফলের চাহিদা ও দাম দুটিই বেড়েছে। এমনকি অন্যান্য ফল চাষের তুলনায় লটকন চাষ অনেক বেশি সহজ এবং ফলনও বেশি হওয়ায় চাষিরা বেশি লাভবান হচ্ছেন। লটকন গাছের কান্ডে ফলে। গাছের পুষ্টির সুষমতা ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে গাছের গোড়া থেকে প্রধান কান্ডগুলোয় এত বেশি ফল আসে। একটি পূর্ণবয়স্ক লটকন গাছে পাঁচ থেকে ১৫ মণ পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়। লটকন ফল গোলাকার এবং পাকলে হলুদবর্ণ ধারণ করে। ফল হিসেবে লটকন যেমন পুষ্টিতে ভরপুর তেমনি ক্যালসিয়াম, ক্যারোটিন ও খনিজ লবণে সমৃদ্ধ।

বর্ষাকালের এটি জনপ্রিয় দেশীয় ফল। অম্স্ন-মিষ্টি স্বাদ এ ফলের প্রতি নগরবাসিকে আকর্ষণ করছে। এক সময় মানুষের অপছন্দনীয় এ ফলটি কালের আবর্তে বর্তমানে চাহিদার অন্যতম স্থান দখল করে নিয়েছে। অঞ্চলভিত্তিক এর কিছু স্থানীয় নাম রয়েছে। লটকনে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন বি-২, ভিটামিন-সি রয়েছে। এ ছাড়া ফলটি ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহসহ বিভিন্ন খনিজ উপাদানে সমৃদ্ধ। দৈনিক আমাদের দেহের জন্য যে পরিমাণ ভিটামিন সি'র প্রয়োজন, মাত্র চারটি লটকন সেই চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট। লটকনের ভেষজগুণও রয়েছে। মুখোরোচক এই মৌসুমি ফলটির বেশি চাষবাদ হয় নরসিংদী জেলায়। নরসিংদীতে ফলন বেশি হলেও সিলেট, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাজীপুর জেলাগুলোতে বাণিজ্যিকভাবে লটকনের চাষ হচ্ছে। এছাড়াও দেশের সর্বত্র ব্যক্তিগতভাবে বসতবাড়িতে এক-দুটি লটকন গাছ লাগানোর প্রতি জনসাধারণের আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বারি লটকন-১ নামে লটকনের একটি উন্নতজাত উদ্ভাবন করেছেন। এছাড়াও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্মপস্নাজম সেন্টারে লটকনের উন্নত চারা পাওয়া যায়। অনেকে নরসিংদী জেলার উচ্চফলনশীল স্থানীয় গাছ থেকে চারা সংগ্রহ করে থাকে। আবার নার্সারিগুলোতেও ভালোমানের লটকনের চারা পাওয়া যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে পানি জমে না এমন উঁচু জায়গায় ঘন ঝোপ-জঙ্গলের নিবিড় ছায়ায় লটকন ফলের গাছ বংশবিস্তার করে। এ ছাড়া পাকা লটকন ফল গাছের নিচে পড়েও অতি সহজে এই গাছের চারা গজায়। তবে দ্রম্নত ফল পাওয়ার জন্য এয়ার লেয়ারিং পদ্ধতিতে বংশবিস্তার করা হয়। এপ্রিল থেকে আগস্টে লটকনের চারা রোপণ করতে হয়। রোপণের তিন-চার বছর পর থেকেই ফল ধরতে শুরু করে। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝিতে লটকন গাছে ফুল আসে। ফুল আসার আগে মার্চ মাসে গাছে গোড়ার মাটি সামান্য আলগা করে তাতে পরিমাণমতো সার এবং হালকা সেচ দিলে ফলন অনেকগুণ বৃদ্ধি পায় এবং ফলের আকারও বড় হয়।

লটকনের গাছ ছোটখাটো ঝাঁকড়া ধরনের হয়ে থাকে। পাতা ডিম্বাকৃতির, গাঢ় সবুজ। বসন্তে ফুল আসা শুরু। ফল পাকে বর্ষাকালে। ডুমুরের মতো লটকন গাছের কান্ড ও মোটা ডালের বাঁকল ফেটে লম্বা বৃন্তে গুচ্ছাকারে ধরে। একটি গুচ্ছে কুড়ি থেকে ত্রিশটি পর্যন্ত ফল ধরতে পারে। ফল পাকলে এর পরিক্বতা অনুযায়ী ছড়া ছড়া ফল সংগ্রহ করতে হয়। আকারে মার্বেলের দ্বিগুণ বা তার চেয়ে কিছুটা বড়। হলুদ রঙের ফলগুলো কাঁচা অবস্থায় থাকে সবুজ রঙের।

নরসিংদীর লটকন অত্যন্ত সুস্বাদু হওয়ায় এর প্রচুর চাহিদা রয়েছে। প্রতি মৌসুমে প্রায় সাড়ে আট হাজার টন লটকন উৎপাদিত হয় এ জেলাতে। যার বাজারমূল্য প্রায় ৩০ কোটি টাকা। লটকনের মৌসুমকে সামনে রেখে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ককে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একাধিক মৌসুমি বাজার। জেলার সবচেয়ে বড় লটকনের বাজার হলো মহাসড়কের পাশের রায়পুরা উপজেলার মরজাল বাজার। সংশ্লিষ্টরা জানান, এ বাজারে প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত প্রায় ২০ লাখ টাকার লটকন বিক্রি হয়। লটকন বিক্রি হয় ওজন করে। খুচরা দাম ৬০ থেকে ১৩০ টাকা প্রতি কেজি। এক কেজিতে আকারভেদে ২৫ থেকে ৭০টি লটকন পাওয়া যায়। সুস্বাদু লটকনের চাহিদা রয়েছে দেশ ছাড়া বিদেশেও। মধ্যপ্রাচ্য, লন্ডন ও ইউরোপের দেশগুলোতেও লটকনের বিপুল চাহিদা থাকায় সে দেশে আমরা লটকন রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি।

লেখক: অধ্যাপক, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে