শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ভেষজ উদ্ভিদ চাষে অর্থনৈতিক গুরুত্ব বাড়ছে

শুধু যুক্তরাষ্ট্রে ১.৩ ও জার্মানিতে ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ভেষজ ওষুধ বিক্রি হয়। ভেষজ উদ্ভিদ রপ্তানি করে চীন প্রতি বছর আয় করে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ভারত ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ১ হাজার কোটি রুপি এবং দক্ষিণ কোরিয়া ২.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার মতে, বর্তমানে বিশ্বে শুধু ঔষধি উদ্ভিদের বাজার রয়েছে ৬২ বিলিয়ন ডলারের। এই বিশাল বাজারের অধিকাংশই এখন ভারত ও চীনের দখলে। ভেষজ উদ্ভিদ চাষ অন্য যে কোনো ফসল উৎপাদনের চেয়ে অধিক লাভজনক, নিরাপদ ও সহজ হওয়ায় সমগ্র বিশ্বে ভেষজ উদ্ভিদের বিপুল চাহিদা রয়েছে। ওষুধ ও প্রসাধনসামগ্রী তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৪০০ কোটি টাকার ভেষজসামগ্রী আমদানি করা হয়। গবেষণা অনুযায়ী, দেশের ওষুধ শিল্পে বর্তমানে যে পরিমাণ ভেষজ উদ্ভিদ ব্যবহৃত হয়, তার ৭০ ভাগই স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা সম্ভব।
ইমরান ছিদ্দিকি
  ০৫ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০

ভেষজ উদ্ভিদ চাষ অন্য যে কোনো ফসল চাষের চেয়ে বহুগুণ বেশি লাভজনক এবং নিরাপদ। সমগ্র বিশ্বে ভেষজ উদ্ভিদের বিপুল চাহিদা রয়েছে। ভেষজ উদ্ভিদ রপ্তানি করে চীন প্রতি বছর আয় করে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ভারত আয় করে ৬ বিলিয়ন ডলার এবং দক্ষিণ কোরিয়ার আয় ২.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। শতভাগ রপ্তানি সম্ভাবনা ছাড়াও ভেষজ উদ্ভিদের চাষ করে কৃষক তুলনামূলক অধিক লাভ হতে পারেন। অধিকাংশ ভেষজ উদ্ভিদের চাষ প্রক্রিয়া অত্যন্ত সহজ। ভেষজ উদ্ভিদ চাষের ক্ষেত্রে সার ও কীটনাশকের ভূমিকা অত্যন্ত গৌণ, এ কারণে কৃষকের উৎপাদন খরচ তুলনামূলকভাবে অনেক কম। গুল্মজাতীয় ভেষজ প্রায় বিনা পরিচর্যা ও বিনা খরচে উৎপাদন সম্ভব, অথচ এসব উদ্ভিদের বাজার দর বেশ চড়া।

শুধু যুক্তরাষ্ট্রে ১.৩ ও জার্মানিতে ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ভেষজ ওষুধ বিক্রি হয়। ভেষজ উদ্ভিদ রপ্তানি করে চীন প্রতি বছর আয় করে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ভারত ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ১ হাজার কোটি রুপি এবং দক্ষিণ কোরিয়া ২.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার মতে, বর্তমানে বিশ্বে শুধু ঔষধি উদ্ভিদের বাজার রয়েছে ৬২ বিলিয়ন ডলারের। এই বিশাল বাজারের অধিকাংশই এখন ভারত ও চীনের দখলে। ভেষজ উদ্ভিদ চাষ অন্য যে কোনো ফসল উৎপাদনের চেয়ে অধিক লাভজনক, নিরাপদ ও সহজ হওয়ায় সমগ্র বিশ্বে ভেষজ উদ্ভিদের বিপুল চাহিদা রয়েছে। ওষুধ ও প্রসাধনসামগ্রী তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৪০০ কোটি টাকার ভেষজসামগ্রী আমদানি করা হয়। গবেষণা অনুযায়ী, দেশের ওষুধ শিল্পে বর্তমানে যে পরিমাণ ভেষজ উদ্ভিদ ব্যবহৃত হয়, তার ৭০ ভাগই স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা সম্ভব।

পৃথিবীর সব উদ্ভিদই ওষুধ হিসেবে কাজ করে বা সেগুলোর ভেষজ গুণ রয়েছে। তবে বিজ্ঞানীরা ২০ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদকে ভেষজ উদ্ভিদ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বিশ্বব্যাপী ভেষজ ওষুধের বাজার দ্রম্নতগতিতে প্রসার লাভ করছে। প্রতি বছর আন্তর্জাতিক বাজারে ভেষজের চাহিদা বাড়ছে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হারে। পাশাপাশি ভেষজ উপাদানের চাহিদা আমাদের দেশেও বেড়েছে। মানবজীবনে অসুখের চিকিৎসা ও প্রতিরোধের জন্য ভেষজ উদ্ভিদের ওপর নিভর্রশীলতা চিরায়ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পৃথিবীর শতকরা ৭০ থেকে ৯০ ভাগ লোক ভেষজ উদ্ভিদ দিয়ে রোগ সারায় ও প্রতিরোধ করে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে দেখা গেছে, বিশ্বের প্রায় ৪০০ কোটি মানুষ ভেষজ ওষুধ ব্যবহার করছে। ইউনানি, আর্য়ুবেদীয়, অ্যালোপ্যাথিক, হোমিওপ্যাথিক, কবিরাজিসহ সব ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ভেষজ উদ্ভিদ দিয়ে ওষুধ তৈরি করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, ২০৫০ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে ভেষজের বাণিজ্য হবে পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারের। এশিয়া ও আফ্রিকার বেশ কিছু দেশ ভেষজ ওষুধ ও ঔষধি উপাদান রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে সক্ষম হচ্ছে। পরিকল্পিতভাবে ভেষজ উৎপাদন, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাত ও বাজারজাতকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে বাংলাদেশও অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে এবং রপ্তানি করে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মদ্রা অর্জন করতে সক্ষম হবে।

ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ভেষজ উদ্ভিদের চাহিদা সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও বেড়ে চলেছে। ভেষজ উৎপাদনে চমৎকার সহায়ক প্রাকৃতিক পরিবেশ বাংলাদেশে বিদ্যমান। ভেষজ উৎপাদন উপযোগী আমাদের দেশে রয়েছে উর্বর জমি, পর্যাপ্ত পানি ও অনুকূল আবহাওয়া। দেশে প্রায় ৬০০ প্রজাতির ভেষজ উদ্ভিদ থাকলেও ওষুধ শিল্পে বর্তমানে ১০০ ধরনের উদ্ভিদ থেকে দেড় শতাধিক ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাত করা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, উন্নয়নশীল দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৮০ ভাগ এখনো ঔষধি উদ্ভিদের ওপর নিভর্রশীল। অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও আন্তর্জাতিক বাজারের কথা বিবেচনা করে ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বেসরকারি উদ্যোগে ভেষজ উদ্ভিদের চাষাবাদ ও উৎপাদন শুরু হয়েছে। ইউনানি, আয়ুর্বেদী ও হোমিওপ্যাথি ওষুধ উৎপাদনে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহারের পাশাপাশি বিউটি পার্লারেও প্রসাধন শিল্পে এখন প্রচুর পরিমাণে ভেষজ উপাদান ব্যবহার করা হচ্ছে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রায় ৬০০ প্রজাতির ঔষধি বা ভেষজ উদ্ভিদ রয়েছে।

এ বিষয়ে ভেষজ চিকিৎসক শফিকুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে বড় বড় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো ধীরে ধীরে ভেষজ ওষুধ বাজারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই উদ্যোগগুলোর মাধ্যমে মানুষের ভেষজ ওষুধের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে এবং তার চাহিদা দ্রম্নত বাড়ছে। এই চাহিদা বেড়ে এসেছে- কারণ ভেষজ চিকিৎসা সাবলীল হয়ে উঠেছে এবং বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার জন্য ভেষজ ওষুধ কার্যকরী প্রমাণিত হয়েছে। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশে প্রমুখ ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো, যেমন স্কয়ার, বেক্সিমকো, ইনসেপ্টা ও একমি ভেষজ ওষুধের চাহিদা পূরণে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত সফল হয়েছে। এই কোম্পানিগুলো প্রতি বছর ৮০০ কোটি টাকা উপার্জন করতে সক্ষম হয়েছে। ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মতে, বাজারে প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের ভেষজ ওষুধ উপকরণ সহজেই উৎপাদন করা যায় এবং এই ধরনের ওষুধগুলোর জনপ্রিয়তা বেড়ে চলেছে। গত ১২ বছরে ভেষজ ওষুধ বাজারে প্রায় ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে ভেষজ ওষুধ উৎপাদনে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ও জনস্বাস্থ্য উন্নতির এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা সম্ভব।

স্বাস্থ্য রক্ষা ও পরিচর্যায় ভেষজ উদ্ভিদ ব্যবহারের ইতিহাস মানব সভ্যতার ইতিহাসের মতোই সুপ্রাচীন ও ঘটনাবহুল। ভেষজ ওষুধের অবদান ও গুরুকে অস্বীকার করে আধুনিক চিকিৎসা ও ওষুধের বর্তমান অবস্থানকে কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। কারণ সৃষ্টির শুরু থেকে পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ভেষজ ওষুধ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই যুগ যুগ ধরে বিভিন্নরূপে ও বিভিন্ন নামে মানুষের স্বাস্থ্য পরিচর্যায় ভেষজ ওষুধ ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলিত ও প্রযুক্তি বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার কারণে বর্তমান যুগে ভেষজ ওষুধের উপযোগিতা শেষ হয়েছে বলে অনেকে মনে করলেও সে ধারণা দিনে দিনে ভুল প্রমাণিত হচ্ছে। নব নব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে ভেষজ ওষুধ প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ হচ্ছে। ভেষজ ওষুধ অবশ্যই বিজ্ঞানসম্মত ও কার্যকরী ওষুধ। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ বা বিতকের্র অবকাশ নেই। ভেষজ ওষুধের গুণাগুণ ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত সামগ্রিকভাবে ওষুধ বিজ্ঞান তথা আধুনিক অ্যালোপ্যাথিক ওষুধও সমভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। কারণ এসব ওষুধের আদি ও মূল ভিত্তিও ভেষজ উদ্ভিদ এবং এখনো অসংখ্য আধুনিক অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ সরাসরি উদ্ভিজ্জ দ্রব্য এবং সেগুলো নিষ্কাশিত রাসায়নিক উপাদান দিয়ে তৈরি হয়ে থাকে।

উত্তরা শরমিল হাসপাতালের ডা. হাবিবুর রহমান জানান, ভেষজ ওষুধ এখনো বিভিন্ন দেশে মানুষের সার্বিক স্বাস্থ্য সংরক্ষণে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অগণিত মানুষ ভেষজ ওষুধের বদৌলতে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন। পৃথিবীর সার্ভিক জনগোষ্ঠীর প্রায় ৮০ শতাংশ ভেষজ ওষুধের ওপর নির্ভর করে তাদের রোগব্যাধির চিকিৎসা করে থাকেন। অর্থাৎ ভেষজ ওষুধ না থাকলে এই বিরাট জনগোষ্ঠী চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হতো। ভেষজ ওষুধ সম্পর্কিত এই সত্যটি অনুধাবন করেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উন্নয়নশীল দেশগুলোর সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ভেষজ ওষুধ ব্যবহার করার জন্য জোর সুপারিশ করেছে। ভেষজ ওষুধের ওপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই গুরুত্বারোপ নিঃসন্দেহে এর কার্যকারিতার নিশ্চিত সাক্ষ্য বহন করে এবং ভেষজ ওষুধ যে যথেষ্ট বিজ্ঞানসম্মত, নিরাপদ ও নিভর্রযোগ্য তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে। ভেষজ ওষুধের প্রতি দিন দিন মানুষের আগ্রহ বাড়ছে, ফলে এই ওষুধের চাহিদাও দ্রম্নত বাড়ছে। ভেষজ উদ্ভিদ যথেষ্ট মাত্রায় পরিবেশবান্ধব। প্রায় সব ভেষজ উদ্ভিদেরই পরিবেশ বিশুদ্ধকরণের ক্ষমতা রয়েছে। ভেষজ উদ্ভিদ বাতাসে বিরাজমান বিভিন্ন রোগ জীবাণুকে প্রাকৃতিকভাবে বিনষ্ট করতে সক্ষম। তাই অধিকহারে ভেষজ উদ্ভিদের চাষ আমাদের ক্রমশ দূষিত হয়ে পড়া পরিবেশ বিশুদ্ধকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। দেশে ব্যাপকভাবে ভেষজ উদ্ভিদের চাষ সম্ভব হলে ভেষজ চিকিৎসা ও ভেষজ ওষুধ আরো বেশি সহজলভ্য হবে, ফলে দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা ব্যয় কমবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে