সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

জৈবনিরাপত্তায় উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কার্যক্রম

বেশ কয়েক বছর আগ থেকেই দেশে ছড়িয়ে পড়েছে ক্ষতিকর আগাছা পার্থেনিয়াম। ধারণা করা হয়, গবাদিপশু ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এই আগাছার অনুপ্রবেশ ঘটেছে ভারত থেকে। আর এজন্য সীমান্তবর্তী জেলাসমূহে এর প্রাদুর্ভাব বেশ লক্ষণীয়। এটি একদিকে যেমন ফসলের ক্ষতি করে থাকে, তেমনি আবার গবাদিপশু ও মানবদেহে স্বাসনালির এলার্জি সৃষ্টি করে থাকে। অতি মাত্রায় এলিলোপ্যাথিক ক্রিয়া'র কারণে এই আগাছাটি ফসলের জমিতে মারাত্মক ফসলহানি ঘটায়। আবার এটি সহজে দমনও করা যায় না। এই আগাছাটিকে বিশ্বে ফসল ও জীববৈচিত্র্যের জন্য বড় হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ
  ০৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

১৮৪৫ সালে ইউরোপে সংগঠিত আইরিশ ফেমিনের কথা আমরা সবাই জানি। আলুর লেট বস্নাইট রোগের কারণে ফসলহানি ঘটায় ওই দুর্ভিক্ষে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল প্রায় ১০ লাখে, আরো পনেরো লাখে মানুষ বাঁচার তাগিদে স্থানান্তরিত হয়েছিল। উত্তর আমেরিকার ফসল আলু ইউরোপে খুব দ্রম্নত জনপ্রিয়তা পায় এবং প্রধান খাদ্য হিসেবে আবির্ভূত হয়। লেট বস্নাইট রোগের জীবাণু উত্তর আমেরিকা থেকে আলুর সঙ্গে ইউরোপে অনুপ্রবেশ করে। পশ্চিম ইউরোপের আবহাওয়া ওই জীবাণু ও রোগের জন্য অনুকূল হওয়ায় কিছুদিনের মধ্যেই রোগটি মহামারি আকারে দেখা দেয়। আয়ারল্যান্ডে ১৮৪৫ সালের গ্রীষ্মকালে মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে সব আলুর জমি এ রোগে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ফলে সভ্যতার ইতিহাসে ঘটে যায় এক ভয়াবহ বিপর্যয়।

তেমনি আরেকটি ঘটনা ঘটে ফ্রান্সে। সেখানে শিল্পবিপস্নব পরবর্তী সময়ে ওয়াইন কারখানার ব্যাপক প্রসার ঘটায়- যার মূল উপকরণ ছিল আঙুর। এক সময় সেখানকার আঙুর বাগানগুলো এফিড পোকার আক্রমণে বেশ সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। আঙুরের ফলন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। তখন তারা বাধ্য হয়েই উত্তর আমেরিকা থেকে এফিড প্রতিরোধী আঙুরের জাত এনে চাষাবাদ শুরু করে। কিছুদিন পর দেখা দেয় নতুন এক সমস্যা। বাগানগুলোতে এফিডের আক্রমণ নেই, কিন্তু দেখা দেয় এক ভয়াবহ রোগের প্রাদুর্ভাব। ১৮৭০ সালে ইউরোপে ডাউনি মিলডিও রোগে অধিকাংশ আঙুর বাগান ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে আবারও বিপর্যয় দেখা দেয় শিল্পকারখানায়। এফিড প্রতিরোধী আঙুরের জাতের সঙ্গে ডাউনি মিলডিও রোগের জীবাণু উত্তর আমেরিকা থেকে ইউরোপে অনুপ্রবেশ করে। মহামারির কারণে ফলন ব্যাহত হওয়ায় শিল্পকারখানাগুলো পড়ে এক মহাসংকটে।

একবিংশ শতাব্দির এ সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূত উন্নতির কারণে এক দেশের ফল-ফসল, গাছপালা, বীজ খুব দ্রম্নত অন্য দেশে চলে যাচ্ছে। এসব ফল ও ফসল, গাছপালা, বীজ এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়ার সময় বহন করে আনছে বিভিন্ন নিত্যনতুন ক্ষতিকর রোগজীবাণু, পোকামাকড় কিংবা আগাছা। ফলে কোনো এলাকার জীববৈচিত্র, ফল ও ফসল পড়ছে হুমকির মুখে।

বাংলাদেশের জৈব নিরাপত্তা নিশ্চিতে উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কার্যক্রম কেন গুরুত্বপূর্ণ তা বুঝতে নিচের বিষয়গুলো জানা প্রয়োজন। গত ২০১৬ সালে প্রথম বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের খুলনা বিভাগের বেশ কয়েকটি জেলায় গমের জমিতে অতি ক্ষতিকর বস্নাস্ট নামক একটি নতুন ছত্রাকজনিত রোগ দেখা দেয়- যার আক্রমণে ওই এলাকার অধিকাংশ ফসল বিনষ্ট হয়ে যায়। ১৯৮৫ সালে এ রোগটি সর্বপ্রথম ব্রাজিলে দেখা দেয়। এরপর এটি দক্ষিণ আমেরিকার কিছু দেশে ছড়িয়ে পড়ে। দক্ষিণ আমেরিকার বাহিরে বাংলাদেশেই এ ভয়াবহ রোগটি সর্বপ্রথম সংক্রমিত হলো। বাংলাদেশে ২০১৬ সালের ফেব্রম্নয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে দক্ষিণাঞ্চলের যশোর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, বরিশাল ও ভোলা জেলায় আনুমানিক ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে এ রোগের আক্রমণ পরিলক্ষিত হয়- যা মোট গম আবাদি জমির প্রায় ৩ শতাংশ। এ রোগে আক্রান্ত গম ক্ষেতের ফলন শতকরা ২৫-৩০ ভাগ হ্রাস পায়। ক্ষেত্র বিশেষে এ রোগের কারণে ক্ষেতের সম্পূর্ণ ফসল বিনষ্ট হয়ে যায়। এ রোগের জীবাণু বীজ ও বাতাস বাহিত। এ রোগের জীবাণু অন্য কোনো দেশ থেকে বাতাসের মাধ্যমে আমাদের দেশে আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বরং বীজ কিংবা খাদ্যশস্যের মাধ্যমে রোগের জীবাণু দেশে প্রবেশ করে থাকতে পারে। গবেষণায় প্রতিয়মান হয়, বাংলাদেশে সংক্রমিত বস্নাস্ট রোগের ছত্রাক ব্রাজিলে বিদ্যমান ছত্রাকের অনুরূপ। গমের এই ভয়ংকর রোগটি বিদেশ থেকেই বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে বলে সংশ্লিষ্ট গবেষক ও উদ্ভিদ রোগতত্ত্ববিদদের ধারণা।

সাম্প্রতিক সময়ে সারাদেশে জায়ান্ট মিলিবাগের আক্রমণ সম্পর্কে আমরা সবাই অবহিত এবং আতংকিত। এ পোকাটি আমাদের দেশের নয়। কারো কারো মতে পোকাটি এসেছে আফ্রিকা থেকে আবার কারো মতো ভারত কিংবা পাকিস্তান থেকে। এই ক্ষতিকর পোকাটির দেহের বাহিরে কীটনাশক প্রতিরোধী মোমের আবরণ থাকায় কোনো কীটনাশক দিয়ে সহজে একে মারা যায় না। আবার বছরের অধিকাংশ সময় পোকাগুলো মাটির নিচে থাকায় এদের সহজে দমন করা যায় না। দেশীয় মিলিবাগ থেকে কয়েকগুণ বড় দেশের বাহির থেকে আসা বেশ বড় আকারের পাখাবিহীন এ পোকটি অতি অল্পসময়ে যেভাবে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে তাতে ভবিষ্যতে এর আক্রমণে ভয়াবহ ফসলহানি ও বিপর্যয়ের আশঙ্কা থেকেই যায়। এছাড়াও সম্প্রতি টমেটোতে এক নতুন ধরনের লিফ মাইনার পোকার সংক্রমণ পরিলক্ষিত হয়েছে। দেশের ভুট্টা ফসলে তেমনি আরেকটি নতুন পোকা ফল আর্মি ওয়ার্ম। পৃথিবীর অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও এই নতুন পোকাটির সংক্রমণ ঘটেছে।

বেশ কয়েক বছর আগ থেকেই দেশে ছড়িয়ে পড়েছে ক্ষতিকর আগাছা পার্থেনিয়াম। ধারণা করা হয়, গবাদিপশু ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এই আগাছার অনুপ্রবেশ ঘটেছে ভারত থেকে। আর এজন্য সীমান্তবর্তী জেলাসমূহে এর প্রাদুর্ভাব বেশ লক্ষণীয়। এটি একদিকে যেমন ফসলের ক্ষতি করে থাকে, তেমনি আবার গবাদিপশু ও মানবদেহে স্বাসনালির এলার্জি সৃষ্টি করে থাকে। অতি মাত্রায় এলিলোপ্যাথিক ক্রিয়া'র কারণে এই আগাছাটি ফসলের জমিতে মারাত্মক ফসলহানি ঘটায়। আবার এটি সহজে দমনও করা যায় না। এই আগাছাটিকে বিশ্বে ফসল ও জীববৈচিত্র্যের জন্য বড় হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

নিত্যনতুন পোকামাকড় বা রোগবালাইয়ের সংক্রমণ দেশে নতুন কিছু নয়। ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখি, ধানের টুংরো ভাইরাস আমাদের দেশে এসেছে ষাটের দশকে। বস্নাস্ট রোগের জীবাণুও আসে একই ধরনের উচ্চফলনশীল ধানের বীজের মাধ্যমে। একইভাবে কলার বাঞ্চি টপ ভাইরাস বিদেশ থেকে আনা কলার চারার মাধ্যমে এবং আলুর নাবীধসা রোগ বিদেশ থেকে আনা বীজ আলুর মাধ্যমে দেশে প্রবেশ করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হাইব্রিড ধানে ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ বিএলবি ও বিএলএস'র প্রাদুর্ভাব বেশ লক্ষণীয়। অনেকের মতে এর জন্য দায়ী বিদেশ থেকে আমদানি করা হাইব্রিড ধানের বীজ। এভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ফল ও ফসলের নতুন নতুন জাতের সঙ্গে, বীজের সঙ্গে কিংবা চারার সঙ্গে দেশে অনুপ্রবেশ করছে নতুন নতুন পোকামাকড় ও রোগবালাই। এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পোকামাকড় ও রোগজীবাণুর অনুপ্রবেশ প্রতিরোধের জন্য রয়েছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সুনির্দিষ্ট কিছু আইন কানুন।

বিশ্বে সর্বপ্রথম ১৯৯৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে সঙ্গনিরোধ কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯১৪ সালে ব্রিটিশ সরকার পাক-ভারত উপমহাদেশে এ সংক্রান্ত 'দ্য ডেস্ট্রাস্কিভ ইনসেক্ট অ্যান্ড পেস্ট অ্যাক্ট' জারি করে। ১৯৬৬ সালে উপরোক্ত অ্যাক্টের বিস্তারিত আইন পাস হয় এবং ১৯৮৯ সালে তা পুনরায় সংশোধিত হয়। গত ২০১১ সালের ২০ মার্চ জাতীয় সংসদে অনুমোদনহীন উদ্ভিদজাত দ্রব্যাদি আমদানি-রপ্তানির জন্য সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদন্ড অথবা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডের বিধান করে 'উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ বিল-২০১১' পাস হয়। বিলটির উদ্দেশ্য ও কারণ সংবলিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, উদ্ভিদ ও উদ্ভিদজাত দ্রব্যাদির আন্তর্জাতিক পরিবহণের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পোকামাকড়, রোগবালাই অনুপ্রবেশ ও বিস্তার রোধ এবং উদ্ভিদের স্বাস্থ্যসুরক্ষাসহ এ সংক্রান্ত আনুষঙ্গিক ও সহায়ক ব্যবস্থাদির উদ্দেশ্যে 'উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ আইন-২০১১' প্রণয়ন করা হয়েছে। ১৯১৪ সালে প্রণীত দ্য ডেস্ট্রাস্কিভ ইনসেক্ট অ্যান্ড পেস্ট অ্যাক্ট-এ রপ্তানি, জাতীয় সঙ্গনিরোধ কর্তৃপক্ষ ও এর কার্যক্রম, বালাই সীমাবদ্ধকরণ এবং নির্মূলকরণ, প্রয়োগকরণ, অপরাধ ও শাস্তি প্রভৃতি বিষয় অন্তর্ভুক্ত না থাকায়, এমনকি আমদানি ও বিধিমালা প্রণয়ন বিষয় নীতিমালা সংক্ষিপ্ত পরিসরে হওয়ায়, বর্তমান কৃষির পরিসরে আইন অমান্যকারী ব্যক্তির জন্য আইন প্রয়োগে নানা ধরনের জটিলতা দেখা দেয়ার কারণে প্রস্তাবিত আইনের ৪১ নম্বর ধারা অনুযায়ী আগের দ্য ডেস্ট্রাক্টিভ ইনসেক্ট অ্যান্ড পেস্ট অ্যাক্ট-১৯১৪ বাতিল করে ৯৭ বছর পর উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ আইন-২০১১ প্রণয়ন করা হয়েছে।

উলেস্নখ্য, আমদানি ও প্রস্তুতে বাধ্যতামূলক নির্দেশনা না থাকায় এবং অপরাধ ও দন্ডের বিধানে মাত্র এক হাজার টাকা জরিমানা নির্দিষ্ট থাকায় ১৯১৪ সালে প্রণীত দ্য ডেস্ট্রাক্টিভ ইনসেক্ট অ্যান্ড পেস্ট অ্যাক্ট বাতিল করা হয়েছে। আইনে আমদানিসংক্রান্ত দুটি এবং অপরাধ ও দন্ডসংক্রান্ত দুটি ধারা ছাড়া বালাই, সীমাবদ্ধ ও নির্মূলকরণ এবং উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কেন্দ্রের কার্র্যক্রম নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো ধারা ছিল না। নতুন প্রণীত এ উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ আইনে উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কার্যক্রম নিয়ে আটটি এবং অপরাধ ও দন্ডসংক্রান্ত ৯টি ধারা রয়েছে। আইনের ২৬ ধারা (সরকারি অনুমোদন ছাড়াই আমদানি, প্যাকেটজাত ও বিপণন) অমান্য কররে দুই বছরের কারাদন্ডসহ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। আইন বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেও দেয়া হবে বিশেষ ক্ষমতা। নতুন আইনের প্রয়োগ হলে ফসল, খাদ্যদ্রব্য এবং জনস্বাস্থ্য হবে আরো সুরক্ষিত। সময়ের প্রয়োজনেই আইনটি মাঠপর্যায়ে দ্রম্নত কার্যকর করা প্রয়োজন।

দেশের উদ্ভিদস্বাস্থ্য, জনস্বাস্থ্য, জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশকে ক্ষতিকর পোকামাকড় ও রোগবালাই থেকে মুক্ত রাখাই উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের সঙ্গনিরোধ কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্য। এছাড়াও আন্তর্জাতিক চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দেশের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমকে গতিশীল করা, জাতীয় কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বৃদ্ধি ও বিশেষজ্ঞ তৈরি করা, কোয়ারেন্টাইন পেস্ট চিহ্নিতকরণের কাজ আধুনিকিকরণ এবং রেগুলেটেড ও নন-রেগুলেটেড পেস্টের তালিকা প্রণয়ন করা, নিরাপদ জীববৈচিত্র্য এবং জীবনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে পেস্ট রিস্ক ম্যানেজমেন্টের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং দেশে ফঙ্গনিরোধ ল্যাবরেটরি আধুনিকীকরণের মাধ্যমে উন্নত মানের রোগবালাই ও পোকামাকড়মুক্ত বীজ আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমকে গতিশীল করা এই সার্ভিসের উদ্দেশ্য।

এই আইনের মাধ্যমে জাতীয় উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হবে। এই কর্তৃপক্ষ অন্য দেশ থেকে বাংলাদেশে সঙ্গনিরোধ বালাইয়ের অনুপ্রবেশ রোধের লক্ষ্যে উদ্ভিদ বা উদ্ভিদজাত দ্রব্যাদি, উপকারী জীবাণু ও প্যাকিং দ্রব্যাদির আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রণসহ ২১টি দায়িত্ব পালন করবে। কৃষি সম্প্র্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মকর্তাকে উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করতে পারবে। উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া উদ্ভিদজাত দ্রব্যাদি আমদানি-রপ্তানি করা যাবে না। এ ছাড়া নিষিদ্ধ দ্রব্য থেকে প্রাপ্ত সব অর্থ ও মুনাফা বাজেয়াপ্ত করা হবে।

ওই আইন বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশের সব সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, নদীবন্দর ও স্থলবন্দরসমূহে পস্ন্যান্ট কোয়ারেন্টাইন সেন্টার রয়েছে। যেখান থেকে উদ্ভিদজাত দ্রবাদি আমদানি ও রপ্তানির জন্য ছাড়পত্র (ফাইটোস্যানিটারি সার্টিফিকেট) প্রদান করা হয়। কিন্তু এখনো কোয়ারেন্টাইন সেন্টারগুলোতে দক্ষ জনবল ও গবেষণাগারের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। উপরন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ ফসলের 'পেস্ট রিস্ক এনালাইসিস' না থাকায় যথাযথ নিয়মে ছাড়পত্র ইসু্য করা যাচ্ছে না। একই কারণে ফল ও ফসলের রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে। আবার আমদানিও থেকে যাচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ।

আমদানিকারক কিংবা রপ্তানিকারক উভয় দেশই ফাইটোস্যানিটারি সার্টিফিকেট প্রদান করে থাকে। আর এ জন্য আমদানি কিংবা রপ্তানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব ধরনের ফল ও ফসলের 'পেস্ট রিস্ক এনালাইসিস' থাকা অপরিহার্য। একটি ফসলের পেস্ট রিস্ক এনালাইসিস হলো কোনো নির্দিষ্ট দেশে নির্দিষ্ট একটি ফসলে কী কী ধরনের রোগজীবাণু, পোকামাকড় এবং আগাছার আক্রমণ হয় তার ডাটাবেজ। আমাদের দেশে এ ধরনের ডাটাবেজ না থাকায় প্রায়শই ফল ও ফসলের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম ব্যাহত হয়। বছর কয়েক আগে বাংলাদেশ থেকে ভুট্টা ও আলু রপ্তানির সময় এ ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়। এছাড়াও ইউরোপের বাজারে লেবু ও পান রপ্তানি নিষিদ্ধ হওয়ার পর এ দুটি ফসলের 'পেস্ট রিস্ক এনালাইসিস' সম্পন্ন করা হয়। অবশ্য পরবর্তী সময়ে ধান, ভুট্টাসহ আরো অনেক ফসলের 'পেস্ট রিস্ক এনালাইসিস' করা হয়। পেস্ট রিস্ক এনালাইসিস না থাকা, গেস্নাবালগ্যাপ বা উত্তম কৃষি চর্চার সার্টিফিকেট না থাকা এবং বালাইনাশকের নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবহারের কারণে বাংলাদেশের রপ্তানিযোগ্য শাকসব্জি, ফল-ফসলসমূহ ইউরোপের অকশন হাউস কিংবা সুপার মার্কেটগুলোতে প্রবেশ করতে পারছে না। বর্তমানে এগুলোর রপ্তানি মধ্যপাচ্য ও ইউরোপের বাংলাদেশি অধু্যষিত স্থানীয় মার্কেটেই সীমাবদ্ধ। তাই অনতিবিলম্বে আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব শাকসব্জি, ফলমূলের 'পেস্ট রিস্ক এনালাইসিস' সম্পন্ন করা প্রয়োজন। অন্যথায় বাংলাদেশ থেকে এগুলোর রপ্তানি সীমাবদ্ধ হয়ে যেতে পারে।

আমাদের দেশে আইনের বাস্তব প্রয়োগ না থাকলেও ইউরোপীয় দেশসমূহ এ ব্যাপারে বেশ সচেতন। ইতিপূর্বে তাদের দেশের জন্য ক্ষতিকর জীবাণুর উপস্থিতি থাকায় যুক্তরাজ্য সরকার বাংলাদেশ থেকে লেবু ও পান আমদানি নিষিদ্ধ করে। বাংলাদেশ পৃথিবীর অতি ঘনবসতিপূর্ণ দেশসমূহের মধ্যে অন্যতম। প্রায় সব মানুষের একই ধরনের খাদ্যের ওপর নির্ভরশীলতা এবং দেশব্যাপী সমধরনের আবহাওয়া বিরাজমান থাকায় যে কোনো সময় কোন একটি ক্ষতিকর পোকামাকড় কিংবা রোগবালাইয়ের আক্রমণ ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। সংকটে ফেলতে পারে আমাদের ফসল, জীববৈচিত্র্য, বাস্তুসংস্থান ও প্রকৃতিকে। তাই আমাদের সতর্ক হতে হবে এখনই। কোনো প্রকার অনাকাঙ্ক্ষিত পোকামাকড়, রোগবালাই, আগাছা যাতে দেশে অনুপ্রবেশ করতে না পারে সেজন্য উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ আইনের বাস্তব প্রয়োগ অপরিহার্য।

লেখক : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে