শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১

পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া অর্গানিক পণ্য কিনে প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা

এপ্রিল খাবারের গায়ে অর্গানিক লেখা থাকা মানেই কিন্তু সেগুলো অর্গানিক নয়। বাজারের সব অর্গানিক খাদ্য শতভাগ কেমিক্যালমুক্ত নয়। সাধারণভাবে উৎপন্ন ফল আর সবজির চেয়ে অর্গানিক ফলÑ সবজিতে মাত্র ৩০ ভাগ কীটনাশক কম পাওয়া যায়। তার মানে কীটনাশক ব্যবহৃত হয় না এ ধারণা ভুল
আলতাব হোসেন
  ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া অর্গানিক পণ্য কিনে প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা

শাকসবজি খান, ভালো থাকুন। চাষের স্থান থেকে বাজার, এরপর রান্নাঘর, সবশেষে খাওয়াদাওয়া। সবজি চাষে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কীটনাশক ব্যবহৃত হয়। শুধু সবজি নয়, ফল, ডিম, মাছ ও মাংস সবকিছু কেনার সময়ই মনে কাজ করে এক ধরনের আতঙ্ক ফরমালিন কিংবা কীটনাশক মেশানো নেই তো? অনেকেই এখন মনের দ্বিধা কাটানোর জন্য সবজি রান্না করার আগে লবণ-পানিতে অথবা ভিনেগার মেশানো পানিতে বেশ কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রাখেন। এই সুযোগে অর্গানিক খাবারের ব্যবসা বেশ জমে ওঠেছে। পরীক্ষানিরীক্ষা ছাড়াই মুখের কথাই মানুষ অর্গানিক পণ্য কিনে প্রতারিত হচ্ছেন। সাধারণত যেসব খাদ্য উৎপাদনে কোনো ধরনের রাসায়নিক সার, অ্যান্টিবায়োটিক, হরমোন বা কীটনাশক ব্যবহার হয় না তাদের আমরা বলি অর্গানিক ফুড। এ খাবারগুলো হয় সারবিহীন। আর যদি ব্যবহার হয়েও থাকে তা জৈব সার। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবে এসব পণ্য উৎপন্ন করা হয়। অর্গানিক পণ্যে জেনিটিক্যালি মোডিফাইড অর্গানিজম (জিএমও) থাকে না। অর্গানিক পণ্যের তালিকায় যেমন তাজা সবজি বা ফল রয়েছে, তেমনি আছে মাংস এবং দুগ্ধজাত পণ্য। ক্র্যাকার, পানীয়, ফাংশনাল ফুড এবং হিমায়িত খাবারের মতো পণ্যও অর্গানিক হতে পারে। তবে অবশ্যই তা অর্গানিক খাদ্যের সবগুলো শর্ত মানতে হবে। খাবারের গায়ে অর্গানিক লেখা থাকা মানেই কিন্তু সেগুলো অর্গানিক নয়। বাজারের সব অর্গানিক খাদ্য শতভাগ কেমিক্যালমুক্ত নয়। সাধারণভাবে উৎপন্ন ফল আর সবজির চেয়ে অর্গানিক ফল- সবজিতে মাত্র ৩০ ভাগ কীটনাশক কম পাওয়া যায়। তার মানে কীটনাশক ব্যবহৃত হয় না এ ধারণা ভুল। একটু কঠিন হলেও অর্গানিক ফুড উৎপন্ন করা সম্ভব। অর্গানিক হওয়ার মানদন্ডগুলো পূরণ করলে তাকে অর্গানিক ফুড বলতে পারি। বাংলাদেশ অর্গানিক গ্রোডাকশন ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের মতে, জৈব প্রক্রিয়ায় চাষের জন্য প্রধানত পাঁচটি মাদন্ড মানা জরুরি। এগুলো হচ্ছে- কমপক্ষে ৩ বছর জমি রাসায়নিকমুক্ত থাকতে হবে। ১০ মিটার জমি রাসায়নিকমুক্ত হতে হবে। সার ব্যবহার করা হলে তা হতে হবে পরিবেশবান্ধব। সেচ পদ্ধতি নিরাপদ হতে হবে ও বীজও হতে হবে অর্গানিক। কোনো অর্গানিক ফুড কেনার আগে তা সরকারের ন্যাশনাল প্রোগ্রাম ফর অরগানিক প্রোডাকশন (ঘচঙচ) এর স্বীকৃত কোনো সংস্থার দ্বারা পরীক্ষা করার পর প্রশংসাপত্র সার্টিফিকেট পেয়েছে কিনা তা দেখে নিন। যদি পণ্যটি এ সার্টিফিকেট পেয়ে থাকে তবে লেভেলে ইউএসডিএ অর্গানিক (টঝউঅ ড়ৎমধহরপ) লোগো থাকবে। কিংবা যে সংস্থা সার্টিফিকেট দিয়েছে তার লোগো থাকবে। খাঁটি অর্গানিক পণ্যের ইইউ এবং জ্যাস সনদ থাকবে। অর্গানিক ফুড বা পণ্য কেনার সময় এ বিষয়গুলো খেয়াল রাখলে খাঁটি পণ্য কেনা সহজ। জীবন ধারণের জন্য প্রতিদিন খাবার গ্রহণ করে থাকি। সুস্থ সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য যার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম- যা আমাদের দেহের ক্ষয় পূরণ, বৃদ্ধি সাধন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। কিন্তু আমরা প্রতিদিন যেসব খাদ্য গ্রহণ করি তা কি আসলেই নিরাপদ? বিশ্বব্যাপী বর্তমানে নিরাপদ খাদ্য এবং এর উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যাপক আলোচিত হচ্ছে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন লক্ষণীয়। অল্প সময়ে ও অল্প জায়গায় অধিক লাভের আশায় বর্তমানে কৃষকরা বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক সার ও কীটনাশক অধিক মাত্রায় ব্যবহার করে থাকেন। এর কারণ হলো দেশের অধিকাংশ কৃষক জানেই না যে, রাসায়নিকের সারের কী ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া রয়েছে। তারা অনেকেই মনে করেন প্রচুর পরিমাণে জমিতে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করলেই অধিক ফসল ঘরে তোলা সম্ভব। কিন্তু তাদের এই মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার প্রয়োগের ফলে প্রভাব পড়তে পারে মাটি, পানি, পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য সর্বোপরি মাটির উবর্রতায়। স্বাস্থ্যের ব্যাপারে বেশ সচেতন ব্যাংকার সফিকুর রহমানের। ফল হোক বা সবজি অর্গানিক কেনা চাই তার। সুপার শপ থেকে বেছে বেছে সতেজ আর অর্গানিক সব পণ্য কেনেন তিনি। শুধু কি কাঁচা খাবার? চাল, ডাল থেকে শুরু করে হলুদ গুঁড়া, মরিচ গুঁড়া সবকিছুই অর্গানিক দেখে বাড়তি দামে কেনেন তিনি। দাম কিছুটা বেশি পড়লেও সুস্বাস্থ্যের কথা ভেবে তা মেনে নেওয়া যায়- এমনটাই দাবি তার। সফিকুর রহমানের মতো অনেকেই সুস্থ থাকতে অর্গানিক সব খাবার বেছে নেন। বাজারে এখন এমন পণ্য বেশ সহজলভ্যও বলা যায়। তবে লেভেলে অর্গানিক লেখা থাকলেই কি সব পণ্য অর্গানিক? একটি পণ্য অর্গানিক হওয়ার পূর্বশর্তগুলো কি ঠিকমতো মানছে এসব পণ্য? অর্গানিক ফুডের বাংলা জৈব খাদ্য। সাধারণত যেসব খাদ্য উৎপাদনে কোনো ধরনের রাসায়নিক সার, অ্যান্টিবায়োটিক, হরমোন বা কীটনাশক ব্যবহার হয় না তাদের অর্গানিক ফুড বলা হয়। এই খাবারগুলো হয় সারবিহীন। আর যদি ব্যবহার হয়েও থাকে তা জৈব সার। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবে এসব পণ্য উৎপন্ন করা হয়। খাবারের গায়ে অর্গানিক লেখা থাকা মানেই কিন্তু সেগুলো অর্গানিক নয়। দ্য টেলিগ্রাফে ২৩৭টি গবেষণার রিভিউ নিয়ে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। এতে দেখা যায়, বাজারের সব অর্গানিক খাদ্য শতভাগ কেমিক্যালমুক্ত নয়। সাধারণভাবে উৎপন্ন ফল আর সবজির চেয়ে অর্গানিক ফল-সবজিতে মাত্র ৩০ ভাগ কীটনাশক কম পাওয়া গেছে। তার মানে কীটনাশক ব্যবহৃত হয় না এ ধারণা ভুল। তবে কি শতভাগ অর্গানিক খাদ্যের বিষয়টি কেবলই মিথ্যা? না। একটু কঠিন হলেও অর্গানিক ফুড উৎপন্ন করা সম্ভব। অর্গানিক হওয়ার মানদন্ডগুলো পূরণ করলে তাকে অর্গানিক ফুড বলতে পারেন। অনেকেই মনে করে চাষাবাদে রাসায়নিক সার বা কীটনাশক ব্যবহৃত হয়নি মানেই পণ্যটি অর্গানিক। কেবল এই একটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে কোনো কৃষিপণ্যকে অর্গানিক বলা যায় না। অর্থাৎ, চাষাবাদে রাসায়নিক সার অথবা কীটনাশক ব্যবহৃত হয়নি- কেবল এই দিকটিই একটি কৃষিপণ্যের অর্গানিক হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। বিলে প্রাকৃতিক উপায়ে মাছ চাষ করা হয়। কিন্তু এর পাশে থাকা শস্যখেতে রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়। আর বৃষ্টিতে সেই সার এসে মেশে বিলে। তাহলে কিন্তু এই মাছকে অর্গানিক বলা যাবে না। খাদ্যে ভেজাল এখন 'ওপেন সিক্রেট'। মেশিনে কাটা চালে ক্ষতিকর মোম পলিশ করা হচ্ছে, মাছে দেয়া হচ্ছে ফরমালিন, মুরগি ও মাছকে যে খাবার খাওয়ানো হয় তাতে মেশানো হচ্ছে ক্ষতিকর রাসায়নিক, বাজারের বিভিন্ন সয়াবিন তেল প্রস্তুত হয় উচ্চতাপে যা মারাত্মক ক্ষতিকর; ফলমূলে মেশানো হচ্ছে ইডেন, টমটম, ফরমালিন, ক্যালসিয়াম কার্বাইডসহ নানা রাসায়নিক। আর এ খাবার খেয়ে মানুষ বিভিন্ন ধরনের অসুখে আক্রান্ত হচ্ছেন। তাই বাধ্য হয়ে তারা খাঁটি বা নিরাপদ খাবারের দিকে ঝুঁকছেন। আর তাদের এ চাহিদা পূরণে 'অর্গানিক খাবার', 'খাঁটি খাবার', 'বিষমুক্ত খাবার', 'নিরাপদ খাবার'- এমন চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে কিছু প্রতারক প্রতিষ্ঠান মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে যাচ্ছে। তাই মানুষ এ সময়টিতে অনলাইনসহ নানা উপায়ে এ ধরনের খাবার সংগ্রহ করছেন। তবে যেসব উদ্যোক্তা নিরাপদ খাবার নিয়ে এগিয়ে এসেছেন তাদের খাবারের গুণগত মান ঠিক আছে কিনা তা যাচাই-বাছাই করতে মনিটরিং প্রয়োজন বলে মনে করছেন ক্রেতারা। দেশপ্রেম ও সতি সত্যি অর্গানিক পণ্য উৎপাদন করলে বদলে দিতে পারে কৃষিপণ্য রপ্তানি আয়ের চিত্র। বিশ্বে অর্গানিক পণ্যের বাজার ১০ লাখ কোটি টাকার। এতে বাংলাদেশের অংশ খুবই সামান্য। দেশের বাজারে অর্গানিক পণ্যের নামে যা বিক্রি হচ্ছে তা প্রকৃতপক্ষে কতটা অর্গানিক তা নিরীক্ষার জন্য সরকারের কর্তৃপক্ষ নেই। ফলে রপ্তানিও কম। সারা বিশ্বেই রাসায়নিক সার ও কীটনাশক মুক্ত অর্গানিক খাবারের চাহিদা বাড়ছে। তবে দেশের শহরাঞ্চলে অর্গানিক পণ্য বিক্রি হচ্ছে। এসব খাদ্য প্রকৃতপক্ষে অর্গানিক কিনা? চাষাবাদে সেই মান বজায় রাখা হয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখার কিংবা নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো কর্তৃপক্ষ এখনো গড়ে উঠেনি৭। অর্গানিক ফুড জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদিত খাদ্যের প্রতি সারা পৃথিবীর মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। অর্গানিক ফার্মিং থেকেই অর্গানিক ফুড বা জৈব খাদ্য তৈরি হয়। রাসায়নিক সার দিয়ে ফসল চাষাবাদ পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ফসল উৎপাদন খরচও বেশি হয়। জৈব সার দিয়ে ফসল চাষাবাদ পরিবেশসম্মত ও উৎপাদন খরচ কম হয়। উৎপাদিত খাদ্য স্বাস্থ্যসম্মত। বাংলাদেশে শাকসবজি উৎপাদনে প্রচুর রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করায় ইউরোপের দেশগুলো এ দেশ থেকে শাকসবজি ক্রয়ে অনীহা প্রকাশ করেছে। জৈব উপায়ে খাদ্য শস্য ও শাকসবজি উৎপাদন খরচ কম অথচ বেশি দামে দেশে ও বিদেশে বিক্রির যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছে, অধিক উৎপাদনের আশায় দেশে উচ্চফলনশীল হাইব্রিড ও জিএম শাকসবজিসহ অন্যান্য ফসল ও ফলমূল উৎপাদনে ঝুঁকছে কৃষক। এসব পদ্ধতিতে দফায় দফায় প্রয়োগ করা হচ্ছে বিষাক্ত কীটনাশক। আবার বাজারজাত করার আগে পাকানোর জন্য কার্বাইডসহ পচন রোধে অতিমাত্রায় রাসায়নিক প্রয়োগ করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার জন্য শাকসবজি ও ফলমূলে মেশানো হচ্ছে নানা বিষাক্ত রঞ্জক- যা ওই সব খাদ্যের সঙ্গে মানবদেহে প্রবেশ করছে। এসব খাদ্য খেয়ে কমে যাচ্ছে জীবনী শক্তি ও আয়ুষ্কাল। সঙ্গে শরীরে ক্যানসারের মতো ভয়াবহ রোগসহ নানাবিধ রোগব্যাধির প্রকোপ বাড়ছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে