সোমবার, ২৭ মার্চ ২০২৩, ১৩ চৈত্র ১৪২৯
walton

কৃষ্ণচূড়ার রঙে রঙিন আড্ডা

গ্রীষ্মের তপ্ত রোদে চোখ ধাঁধানো টুকটুকে সিঁদুর লাল কৃষ্ণচূড়ার সাজে সেজেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো ক্যাম্পাস। কৃষ্ণচূড়ার লাল রঙের আভায় পুরান ঢাকার এক টুকরো সবুজের প্রাণকেন্দ্র জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সেজেছে এক বর্ণিল সাজে। সবুজের বুক চিরে উঁকি দিয়েছে রক্তিম লাল আভা, চারদিকে ফুটেছে চোখ জুড়ানো রংমশাল, ডাল মেলেছে রক্তলাল কৃষ্ণচূড়া
মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিম
  ১১ জুন ২০২২, ০০:০০

গন্ধে উদাস হাওয়ার মতো উড়ে, তোমার উত্তরী কর্ণে তোমার কৃষ্ণচূড়ার মঞ্জুরি- বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এমন লেখায় ফুটে ওঠে প্রকৃতিতে কৃষ্ণচূড়ার সৌন্দর্যতা। কবির এই লেখনীর মতোই লাল রঙের কৃষ্ণচূড়ার অপূর্ব বাহারি দৃশ্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য ও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আকাশে গনগনে সূর্য, কাঠফাটা রোদ্দুরে তপ্ত বাতাস, প্রকৃতি যখন প্রখর রৌদ্রে পুড়ছে, কৃষ্ণচূড়া ফুল তখন জানান দেয় তার সৌন্দর্যের বার্তা। যেন লাল রঙে কৃষ্ণচূড়ার পসরা সাজিয়ে বসে আছে পুরো ক্যাম্পাস, যা যে কারও চোখে এনে দেয় শিল্পের দ্যোতনা। যেন রক্তিম আভার এক স্বর্গপুরী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

গ্রীষ্মের তপ্ত রোদে চোখ ধাঁধানো টুকটুকে সিঁদুর লাল কৃষ্ণচূড়ার সাজে সেজেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো ক্যাম্পাস। কৃষ্ণচূড়ার লাল রঙের আভায় পুরান ঢাকার এক টুকরো সবুজের প্রাণকেন্দ্র জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সেজেছে এক বর্ণিল সাজে। সবুজের বুক চিরে উঁকি দিয়েছে রক্তিম লাল আভা, চারদিকে ফুটেছে চোখ জুড়ানো রংমশাল, ডাল মেলেছে রক্তলাল কৃষ্ণচূড়া। আবির রঙা করে ফোটে কৃষ্ণচূড়া, আর বাতাসে ভাসে তার পাপড়ি। তপ্ত গ্রীষ্মের এই নিষ্প্রাণ রুক্ষতা ছাপিয়ে ক্যাম্পাসের কৃষ্ণচূড়া গাছগুলো নিজেদের মেলে ধরে আপন মহিমায়। সবুজ পাতার ফাঁকে উজ্জ্বল লাল রঙের কৃষ্ণচূড়ার অপূর্ব বাহারি দৃশ্য প্রত্যেকের নয়ন জুড়ায়। এ যেন ফুল-পাতা দিয়ে গড়া প্রকৃতির এক স্বর্গরাজ্য।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ফটক, সমাজকর্ম ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সামনে, ভাষা শহীদ রফিক পাশে, শান্ত চত্বর, ক্যাফেটোরিয়ার সামনে, মুক্তমঞ্চের আশপাশে, সাইন্স ফ্যাকাল্টি পুরোটাজুড়ে ও একাডেমিক ভবনের পেছনসহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় কৃষ্ণচূড়া গাছের রাঙা ফুল প্রকৃতির সব রংকে ম্স্নান করে দিয়েছে। ক্যাম্পাসের বিজ্ঞান অনুষদ চত্বর, প্রশাসনিক ভবনের পাশে ডালপালা ছড়ানো বিশাল আকৃতির কৃষ্ণচূড়াগুলো সৃষ্টি করেছে রক্তিম বর্ণের এক মোহনীয়তা। ছোট্ট এ ক্যাম্পাসের কৃষ্ণচূড়াগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। সকালে গাছের নিচে কৃষ্ণচূড়ার ঝরে পড়া রক্ত লাল পাপড়ি যেন পুষ্প শয্যা। এসব কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে শিক্ষার্থীরা আড্ডা আর খুনসুটিতে মেতে উঠেছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী বা ক্যাম্পাসের সম্মুখের মহাসড়ক দিয়ে যাওয়ার পথে যে কোনো পথচারীরই হৃদয় কাড়ে নয়ন জুড়ানো এসব কৃষ্ণচূড়া ফুল। কৃষ্ণচূড়ার নজরকাড়া সব ছবি ঘুরছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রম্নপেও। এর মধ্যে 'জেএনইউ ইনসাইডার্স' নামক ফেসবুক পেজে নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোমুগ্ধকর কৃষ্ণচূড়া ফুলের ছবি পোস্ট করা হচ্ছে।

গ্রীষ্মের দাবদাহের মধ্যেও আনন্দ দেয় চোখ ধাঁধানো লাল টুকটুকে কৃষ্ণচূড়া। ক্যাম্পাসকে আগলে রাখে সৌন্দর্য ছড়িয়ে। কৃষ্ণচূড়াকে ঘিরে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে কেউ একজন গান ধরে, সে গানের সঙ্গে সুর মেলায় অন্যরা। কবিতার আবৃত্তির মধ্যে ক্যাম্পাসের কৃষ্ণচূড়ার সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। কেউ আবার ফুল দিয়ে প্রিয় মানুষটিকে রাগ ভাঙিয়ে দেয়। আর এভাবেই কৃষ্ণচূড়া প্রতিবছর গ্রীষ্মে সৌন্দর্য ছড়িয়ে দেয় পুরো ক্যাম্পাসজুড়ে। গ্রীষ্মের উত্তাপের মধ্যেও কৃষ্ণচূড়ায় শোভিত বিস্তর প্রাঙ্গণ ক্যাম্পাসকে অপরূপ সৌন্দর্য প্রদান করেছে। যেন ক্যাম্পাসে আসা শিক্ষার্থীদের প্রকৃতির অপরূপ রূপে রাঙিয়ে দিতেই এই আয়োজন। বৃক্ষ রাজির মধ্যে অনন্য আকর্ষণ এই কৃষ্ণচূড়া গাছ। এ যেন কৃষ্ণচূড়ার ক্যাম্পাস। প্রতিবছর গ্রীষ্মের শুরুতেই পুরো ক্যাম্পাসে মুগ্ধতা ছড়ায় কৃষ্ণচূড়া ফুল। সূর্যের সবটুকু আলো গ্রহণ করে নিজেকে মেলে ধরতে সহমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

কৃষ্ণচূড়ার বৈজ্ঞানিক নাম ডেলোনিক্স রেজিয়া। এটি সিসালপিনিয়েসি গোত্রের অন্তর্গত একটি উদ্ভিদ। যার আদি নিবাস আফ্রিকার মাদাগাস্কার। কৃষ্ণচূড়া গাছের আরেক নাম গুলমোহর। যদিও তা কম লোকই জানেন, কিন্তু কৃষ্ণচূড়াকে চেনেন না এমন লোক খুঁজে পাওয়া দায়। কৃষ্ণচূড়াকে সাধারণত আমরা লাল রঙেই দেখতে অভ্যস্ত হলেও উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা বলছেন, কৃষ্ণচূড়া লাল, হলুদ ও সাদা রঙেরও হয়ে থাকে। তবে আমাদের দেশে লাল ও হলুদ রঙের ফুল দেখা গেলেও সাদা রঙের কৃষ্ণচূড়া দেখাই যায় না। ভিনদেশি হওয়ার পরও কৃষ্ণচূড়া আমাদের দেশি ফুলের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে।

কৃষ্ণচূড়া ফুলের প্রেমে মগ্ন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মিথিলা দেবনাথ ঝিলিক বলেন, গ্রীষ্মের খরতাপে শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয় ক্যাম্পাসের কৃষ্ণচূড়া গাছগুলো। এই অপূর্ব ফুলে আচ্ছাদিত হয়েছে পুরো ক্যাম্পাস। এই ফুটন্ত কৃষ্ণচূড়া ক্যাম্পাসের শ্রী বৃদ্ধি করেছে বহুগুণে। ক্যাম্পাসজুড়ে কৃষ্ণচূড়া যে রং ছড়িয়েছে তা চোখে না দেখলে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। রক্তিম লালে প্রকৃতিকে কৃষ্ণচূড়া যেন অনেক অপরূপ দেখায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী মেহরাব হোসেন অপি হাসিমুখে জানান, কৃষ্ণচূড়া সে তো ভালোবাসা জাগানিয়া আরেক নিরন্তর বসন্তের অতিথি। সুখের প্রাণবন্ত প্রতীক ফাল্গুনীকে দেওয়া কথার প্রতিজ্ঞা। অন্তর জ্বালার সুখ প্রদীপ। বিরাণ ভূমির জনাকীর্ণতা। কৃষ্ণচূড়ার অগ্নিরং হৃদয় কেড়ে নেয়। কৃষ্ণচূড়া গাছের নাম শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে অজস্র লাল-লাল ফুল। কী অপূর্বই না সেই ফুলগুলো। বর্তমানে এই অপূর্ব ফুলে আচ্ছাদিত হয়েছে পুরো ক্যাম্পাস। এই ফুটন্ত কৃষ্ণচূড়া ক্যাম্পাসের শ্রীবৃদ্ধি করেছে বহুগুণে। বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে কৃষ্ণচূড়া যে রং ছড়িয়েছে তা চোখে না দেখলে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

কৃষ্ণচূড়ার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সাঈমা আক্তার বললেন, প্রতিবছর কৃষ্ণচূড়া ফুল ফোটার এই সময়টার জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকি। এই সময়টাতে কৃষ্ণচূড়ার রক্তিম আভা আমায় মুগ্ধ করে তোলে। কৃষ্ণচূড়ার ছায়ার বিকেল বেলায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে খুবই ভালো লাগে।

কৃষ্ণচূড়ার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য উলেস্নখ করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী সাখাওয়াত হোসেন বলেন, গাছটি খুবই নরম। এটি আমাদের দেশীয় কোনো গাছ না। এরা ঝড়-ঝাপটায় টিকে থাকতে পারে না। কৃষ্ণচূড়া ফুল ফোটার ব্যাপ্তিকাল ভিন্ন। রাতের নিরবচ্ছিন্ন একটা দৈর্ঘ্য ছাড়া কৃষ্ণচূড়া ফুল ফুটতে পারে না।

কৃষ্ণচূড়া উদ্ভিদের আদিনিবাস মাদাগাস্কার হলেও ভারত, নেপাল, মিয়ানমার, পাকিস্তানসহ অনেকে দেশেই এর বিস্তৃতি। আমাদের দেশে কৃষ্ণচূড়া উদ্ভিদটি সচরাচর সব জায়গায় দেখা যায় বিধায় তীব্র সংকটের কোনো আশঙ্কা নেই এবং সংরক্ষণের দিক থেকে এটি আশঙ্কামুক্ত পর্যায়ে রয়েছে মর্মে গবেষণা প্রকাশনা রয়েছে। এই উদ্ভিদের লাল, কমলা, হলুদ ফুল এবং উজ্জ্বল সবুজ পাতা অপরূপ সৌন্দর্যের জন্য দায়ী আর এই বিভিন্ন রং মূলত ক্লোরোফিল, কারোটেনোয়েডস ও অ্যানথোসাইনিন নামক রঞ্জক পদার্থের উপস্থিতির কারণেই হয়ে থাকে বলে জানিয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও শিক্ষক সমিতির সদস্য ড. এএমএম গোলাম আদম।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃক্ষরোপণ কমিটির সদস্য বিভাস কুমার সরকার জানান, কৃষ্ণচূড়া লাল ফুল ও উজ্জ্বল সবুজ পাতা বিশিষ্ট একটি দৃষ্টিনন্দন উদ্ভিদ। কৃষ্ণচূড়া উদ্ভিদটি মাদাগাস্কারের শুষ্ক পত্রঝরা বনাঞ্চলে উৎপত্তি লাভ করে সারা বিশ্বে বিস্তার লাভ করেছে। বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালে (এপ্রিল-জুন) এই ফুল বেশি দেখা যায়। সৌন্দর্যবর্ধন ছাড়াও এই গাছ উষ্ণ আবহাওয়ায় ছায়া দিতে উপযুক্ত। ক্যাম্পাসকে আরও সুন্দর করতে কৃষ্ণচূড়া লাগানো যেতে পারে। তবে বিজ্ঞান অনুষদের বড় গাছটি হেলে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে বিধায় প্রয়োজনে এর ডালপালা কেটে ফেলা হতে পারে।

আমাদের দেশে পত্রঝরা এই কৃষ্ণচূড়া উদ্ভিদটির পাতা শীতকালে ঝরে যায় আর বসন্তকালে ফুল ফোটে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কৃষ্ণচূড়ার ফুল ফোটার সময় ভিন্ন। অপরূপ সৌন্দর্য ছাড়াও এর পাতা, মূলের বাকল ও ফুল ভেষজ গুণাগুণ সম্পন্ন যা জ্বর ও খুশকি নিরাময়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া কিছু কিছু ক্ষেত্রে জ্বালানি হিসেবে উদ্ভিদের শুকনো শাখা-প্রশাখা এবং ফল ব্যবহার করা হয় বলে জানান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র ট্যাক্সোনমিক ড. নাহিদ সুলতানা।

রুক্ষ গ্রীষ্মের রোদের খরতাপে মন মাতানো রঙিন এ সৌন্দর্যে চোখ ধাঁধানো মায়াময় টুকটুকে লাল কৃষ্ণচূড়া ফুলে ফুলে যেমনি সেজেছে গ্রীষ্মের প্রকৃতি, তেমনি জবি ক্যাম্পাসে সবার মনেই জাগিয়েছে রক্তিম স্রোত। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর একটাই প্রত্যাশা, কৃষ্ণচূড়ার এই অপরূপ দৃষ্টিনন্দন দৃশ্যটি অমর হয়ে বেঁচে থাকুক যুগের পর যুগ। আপন মায়ার চাদর আকাশে ছড়িয়ে মেলে ধরুক স্বপ্নময় নয়নাভিরাম কৃষ্ণচূড়ার নান্দনিক সৌন্দর্য। পুরো ক্যাম্পাস কৃষ্ণচূড়া ফুলের মায়ায় জড়িয়ে প্রেমে মগ্ন হয়ে উঠুক।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে