সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

সরিষা ফুলের অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ সবাই

ইঞ্জিনিয়ার সাজ্জাদ হোসেন
  ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

কুয়াশায় মোড়ানো প্রকৃতি। চারদিকে বিরাজ করছে শীতের আবহ। মাঠে মাঠে শোভা পাচ্ছে হলুদের বিশাল সমারোহ। সরিষা ফুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয় সবাই। সরিষার এই ক্ষেত দূর থেকে দেখলে মনে হয় প্রকৃতি হলুদ চাদর পেতে রেখেছে। শীতকাল আসতেই ফুটে ওঠে সরিষা ফুল। যেদিকেই চোখ যায় শুধু হলুদ আর হলুদ। এই সরিষা ক্ষেত দেখা ও ছবি তুলতে যাওয়ার জন্য অনেকেই খুঁজেন। ঢাকার কাছে কেরানীগঞ্জ, শ্রীনগর, মুন্সীগঞ্জ, সোনারগাঁও, নরসিংদী, হরিরামপুর-ঝিটকা, মানিকগঞ্জ, এলাকায় প্রচুর পরিমাণে সরিষা আবাদ হয়।

শীতের শিশির ভেজা সকালে ঘন কুয়াশার চাদরে মোড়ানো মাঠজুড়ে কেবল চোখে পড়েছে সরিষার হলুদ ফুলের সমারোহ। এই শীতের শিশির ভেজা সকালে সরিষার সবুজ গাছের ফুলগুলো শীতের সোনাঝরা রোদে যেন ঝিকিমিকি করছে। এ যেন এক অপরূপ সৌন্দযের দৃশ্য। দেখে যেন মনে হচ্ছে প্রকৃতিকন্যা সেজেছে হলুদ বরণ। গাঢ় হলুদ বর্ণের সরিষার ফুলে ফুলে মৌমাছিরা মধু সংগ্রহের জন্য গুন গুন করছে। চলছে মধু আহরণের পালা। মৌমাছিরা মধু সংগ্রহে মাঠে নেমেছে। শীতের শিশিরে সিক্ত মাঠভরা সরিষা ফুলের গন্ধ বাতাসে ভাসছে। মানুষের মনকে পুলকিত করছে। সরিষার ক্ষেতগুলো দেখে মনে হয় কে যেন হলুদ চাদর বিছিয়ে রেখেছে। হেমন্তকালের মাঠে মাঠে সবুজের অপার সমারোহ এখন আর নেই। দিগন্তজুড়ে সরিষা ফুলের নয়নাভিরাম দৃশ্য শোভা পাচ্ছে সরিষা ও শীতকালীন সবজি মাঠের শোভা বর্ধন করছে।

বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে শোভা পাচ্ছে সরিষা ফুল। দিগন্ত জোড়া ফসলের মাঠে যতদূর চোখ যায় শুধু হলুদ আর হলুদ। সরিষা ফুলের মৌ মৌ গন্ধ চারদিকে। প্রতিটি মাঠে সরিষার আবাদ হয়েছে চোখে পড়ার মতো। আর অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই কৃষকের ঘরে উঠবে সরিষা। কম খরচে বেশি লাভের আশায় কৃষকরা আগাম জাতের ও অধিক ফলনশীল এই ফসলের চাষ করেছেন। বর্তমানে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার সরিষার বাম্পার ফলন হবে বলে আশা করছেন চাষিরা।

চিকিৎসকরা বলছেন, সরিষা ফুলের সাদা মধুতে গস্নুকোজ ও ফ্রুকটোজ নামক দুই ধরনের সুগার থাকে। এছাড়াও সুক্রোজ ও মালটোজও খুব অল্প পরিমাণে রয়েছে। মধুর শর্করার ঘনত্ব এত বেশি যে, এর মধ্যে কোনো জীবাণু ১ ঘণ্টাও বাঁচতে পারে না। সব বয়সের মানুষ সরিষা ফুলের মধু খেতে পারেন। এতে কোনো ক্ষতি নেই। আর সরিষা ফুলের মধুতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, বি, সি। এই মধু একেবারেই কোলেস্টেরলমুক্ত। বিশেষ করে মধু রোগ প্রতিরোধের শক্তি বৃদ্ধি, হার্ট শক্তিশালী, কোষ্ঠকাঠিন্য ও অনিদ্রা দূর করে। শারীরিক দুর্বলতা দূরসহ পাকস্থলী সুস্থ রাখে। অনেক ওষুধি গুণের এ মধু অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমেই সরিষা ফুলসহ অন্যান্য সময়ে কালোজিরা ফুল, লিচু ও গুজি তেলের ফুল থেকে মৌমাছি দিয়ে মধু সংগ্রহ করে অনেকেই স্বাবলম্বী হয়েছেন। ধামরাই উপজেলার আশুলিয়া গ্রামের হাবিব বলেন, বর্তমানে মৌ খামারে ২০০টি মৌ বক্স রয়েছে। প্রতিটি বক্স থেকে সরিষা ফুলের সময়ে প্রায় ১০ কেজি করে মধু সংগ্রহ করা যায়। প্রায় ১৮ বছর ধরে তারা মৌমাছি থেকে মধু সংগ্রহ করছেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি মৌমাছি পালন ও মধু সংগ্রহ করে তাদের পরিবার স্বাবলম্বী।

মধু সংগ্রহ করতে আসা সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার বেতখালী উত্তরপাড়া গ্রামের সেলিম সর্দার জানান, তারা একই পরিবারের ৫ জন এসেছেন ধামরাই উপজেলার দেপাশাই গ্রামের পাশে সরিষা ক্ষেতে। তারা সরিষা ফুলের কাছে ২৫০টি মৌ বাক্স বসিয়েছেন। তাদের টার্গেট তিন সপ্তাহে প্রায় ৩০ মণ মধু সংগ্রহ করা। এরপর ধামরাই থেকে তারা ফিরে যাবেন ফরিদপুরের চর অঞ্চলে কালোজিরা ফুলের মধু সংগ্রহ করতে। বছরে ৬ মাস চলে এ মধু সংগ্রহ। বাকি সময় নিজ খরচে মৌমাছি লালনপালন করতে হয়। পাবনায় প্রতিটি অঞ্চলেই সরিষা ফুলের মধু সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে স্থানীয় মৌ খামারিরা। ইতোমধ্যে খাঁচা পদ্ধতিতে চাষকৃত মৌমাছির মাধ্যমে সরিষা ফুলের মধু সংগ্রহে ব্যাপক সারা ফেলেছে। জেলার সুজানর, চাটমোহার, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, আটঘড়িয়া উপজেলার প্রতিটি বিল অঞ্চলের সরিষার ক্ষেতের পাশে বসানো হয়েছে মধু সংগ্রহরে মৌ খাঁচা। কৃষি বিভাগের সহযোগিতা ও ব্যক্তি উদ্যোগে প্রায় শতাধিক মৌ খামারি সরিষা ফুলের মধু সংগ্রহ করছেন। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, এবার জেলাতে প্রায় ১০ টন মধু সংগ্রহীত হবে- যার বাজারমূল্য ১০ কোটি টাকা। এদিকে এই মধু স্থানীয়দের চাহিদা মিটিয়ে সরবরাহ হচ্ছে দেশ ও বিদেশে।

জেলার প্রায় প্রতিটি অঞ্চলের কৃষক নিজেদের জমিতে কম বেশি সরিষার আবাদ করে থাকেন। বিশেষ করে বিল অঞ্চলগুলোতে গেলে দিগন্ত মাঠ জুড়ে সরিষা ফুলের হলুদের সমারোহে দৃষ্টি জুড়িয়ে যায়। যেদিকে চোখ যায় সে দিকেই সরিষা ফুল চোখে পড়বে। বিগত দিনগুলোর থেকে বর্তমানে সরিষার আবাদ ও ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এর অন্যতম কারণ ফসলের মাঠের পাশে মৌমাছির খামার। ফসলের মাঠে এই মৌমাছি মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে পরাগায়ন ঘটছে ফসলের। আর এরই কারণে কৃষক স্বাভাবিকের চাইতে অনেক ফলন পাচ্ছে। তাই খাঁচায় মৌমাছি দিয়ে মধু সংগ্রহের মাধ্যমে একদিকে যেমন বহু পুষ্টিগুণ সম্পূর্ণ মধু পাওয়া যাচ্ছে; অন্যদিকে, চাষিদের ফলন বৃদ্ধি পাচ্ছে বহুগুণ।

আমাদের দেশে শীতের সময়ে মধুর ব্যবহার বহুগুণে বেড়ে যায়। আর এই মধুর চাহিদা অনেকাংশ পূরণ হয়ে থাকে সরিষা ফুল থেকে সংগৃহীত মধু। কৃষিসমৃদ্ধ পাবনা জেলাতে তাই শীতের এই সময়ে সরিষা ফুলের মধু দেশের চাহিদা মিটিয়ে সরবরাহ হচ্ছে বিদেশে। জেলাতে এ বছরে সরিষা ফুলের মধু সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ১০ টন। যার বাজারমূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকার মধু সংগ্রহ হবে ধারণা করা হচ্ছে।

পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আব্দুর রহমান বলেন, মধু বহু পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ শক্তিবর্ধক সর্বরোগের মহৌষধ। পাবনা জেলা যেহেতু কৃষিসমৃদ্ধ একটি অঞ্চল। আর এই জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে শীতের এই সময়ে সরিষার আবাদ ব্যাপক হয়ে থাকে। আর এই সরিষা ফুল থেকে মৌ খামারিরা মধু সংগ্রহ করে থাকেন। চাষকৃত বিশেষ জাতের এই মৌমাছি সরিষা ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে খাঁচায় নিয়ে জমা করেন। এর ফলে একদিকে ফসলের পরাগায়নে ফলন বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্যদিকে, মধু সংগ্রহ করে পুষ্টির চাহিদার পাশাপাশি বাড়তি আয় করছে খামারিরা। জেলাতে এবারে প্রায় ১০ টন সরিষা ফুলের মধু সংগ্রহ হবে। যার বাজারমূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা হবে। এই সরিষার মধু দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানি সংগ্রহ করে পক্রিয়াজাত করে বাজারে বিক্রি করছে। জেলাতে প্রায় ৭০ জন খামরি প্রায় ৬ হাজার মৌ বক্স স্থাপন করেছেন। তিনি আরও বলেন, খামারিদের আমরা নানাভাবে সহযোগিতা করছি। প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে মৌ বাক্স সরবরাহ করা হয়ে থাকে কৃষি বিভাগ থেকে। তাই সরিষা ফুল এবং ফল দুটিই আমাদের অর্থনৈতিকভাবে উপকার করছে।

জেলাতে এবার প্রায় সারে ৩১ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। আর প্রায় ৭০ জন তালিকাভুক্ত খামারি জেলার বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় ৬ হাজার এই মৌমাছির বক্স স্থাপন করেছেন। স্থানীয়দের চাহিদা মিটিয়ে এই মধু দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসহ মৌ খামরি ও ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে বলে জানা গেছে।

জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী, মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ, ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, বকশীগঞ্জ ও জামালপুর সদরে সরিষার হলুদ ফুলে ছেয়ে গেছে দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ। অগ্রহায়ণের হিমেল বাতাসে দোল খাচ্ছে হলুদ সরিষার ফুল। সরিষা প্রধানত আবাদ হয় দোআঁশ ও বেলে-দোআঁশ মাটিতে বিশেষ করে নদী বিধৌত এলাকায়। অন্যান্য ফসলের তুলনায় এ অঞ্চলে সরিষা বেশি আবাদ হয়। বর্তমানে সরিষা একটি লাভজনক ফসলে পরিণত হওয়ায় ধীরে ধীরে সরিষা আবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর ২৭ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। অর্জিত হয়েছে ৩২ হাজার ৫০০ হেক্টর। গত বছর নির্ধারণ করা হয়েছিল ২২ হাজার ৫০০ হেক্টর, অর্জিত হয়েছিল ২৩ হাজার ৪০০ হেক্টর। গত বছরের তুলনায় এ বছর সরিষার চাষ বেশি হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে মধুতে প্রায় ৩০ প্রকারের উপকারিতা রয়েছে। বিশেষ করে সুগারের চাহিদা অনেকাংশে পূরণ করে থাকে এই মধু। রেকর্ড পরিমাণ জমিতে সরিষার চাষ হয়েছে। সম্পূরক রবি শস্য হিসেবে সরিষা চাষে কৃষকদের উৎসাহ করা হয়েছে। পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে সরিষা বীজ প্রদান করা হয়েছে। এরই মধ্যে চাষকৃত সরিষার বেশিরভাগেই ফুল এসে গেছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। এবার সরিষা আবাদি কৃষকরা বাড়তি মুনাফা পাবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে