সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

উর্বরা শক্তি হারাচ্ছে মাটি

মাত্রাতিরিক্ত সারের ব্যবহারে হারিয়ে যাচ্ছে জমির উর্বরা শক্তি। জমির উর্বরা শক্তি ঠিক রাখতে প্রয়োজন নানা ধরনের ফসল চাষ। উচ্চফলনশীল ও হাইব্রিড জাতের ফসল চাষও জমির উর্বরা কমার কারণ। সংস্থাটির গবেষণাগারে বছরে ৪০ হাজার মৃত্তিকা পানি নমুনা বিশ্লেষণ করে সুষম সার দেওয়ার সুপারিশ করছে। প্রকাশ করা হয়েছে ভূমি ব্যবহারের মানচিত্রও। নিত্যনতুন কৌশল হিসেবে অনলাইন সার সুপারিশ প্রযুক্তির মাধ্যমেও কৃষকদের সেবা দেওয়া হচ্ছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দস্তা ও বোরন সারে ৭০ শতাংশ ভেজাল পাওয়া যাচ্ছে।
ইমরান ছিদ্দিকি
  ০৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

একই জমিতে বছরে একাধিকবার ফসল চাষ এবং মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারে ভেঙে পড়েছে মাটির স্বাস্থ্য। মাটি হচ্ছে কৃষির মূল ভিত্তি। উর্বর মাটি না হলে ভালো ফসল উৎপাদন হয় না। দেশের অধিকাংশ কৃষকই বেশি ফসলের জন্য ইউরিয়া, নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়াম সার ব্যবহার করেন। অপরিমিত ও মাত্রাতিরিক্ত সার ব্যবহারে মাটির উর্বরা গুণাগুণ হারিয়ে যাচ্ছে। ধাতব পদার্থের কারণে দূষিত হয়ে পড়ছে দেশের উর্বর মাটি। আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, সিসা, নিকেল হচ্ছে ভারী ধাতব পদার্থ। অপরিকল্পিত চাষাবাদ, মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সারের ব্যবহার, ক্রমবর্ধমান নগরায়ণ, শিল্পায়ন, দূষণ, ব্যাপক হারে বনভূমি ধ্বংস হওয়ায় মাটির উবর্রতা শক্তি হারাচ্ছে।

দেশে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে গিয়ে শস্যের নিবিড়তা বাড়ছে, এতে মাটির উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে। টেকসই মাটি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাটির উৎপাদনশীলতা, মাটিতে গাছের অপরিহার্য পুষ্টি উপাদানের মান বজায় রাখতে হবে। কারণ মানুষের জীবন-জীবিকা ও খাদ্যনিরাপত্তা নির্ভর করে টেকসই মাটি ব্যবস্থাপনা ধরে রাখতে হবে। মাটির উর্বরা শক্তি বজায় রাখতে প্রয়োজন হয়, পর্যাপ্ত নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সালফার, বোরন ও জিংক। মাটিতে এসব উপাদানের উপস্থিতি পর্যাপ্ত না হলে উৎপাদন ঘাটতি ও ফসলের গুণগত মানে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হয় বলে জানিয়েছেন কৃষি গবেষকরা। অনুর্বর ভূমি থেকে প্রত্যাশা অনুযায়ী ফসল উৎপাদন হয় না। এ কারণে কৃষকরা বেশি ফলনের জন্য জমিতে বছরে তিন থেকে চারবার রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করে থাকেন। এতে কৃষি, মৎস্য ও পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে মানুষের।

মৃত্তিকা গবেষণা উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশে সব ধরনের আবাদি, বনভূমি, নদী, লেক, সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও সুন্দরবন ইত্যাদি এলাকা মিলিয়ে দেশে মোট জমির পরিমাণ ১ কোটি ৪৭ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে জৈব পদার্থের ঘাটতি রয়েছে ১ কোটি ১৬ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে। যা মোট ফসলি জমির ৭৮ দশমিক ৯০ শতাংশ। ফসল উৎপাদন মাটির স্বাস্থ্যের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। মাটি হচ্ছে কৃষির মূল ভিত্তি। উর্বর মাটি না হলে ভালো ফসল উৎপাদন হয় না। তাই সুষম মাটিতে ৫ শতাংশ জৈব উপাদান থাকার কথা। সাধারণত ৪৫ শতাংশ খনিজ বা মাটির কণা, ৫ শতাংশ জৈব এবং ২৫ শতাংশ করে পানি ও বাতাস থাকা মাটিকে সুষম মাটি বলা হয়। একটি আদর্শ জমিতে জৈব পদার্থের মাত্রা ৩.৫ শতাংশ থাকা অতি প্রয়োজনীয় হলেও এ দেশের বেশির ভাগ জমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ এক দশমিক ১৭ শতাংশ এবং দেশের কোথাও কোথাও এর পরিমাণ ১ শতাংশের চেয়েও কম?মাটিতে মাত্রারিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারে দেশের মোট আবাদযোগ্য জমিতে জৈব পদার্থের মারাত্মক ঘাটতি তৈরি হয়েছে।

এসআরডিআই গবেষণায় দেশের ৪৫০টি উপজেলার ৪৫ হাজারেরও বেশি স্থানের মাটির নমুনা সংগ্রহ করে। এসব নমুনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, ফসফরাস ঘাটতি রয়েছে দেশের ৭৮ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর ভূমিতে- যা মোট ভূমির প্রায় ৫৩ দশমিক ১ শতাংশ। অন্যদিকে, পটাশিয়ামের ঘাটতি রয়েছে প্রায় ৬৬ লাখ ৮০ হাজার হেক্টর বা ৪৫ দশমিক ৩ শতাংশ জমিতে। সালফারের ঘাটতি রয়েছে প্রায় ৭৬ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর বা ৫১ দশমিক ৮ শতাংশ জমির। এছাড়া জিংকের ঘাটতি রয়েছে প্রায় ৮০ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর বা ৫৪ দশমিক ৫ শতাংশ ভূমিতে। আর বোরনের ঘাটতি রয়েছে প্রায় ৭৩ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর বা প্রায় ৫০ শতাংশ ভূমিতে। এ জন্য একই জমিতে বছরের পর বছর একই ফসল চাষ এবং জমিকে কয়েক বছর পর পর পতিত না রাখায় জমি তার জৈব উপাদান হারিয়ে ফেলছে। পুষ্টি উপাদানের অপর্যাপ্ততায় ভুগছে কৃষিজমি।

কৃষিবিদ ডক্টর আজিজুল ইসলাম বলেন, বেশি উৎপাদনের জন্য কৃষকরা অতিরিক্ত সার প্রয়োগ করেন। মাত্রারিক্ত সারের ব্যবহারে হারিয়ে যাচ্ছে জমির উর্বরা শক্তি এতে চাষের খরচ বাড়ছে আবার পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলছে। নাইট্রোজেন যদি ভূগর্ভস্থ পানিতে মিশে যায়, তাহলে তা মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শিশুদের মৃতু্যঝুঁকিও থাকে। আবার জমিতে ফসফরাস বেশি দেওয়া হলে তা বৃষ্টির পানিতে বা বন্যায় খাল-বিলের পানিতে মিশে যায়। এর ফলে প্রায়ই মাছ মারা যেতে দেখা যায়। অর্থাৎ অতিরিক্ত সার ব্যবহারের ফলে তা ঝুঁকি তৈরি করছে। জমির উর্বরা শক্তি ঠিক রাখতে প্রয়োজন নানা ধরনের ফসল চাষ?সুষম ইউরিয়া সার এবং জৈব সারের ব্যবহার বাড়ালে মাটি আবার ফিরে পাবে তার উর্বরা শক্তি।

মাত্রাতিরিক্ত সারের ব্যবহারে হারিয়ে যাচ্ছে জমির উর্বরা শক্তি জমির উর্বরা শক্তি ঠিক রাখতে প্রয়োজন নানা ধরনের ফসল চাষ উচ্চফলনশীল ও হাইব্রিড জাতের ফসল চাষও জমির উর্বরা কমার কারণ। সংস্থাটির গবেষণাগারে বছরে ৪০ হাজার মৃত্তিকা পানি নমুনা বিশ্লেষণ করে সুষম সার দেওয়ার সুপারিশ করছে। প্রকাশ করা হয়েছে ভূমি ব্যবহারের মানচিত্রও। নিত্যনতুন কৌশল হিসেবে অনলাইন সার সুপারিশ প্রযুক্তির মাধ্যমেও কৃষকদের সেবা দেওয়া হচ্ছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দস্তা ও বোরন সারে ৭০ শতাংশ ভেজাল পাওয়া যাচ্ছে। সরকার ইউরিয়া সারের দাম কমানো ও সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখায় ইউরিয়া সারে ভেজাল কমেছে। উর্বরা শক্তি ফিরিয়ে আনতে চাষে ভিন্নতা আনতে হবে। একার ধান করলে পরের বছর ডাল জাতীয় ফসল করতে হবে। আবার দুই ফসল উৎপাদনের পর জমিকে বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। গরু-মহিষের ব্যর্জ জৈব পর্দাথের বড় উৎস্য।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে