রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষিপণ্য উৎপাদনে দেশের ঈর্ষণীয় সাফল্য

বাংলাদেশ জনসংখ্যায় পৃথিবীতে ৮ম কিন্তু আয়তনে পৃথিবীর ৯৪তম দেশ। এখানে এক লাখ সাতচলিস্নশ হাজার পাঁচশত সত্তর বর্গ কিলোমিটার এলাকায় প্রায় সতেরো কোটি মানুষের বসবাস। সঙ্গে আরও রয়েছে প্রায় দশ লাখ শরণার্থীর আশ্রয়। তাই বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র একটি ভূখন্ড থেকে এই বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্যের সংস্থান করা নিঃসন্দেহে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। কিন্তু গত দেড় দশকে সবাইকে তাক লাগিয়ে সেই অসাধ্য সাধন করেছে বাংলাদেশ। দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনসহ কৃষির অন্যান্য ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় উন্নতি স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের অন্যতম সেরা অর্জন
অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ
  ০১ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০

কৃষিপণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। মহামারি করোনাকালে ধান উৎপাদনে একধাপ এগিয়ে এখন বিশ্বে তৃতীয়। এ ছাড়াও পাট রপ্তানিতে বিশ্বে আবারো প্রথম বাংলাদেশ। ইলিশ মাছ উৎপাদনে প্রথম, সবজিতে তৃতীয়, মিঠাপানির মাছে তৃতীয়, আম উৎপাদনে বিশ্বে নবম, আলু উৎপাদনে শীর্ষ দশে বাংলাদেশ। বস্ন্যাক বেঙ্গল ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ। আর ছাগলের দুধ উৎপাদনে দ্বিতীয়, পেয়ারা উৎপাদনে বিশ্বে অষ্টম।

বাংলাদেশ জনসংখ্যায় পৃথিবীতে ৮ম কিন্তু আয়তনে পৃথিবীর ৯৪তম দেশ। এখানে এক লাখ সাতচলিস্নশ হাজার পাঁচশত সত্তর বর্গ কিলোমিটার এলাকায় প্রায় সতেরো কোটি মানুষের বসবাস। সঙ্গে আরও রয়েছে প্রায় দশ লাখ শরণার্থীর আশ্রয়। তাই বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র একটি ভূখন্ড থেকে এই বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্যের সংস্থান করা নিঃসন্দেহে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। কিন্তু গত দেড় দশকে সবাইকে তাক লাগিয়ে সেই অসাধ্য সাধন করেছে বাংলাদেশ। দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনসহ কৃষির অন্যান্য ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় উন্নতি স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের অন্যতম সেরা অর্জন। বৈশ্বিক কৃষিতে বাংলাদেশের কৃষির সফলতার গল্প আজ উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য উদাহরণ।

করোনাকালীন দুঃসময়েও দেশের কৃষি এগিয়ে গিয়েছে তার নিজস্ব গতিতে। চাল উৎপাদনে কয়েক বছরের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে বিশ্বে তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। একইসঙ্গে বাংলাদেশ এখন চাল রপ্তানিকারক দেশ। অন্যদিকে, স্বাধীনতাত্তোর সময়ে বাংলাদেশে ভুট্টা উৎপাদন বেড়েছে প্রায় দশ গুণ। দেশে বিগত পাঁচ বছরে ভুট্টার উৎপাদন দ্বিগুণ হয়ে ২৭ লাখ টন হতে ৫৪ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। বিশ্বে হেক্টরপ্রতি ভুট্টার সর্বাধিক ফলন ১১ টন। আর বাংলাদেশে হেক্টরপ্রতি ভুট্টার ফলন হয়েছে পৌনে ১০ টন, যা বিশ্বে তৃতীয়। প্রতি বছর প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য খাতে খাদ্যের চাহিদা বছরে ১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। আর এ খাদ্যের মূল উপাদান ভুট্টা। উৎপাদন ও ফলন বৃদ্ধি পাওয়ায় ভুট্টার আমদানি নির্ভরতা কমে এখন রপ্তানি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

বিশ্বে পরিবেশবান্ধব তন্তু বিবেচনায় পাটের কদর দিন দিন বেড়েই চলছে। আর সে পাট উদপাদনে পৃথিবীতে ভারতের পরই বাংলাদেশের স্থান। কিন্তু পাট রপ্তানিতে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম। বাংলাদেশে চা শিল্পের বাজার ২০ হাজার কোটি টাকার উপরে। বিগত চার দশকে দেশে চা উৎপাদন বেড়েছে প্রায় তিনগুণ। ইন্টারন্যাশনাল টি কমিটি'র প্রতিবেদন অনুসারে, চা উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান গত বছর ৯ম স্থানে উন্নীত হয়েছে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্যানুযায়ী, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। পেঁয়াজ ও ফুলকপি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে নবম। আলু উৎপাদনে সপ্তম। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও এখন আলু রপ্তানি হচ্ছে। বিশ্বে প্রতি বছর যে হারে শাকসবজি চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতেও বাংলাদেশ শীর্ষস্থানীয়। তবে বছরব্যাপী নিরবচ্ছিন্ন সবজি উৎপাদন, পরিবহণ ও ফসল সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

ফল উৎপাদনে উষ্ণমন্ডলীয় দেশগুলোতে বাংলাদেশ দশম আর সামগ্রিকভাবে ২৮তম। কিন্তু ফল উৎপাদনের আওতা বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষে অবস্থান করছে। বাংলাদেশ কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয়। আম উৎপাদনে ৭ম। পেয়ারা উৎপাদনে ৮ম। পেঁপে উৎপাদনে ১৪তম। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলদেশ থেকে ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে আম-কাঁঠাল রপ্তানি শুরু হয়েছে। ইউরোপের বাজারেও বাংলাদেশের আমের চাহিদা তৈরি হয়েছে।

স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনেও বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়। বিগত কয়েক দশকে মৎস্য ক্ষেত্রে বাংলাদেশে নীরব বিপস্নব ঘটেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, বিশ্বে যে পরিমাণ ইলিশ উৎপাদিত হয়, তার ৮৬ শতাংশই হয় আমাদের দেশে। ইলিশের প্রজনন, বংশবৃদ্ধি এবং জাটকা সংরক্ষণে বাংলাদেশের মডেল এখন বিশ্বের অনেক দেশই অনুসরণ করছে। একসময় সাদা সোনা হিসেবে পরিচিত চিংড়ি রপ্তানিতেও বাংলাদেশের সম্ভাবনা প্রকট।

খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সাম্প্রতিক তথ্যমতে, বাংলাদেশে পালনকৃত গবাদিপশুর সংখ্যা ২ কোটি ৪০ লাখেরও বেশি। শুধু তা-ই নয়, গবাদিপশু পালনে সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বাদশ অবস্থানে রয়েছে। ছাগল উৎপাদনেও বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ আর ছাগলের মাংস উৎপাদনে বিশ্বে পঞ্চম। আবার ছাগলের মাংসের গুণগত মান ও স্বাদ এবং উৎপাদনশীলতা বিবেচনায় আমাদের নিজস্ব জাত বস্নাক বেঙ্গল গোট বিশ্বখ্যাত। কয়েক বছর আগেও প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মায়ানমার থেকে আমদানিকৃত গরু দিয়েই মিটত দেশের মাংসের চাহিদা। প্রতি বছর কোরবানির সময় দেশ দুটি থেকে আমদানি হতো ২২ থেকে ২৫ লাখ গবাদিপশু। কিন্তু সেই নির্ভরতা কমিয়ে এখন স্বয়ংসম্পূর্ণতার পথে বাংলাদেশ।

ধানসহ নানাবিদ ফসলের জাত উন্নয়নে বাংলাদেশের সফলতা বিশ্বখ্যাত। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়-ক্ষতি মোকাবিলায় বন্যা, খরা, লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতা ও দুর্যোগসহিষ্ণু শস্যের জাত উন্নয়নে বাংলাদেশ বিশ্বে সুনাম কুড়িয়েছে। পাশাপাশি বিশেষ পুষ্টিসমৃদ্ধ ফসলের জাত উন্নয়নে বাংলাদেশ অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। প্রতি বছর নতুন নতুন ফলমূল, শাক-সবজি দেশে চাষাবাদের তালিকায় যোগ হচ্ছে।

প্রায় চার কোটি টন খাদ্য উৎপাদন করে বাংলাদেশ এখন দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। স্বাধীনতাত্তোর সময়ে বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন বেড়েছে তিনগুণেরও বেশি, গম দ্বিগুণ, সবজি পাঁচগুণ এবং ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে প্রায় দশগুণ। দেশে ফসল বহুমুখীকরণের পাশাপাশি ফসল নিবিড়তা বেড়ে হয়েছে প্রায় দুশ' শতাংশ। অর্থাৎ জমিতে বছরে গড়ে দুটি ফসল উৎপাদিত হচ্ছে। এ ছাড়াও ছাদ-কৃষি ও নগর কৃষিতে মানুষের আগ্রহ ও জনপ্রিয়তা আশাব্যঞ্জক। এ সামগ্রিক সাফল্যের মূলে রয়েছে যুগোপযোগী পরিকল্পনা, কৃষকের নিরবচ্ছিন্ন পরিশ্রম এবং মেধাবী কৃষি বিজ্ঞানী ও কৃষি সম্প্রসারণবিদদের যৌথ প্রয়াস।

কৃষি খাতে এতসব সাফল্যের পরেও বেশকিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ফসলের হাইব্রিড জাত উদ্ভাবনে ঘাটতি, প্রাণী ও মৎস্য সম্পদের অধিক উৎপাদনশীল জাতের অভাব, সার ও কীটনাশকে ভেজাল, সেচ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন না হওয়া, কৃষি সংশ্লিষ্টদের দক্ষতার ঘাটতি, উন্নত প্রযুক্তি ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ধীরগতি, কৃষিপণ্যে মূল্য সংযোজনের অভাব, পর্যায়ক্রমে কৃষিজমি কমে যাওয়া, কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও প্রাত্যহিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ অন্যতম। এ ছাড়াও কৃষকের শ্রম ও ঘামে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের বাজারজাতকরণ ও ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি অন্যতম বড় সমস্যা হিসেবে বিবেচিত।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ খোরপোশ কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষিতে উত্তরণ ঘটিয়েছে। এখন চ্যালেঞ্জ হলো উৎপাদনের গুণগতমান নিশ্চিত করে রপ্তানিমুখী কৃষিতে বিশ্বে নিজেদের অবস্থান করে নেওয়া। 'উত্তম কৃষি চর্চা' সংশ্লিষ্ট সনদের ব্যবস্থা না থাকায় ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কৃষিপণ্য রপ্তানিতে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। পাশাপাশি কৃষি ঋণের অপর্যাপ্ততা, কৃষি বীমা ব্যবস্থা না থাকায় কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই কৃষি খাতের উন্নয়ন, গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালীকরণ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য কৃষি সংশ্লিষ্টদের সচেতন ও সংগঠিত হওয়া প্রয়োজন। একইসঙ্গে কৃষির আধুনিকায়ন, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার এবং কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপন এখন সময়ের দাবি।

আমরা বলে থাকি কৃষিই কৃষ্টি, কৃষিই সমৃদ্ধি। কৃষকরাই এ দেশের প্রাণ। বৈশ্বিক মহামারিতে বিশ্ব যখন স্থবির, তখনও থেমে ছিলেন না বাংলার কৃষকরা। নিজের হাতে ফলিয়েছেন ফসল। আর সেই ফসলই বাঁচিয়ে রেখেছে ঘরবন্দি ১৭ কোটি মানুষের জীবন। বাঁচিয়ে রেখেছে দেশের অর্থনীতি। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কিছু দেশে তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৩৫ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের কম। এ বর্ধিত তরুণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান করতে হলে কৃষিতে আত্মনিয়োগ করতে হবে। আমরা খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন করেছি, এখন আমাদের পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে অধিকতর মনোনিবেশ করা প্রয়োজন। প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে সক্ষমতা তৈরি করে বিদেশে কৃষিপণ্যের রপ্তানি বাড়াতে হবে। কৃষিতে বায়োটেকনোলজি ও ন্যানোটেকনোলজির ব্যবহার বাড়ানো, নতুন নতুন প্রযুক্তির প্রয়োগ, রোগ বালাই প্রতিরোধী উন্নত জাত উদ্ভাবন করতে হবে। এ ছাড়াও ফসলের বছরব্যাপী নিয়ন্ত্রিত চাষাবাদ, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ও সেচ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন জরুরি। এসডিজি'র ১৭টি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ১০টি এবং এর অন্তর্গত ৩৩টি টার্গেটের সঙ্গে কৃষি খাতের সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। তাই এসডিজি'র লক্ষ্য অর্জনে কৃষি খাতের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও কৃষি উৎপাদকদের আয় বৃদ্ধি অপরিহার্য। এদেশের মাটি ও মানুষ আমাদের সম্পদ। এ সম্পদকে সঙ্গে নিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে চাই।

লেখক: অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে