বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

শুদ্ধ ভাষাচর্চা ও আমাদের ক্যাম্পাস

মুসাদ্দিকুল ইসলাম তানভীর
  ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০

'শহীদের ঝলকিত রক্তের বুদ্বুদ, স্মৃতির গল্পে ভরপুর, একুশের কৃষ্ণচূড়া আমাদের চেতনার রং'- কবি শামসুর রাহমানের কবিতার পঙ্‌ক্তির মতো বছর পেরিয়ে প্রকৃতিতে ফাগুন এসেছে। পথের ধারে সজ্জিত কৃষ্ণচূড়ার লাল, বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে বেদনাবিধুর স্মৃতি আর সংগ্রামী চেতনার অমীয় ধারা বহন করে চলা অমর একুশে ফেব্রম্নয়ারির কথা।

ফেব্রম্নয়ারি। ভাষার মাস। এই মাসটা এলেই যেন আমরা বাংলা ভাষার প্রতি লুকানো ভালোবাসা খুঁজে ফিরি, সন্ধান করি শেকড়ের। মনে পড়ে ভাষার জন্য শহীদদের আত্মত্যাগের কথা। 'আরেক ফাল্গুন', 'জীবন থেকে নেয়া', 'কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি', 'কবর'- সারা বছর মনের অজান্তে, ব্যস্ততার অজুহাতে পৃষ্ঠ বইগুলোর ধুলো মুছে আবারও প্রশান্তি খোঁজার চেষ্টা এই ফেব্রম্নয়ারি মাস। তবে এখানে প্রশ্ন থেকে যায়, ভাষার জন্য আন্দোলন বা চেতনা লালন কি শুধুই বিশেষ একটি দিবস বা মাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ? মায়ের ভাষার সতীত্ব রক্ষায় নির্মম মৃতু্য-ভয়-নির্লিপ্ত দুর্জয় সন্তানদের রক্তের প্রতিদান কি শুধু একটি প্রভাতে নগ্নপায়ে হেঁটে বেদিতে ফুল দেওয়া? উত্তরটি যদি 'না' হয়, তবে বর্তমান প্রজন্মের একটি বড় অংশের বাংলা বর্ণমালা না চেনার পরও কেন কারও কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। বাংলা ভাষাকে নিয়ে প্রচন্ড গৌরব করা অতুল প্রসাদ সেনের পরবর্তী প্রজন্ম কেন আজ বাংলা বলতে হীনম্মন্যতায় ভোগে! এটি নিঃসন্দেহে চরম অপমানের, চরম লজ্জার। রক্ত দিয়ে ভাষা কিনে আনা একমাত্র জাতি আর ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সম্মান- এসব বড়াই এখন কেবল ফেসবুক আর ভাষণেই। বাস্তবতা হলো বাংলার প্রকৃত মর্যাদা রক্ষায় যে শুদ্ধ পরিচর্যার প্রয়োজন, তার বড্ড অভাব। অপসংস্কৃতি আর আধুনিকতার আগ্রাসনে বিকৃত, বিকৃত, চরম বিকৃত বাংলা ভাষা আজ সাগরের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হয়ে একটুখানি খড়কুটোর আশায়।

সময় নেই, বাঁচাতে হবে, প্রাণ ফেরাতে হবে প্রাণের বাংলা ভাষার, করতে হবে সঠিক পরিচর্যা। সে ক্ষেত্রে বড় একটি নিয়ামক হতে পারে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। তারুণ্যে উদ্দীপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই আগামীর দেশ গড়ার কারিগর। তাদের হাত ধরেই সূচিত হতে পারে বিপস্নব। ইতিহাস অন্তত সেই কথাই বলে।

দেশের স্বাধীকার লড়াইয়ের প্রায় সব আন্দোলন-সংগ্রামের বীজ বোনা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ থেকেই। রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে ১৯৪৮ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বক্তব্যের প্রথম তীব্র প্রতিবাদ জানায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। তমুদ্দীন মজলিস, রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ প্রভৃতি সংগঠন ছাত্ররাই গড়ে তোলে। ভাষার দাবিতে আপসহীন ছাত্রসমাজই একুশে ফেব্রম্নয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করতে উদ্যমী হয়েছিল। এমনকি ভাষা শহীদদের মধ্যে বরকত, রফিক আর শফিউর ছিলেন ছাত্র।

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য অকুতোভয় ছাত্রসমাজ রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করেছে। তাদের দেখানো পথ ধরে মাটিতে লুটোপুটি খাওয়া বাংলা ভাষার মর্যাদা ফিরিয়ে আনতে আবারও এগিয়ে আসতে হবে তরুণদের। প্রতিটি ক্যাম্পাসে হতে হবে শুদ্ধ বাংলা ভাষার চর্চা।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, শুদ্ধ বাংলা ভাষা চর্চার দিক দিয়ে ক্যাম্পাসগুলো অনেক বেশি উদাসীন। বর্তমান সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠদানের মাধ্যম ইংরেজি। উচ্চশিক্ষায় বাংলা ভাষা প্রবর্তনের দাবি মাঝেমধ্যে দু-একবার উচ্চারিত হলেও কখনোই জোরালো হয়নি। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের দাবি জানানো সংগঠনগুলোও ফেব্রম্নয়ারি ছাড়া সারা বছর নিষ্প্রভ। যে সব ক্যাম্পাসে ভাষা শিক্ষার জন্য বিশেষ কোনো ক্লাব বা সংগঠন রয়েছে, সেগুলোর নামও আবার ইংরেজিতে। তার চেয়েও অবাক করা বিষয় হলো অনেক শিক্ষার্থীই আছেন, যারা ভিনদেশি ভাষাকে বিশেষত ইংরেজিকে ব্যক্তিত্বের মানদন্ড মনে করে থাকে। দেশি ভাষা, মায়ের ভাষার চেয়ে তাদের কাছে ধার করা ভিনদেশি ভাষাতেই কেন জানি বেশি স্বাচ্ছন্দ্য। শুনে চোখ কপালে উঠতেই পারে। কারণ মাতৃভাষা যে মাতৃদুগ্ধের মতো।

তাই পাশ্চাত্য সংস্কৃতি আর তথাকথিত আধুনিকতার স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কেটে আমাদের বাংলাকে ধরে রাখতে হবে। ক্যাম্পাসে শুরু করতে হবে সুস্থ সংস্কৃতি লালনের অভ্যাস। যে কোনো দাপ্তরিক চিঠি-পত্র, নির্দেশিকা, প্রজ্ঞাপন, অবেদনপত্রসহ সবক্ষেত্রে শুদ্ধ বাংলা ব্যবহারের অগ্রাধিকার নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। মুক্ত জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাইকে শুদ্ধ বাংলা ভাষা লেখনীর মাধ্যমে বাংলার প্রতি মমত্ব প্রকাশে এগিয়ে আসতে উদ্যমী হতে হবে। বাংলা ভাষায় বিভিন্ন প্রকাশনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন ও শুদ্ধ ভাষাচর্চা কেন্দ্র স্থাপনপূর্বক নিয়মিত কর্মসূচি প্রণয়ন প্রভূত বিষয়াদির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বস্তরে সবার মধ্যে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিচর্চাকে উজ্জীবিত রাখার মাধ্যমে বাংলা ভাষার ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে অন্তরে লালন করা এবং প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দেওয়া একান্ত প্রয়োজন।

ভাষার প্রতি গভীর অনুরাগ থেকেই বেরিয়ে আসতে হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ভিনদেশি ভাষার গান বাজানোর প্রবণতা থেকে। চায়ের কাপের আড্ডায়, শ্রেণিকক্ষের বাইরে কোনো সভা-সমাবেশ কিংবা প্রিয়জনকে মনের কথা জানানোর বহিঃপ্রকাশে হোক শুদ্ধ বাংলা ভাষার চর্চা। জগাখিচুড়ি মিশ্রিত, বিকৃত আর অশ্রাব্য ভাষা কলুষিত করছে আমাদের মস্তিষ্ককেও। অথচ ক্যাম্পাসের শিক্ষক, শিক্ষার্থী সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় ভাষার সঠিক পরিচর্যার জন্য প্রয়োজন শুধু একটুখানি আন্তরিকতা। হোক না সমুদ্রপথের ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ অন্ধকার রাতের আশার প্রদীপ, ক্যাম্পাসগুলো হোক বাংলার দিক-নির্দেশক আলোকবর্তিকা।

বাংলা ভাষার বর্তমান প্রেক্ষাপটের বিচারে বাংলাকে রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার। সারা বিশ্বজুড়ে 'বাংলার ফেরিওয়ালা' হয়ে সম্মান বয়ে আনা প্রজন্ম তৈরিতে সোচ্চার হতে হবে এখনই। অন্যথায়, সালাম, বরকতদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করে মেরুদন্ডহীনভাবে, নির্লজ্জের মতো পরভাষাচর্চা অবশ্যম্ভাবী ছোট্ট বাংলাদেশের উঁচু মাথাকে ভূপতিত করবে। কোনটি বেছে নেবেন আপনি? 'আমি সব দেখে-শুনে খেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার' বলা গৌরব নাকি 'আমার ছেলেটার বাংলাটা ঠিক আসেনা' বলা চরম লজ্জা আর আক্ষেপ। সিদ্ধান্ত আপনার।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে