শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

ঐতিহাসিক পলাশী দিবসের শিক্ষা ও ভাবনা

বাঙালির ইতিহাসে এক করুণ দিন ঐতিহাসিক পলাশী দিবস। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুনের সেই দিনে ক্ষমতালিপ্সু বিশ্বাসঘাতক সেনাপতি মীরজাফর আলী খানের ষড়যন্ত্রে ইংরেজ হায়েনাদের কাছে পরাজিত হন বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। নিভে যায় বাংলার স্বাধীনতার প্রদীপ। পলাশী দিবসের ২৬৫ বছর পূর্তিতে এই দিবসের শিক্ষা ও স্মৃতি নিয়ে কিছু তরুণের অভিমত তুলে ধরেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মী-মিনহাজুল ইসলাম
  ১৮ জুন ২০২২, ০০:০০
আবদুল কাদের নাগিব

মীরজাফর বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক

আবদুল কাদের নাগিব

ইতিহাস বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে নির্মম সত্য ও নিকৃষ্টতম হলো যে যাকে বিশ্বাস করে ভালোবাসে আর উপকার করে সেই কাছের মানুষটাই অনেক সময় হয়ে যায় বিশ্বাসঘাতক। পলাশীর প্রান্তরে ২৩ জুনের দিনটা ছিল শঠতা ও বিশ্বাসঘাতকতার। যদিও এটির পেছনে ছিল মূলত ক্ষমতালিপ্সা। ইরানের সামান্য সৈনিক আলীবর্দী খাঁন কাজের জন্য ভারতবর্ষে এসেছিলেন। মুর্শিদকুলি খাঁর জামাতা সুজাউদ্দিনের দরবারে পারিষদ ও পরে জেলার ফৌজদার নিযুক্ত হন। ১৭৪০ সালে মুর্শিদাবাদের কাছে গিরিয়ার যুদ্ধে সরফরাজ খাঁকে পরাজিত করে আলীবর্দী বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব নিযুক্ত হন। অথচ এই সরফরাজের বাবাই আলীবর্দী খাঁকে বিশ্বাস করে ফৌজদার নিযুক্ত করেছিলেন। পরবর্তীতে আলীবর্দী খাঁন মীরজাফর আলী খাঁন নামক পারস্য থেকে নিঃস্ব অবস্থায় আসা ব্যক্তিটাকে ভালোবেসে তার সঙ্গে নিজের বৈমাত্রেয় বোনকে বিয়ে দিয়ে আত্মীয়তার সম্পর্কে আবদ্ধ করেন। কয়েক বছর পর ১৭৫৬ সালে আলীবর্দী খাঁর মৃতু্য হলে তার কনিষ্ঠা কন্যার ছেলে সিরাজউদ্দৌলা নবাব নিযুক্ত হন। আর মীরজাফরের মনে ক্ষমতালিপ্সা দৃঢ় হতে থাকে। মীরজাফর বাংলার সুদক্ষ, সৎ ও প্রকৃত দেশপ্রেমিক সদ্য যুব নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে চালান ষড়যন্ত্র। যাতে যুক্ত হন সিরাজের আপন খালা ঘষেটি বেগম। ২৩ জুন ১৯৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজদের সঙ্গে যোগসাজশ করে বাংলার স্বাধীনতাকে পরাধীনতার শিকলে বন্দি করে দেন বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর। উদ্দেশ্য কেবল নবাবের চেয়ারে বসা।

বাংলার ইতিহাসে মীরজাফর বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক, নিকৃষ্ট মানুষের প্রতীক। কারণ ইংরেজদের প্রলোভনে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় তিনি বিক্রি করেছিলেন দেশের স্বাধীনতা। পরে সৎ নবাবের বিরুদ্ধাচরক অসৎদের পরিণতিও হয়েছিল নির্মম। যেমন- পলাশীর মূল হোতা লর্ড ক্লাইভ ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ভারতে লুণ্ঠন ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে লজ্জায়, অপমানে ১৭৭৪ সালের ২২ নভেম্বরে আত্মহত্যা করেন। খালা ঘষেটি বেগমকে বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যার সন্ধিস্থলে ফেলে হত্যা করা হয়। বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর কুষ্ঠরোগে ধুঁকে ধঁকে ১৭৬৫ সালের ৫ ফেব্রম্নয়ারি মারা যান।

আমাদের পরিবার, সমাজ ও দেশে এমন অনেকে আছেন যারা মীরজাফরের চরিত্র লালন করেন। উপকারী বন্ধুর ক্ষতি করতে তারা একবারও তাদের হৃদয় কাঁপে না। পৃথিবীতে আমাদের আদর্শের প্রতীক হবে মুহম্মদ (সা.)। আমাদের বাংলাদেশের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা ভাসানী, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা, তিতুমীরের মতো মানুষ হতে হবে। দেশ ও জাতির কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে। তাহলেই কেবল বিজয় হবে মনুষত্বের। ঘুচে যাবে সকল গস্নানি।

মীরজাফররা শেকড় থেকে বারবার উঠে আসে

মো. সোহাগ মিয়া

শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

২৩ জুন ঐতিহাসিক পলাশী দিবস। এদিনে বাংলার স্বাধীনতার লাল সূর্য নিভে গিয়েছিল কুচক্রীদের কূটচালে। শুরু হয়েছিল পরাধীনতার কষাঘাত আর শোষণ-নিপীড়নের এক নতুন অধ্যায়। বিশ্ব ইতিহাসে যে দিনটি পলাশী ট্র্যাজেডি দিবস নামে পরিচিত। ২৬৫ বছর আগে এই দিনে পলাশীর আম্রকাননে ইংরেজদের সঙ্গে প্রহসনের এক যুদ্ধে বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্যদিয়ে অস্তমিত হয় বাংলার স্বাধীনতার শেষ সূর্য। পরাজয়ের পর নবাবের বেদনাদায়ক মৃতু্য হলেও উপ-মহাদেশের মানুষ নবাবকে আজও হৃদয়ের গভীর থেকে শ্রদ্ধা করে।

২৩ জুনের পলাশীর ইতিহাস, কিছু বিশ্বাসঘাতক চক্রান্তকারীর যোগসাজশে দেশের স্বাধীনতা বিদেশি বেনিয়াদের হাতে তুলে দেওয়ার ইতিহাস। ২৩ জুনের ইতিহাস সোনার বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করার ইতিহাস। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, নবাবের সঙ্গে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল তাদের স্বাভাবিক মৃতু্য হয়নি। যেখানে বিশ্বাসঘাতকতা না হলে তার বিজয় ছিল সুনিশ্চিত। অতি ঘৃণ্য মীরজাফরের মৃতু্য হয় কুষ্ঠরোগে। কিন্তু বাংলার ট্র্যাজেডি এই যে, এই সব মীরজাফররা বারবার শেকড় থেকে উঠে আসে। ইতিহাস সাক্ষী মীরজাফর এবং ঘষেটি বেগম প্রচন্ড ক্ষমতালোভী ও জাতীয়তা বিরোধী ছিলেন। ধারাবাহিকতা রক্ষায় তাদের উত্তরসূরিরাও একই আচরণ অব্যাহত রেখেছিল।

স্বাধীনতা দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ। দেশপ্রেম দেশের সবচেয়ে বড় আমানত। এই সত্যটা জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে প্রত্যেক নাগরিককে সর্বদাই মনে রাখতে হবে। প্রত্যেকে প্রত্যেকের অবস্থান থেকে দেশকে ভালোবাসতে হবে। এটাই হোক পলাশী দিবসের শিক্ষা।

দেশপ্রেমের অঙ্গীকারে দুর্নীতি বন্ধ করি

মো. রাসেল মহাজন

শিক্ষার্থী, টু্যরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

আজ ২৩ জুন ঐতিহাসিক পলাশী ট্র্যাজেডি দিবস। ২৬৫ বছর আগে এই দিনে পলাশীর আম বাগানে ইংরেজদের সঙ্গে এক যুদ্ধে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্যদিয়ে এক করুণ ইতিহাস সৃষ্টি হয়। ইতিহাসবিদ নিখিলনাথ রায়ের লেখা ''মুর্শিদাবাদ কাহিনী' থেকে জানা যায় নবাবের সেনাবাহিনীর তুলনায় ইংরেজদের সেনা সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য। সেখানে নবাবের সেনাপ্রধান মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতা না করলে নবাবের বিজয় ছিল সুনিশ্চিত। বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব আলীবর্দী খাঁ মৃতু্যর আগে সিরাজউদ্দৌলাকে নবাবের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী করে যান। নবাব আলীবর্দী খাঁর মৃতু্যর পর ১৭৫৬ সালে সিরাজউদ্দৌলা সিংহাসনে বসেন। কিন্তু নবাবের খালা ঘষেটি বেগম তা মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলান। সেনাপ্রধান মীরজাফর আলী খান, ধনকুবের জগৎশেঠ, রাজা রায়দুর্লভ, ঊর্মিচাঁদ, ইয়ার লতিফ প্রমুখ ইংরেজদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে যোগ দেয়। তারপর ১৭৫৭ সালের ২২ জুন নবাব ইংরেজদের আগেই পলাশী পৌঁছে শিবির স্থাপন করেন। ২৩ জুন সকাল ৮টায় যুদ্ধ শুরু হয়। কিন্তু তার প্রধান সেনাপতি মীরজাফর ও তার দলবল যুদ্ধে দর্শকের ভূমিকা পালন করে। তাদের এই বিশ্বাসঘাতকতার কারণে নবাবের পরাজয় হয়। পরাজয়ের পর নবাবের বেদনাদায়ক মৃতু্য হলেও উপমহাদেশের মানুষের হৃদয়ে তিনি অমর হয়ে আছেন।

পক্ষান্তরে মীরজাফর নামটি বিশ্বের বুকে আজ বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাই আসুন আমরা এই ঐতিহাসিক পলাশী দিবসে দেশপ্রেমের অঙ্গীকার নিই। দেশবিরোধী কর্মকান্ড, দুর্নীতি, অনৈতিকতা, লুটপাট বন্ধ করি।

সোনার বাংলা পরিণত হয় শ্মশানে

মো. জুবায়ের মোলস্ন্যা

ইতিহাস বিভাগ, দৌলতপুর কলেজ (দিবা/নৈশ), খুলনা

আমরা কমবেশি সবাই পলাশী যুদ্ধ সম্পর্কে জানি। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার, কিন্তু তা অন্যসব দিনের চেয়ে ছিল আলাদা। কারণ ওইদিন মুর্শিদাবাদ থেকে ১৫ ক্রোশ দক্ষিণে ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশীর আম্রকাননে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যাসহ পুরো উপমহাদেশের স্বাধীনতার কবর রচিত হয়েছিল। ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও লর্ড ক্লাইভের মধ্যে এক যুদ্ধ নাটক মঞ্চায়িত হয়। ইতিহাসে যা পলাশীর যুদ্ধ নামে খ্যাত হলেও তা ছিল অনেকটা 'দাঙ্গা'। ঐতিহাসিকদের মতে, ইংরেজদের সংখ্যা এতই কম ছিল যে, নবাব বাহিনী একটি করে ঢিল ছুড়লেও ইংরেজ সেনারা গুঁড়িয়ে যেত। এতে নবাব বাহিনীর পক্ষে সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় ৬৫ হাজার এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে ছিল মাত্র ৩ হাজার। কামানেও সিরাজউদ্দৌলা এগিয়ে ছিল। কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রধান সেনাপতি মীরজাফর ও তার অনুসারী প্রায় ৪৫ হাজার সৈন্য নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। ফলে যুদ্ধে স্বাধীনতার পক্ষশক্তির পরাজয় অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। যদিও সাহসী সেনাপতি মীরমদন এবং বিশ্বস্ত দেওয়ান মোহনলাল, ফরাসি সেনাপতি সিনফ্রেকে সঙ্গে নিয়ে প্রাণপণ লড়াই চালান। যুদ্ধে মীরমদন কামানের গোলার আঘাতে নিহত হন এবং মোহনলাল আহত হন। মীরমদন মোহনলালের সেনারাই রবার্ট ক্লাইভের বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে ফেলেছিল প্রায়। কিন্তু নবাব সিরাজ মীরজাফরের অসৎ পরামর্শে যুদ্ধ বন্ধ রাখার আদেশ দেন। এই সুযোগে অতর্কিত আক্রমণ করে বসে ইংরেজরা। ফলে নবাববাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের সেবাদাসদের সাহায্যে এভাবেই বাংলায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। এরপর সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দীর্ঘ ১৯০ বছর এ দেশে শাসন-শোষণ চালায়। কোটি কোটি টাকার অর্থ সম্পদ ইংল্যান্ডে পাচার করে। বাংলা থেকে লুটকৃত পুঁজির সাহায্যে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপস্নব ঘটে। আর এককালের প্রাচ্যের স্বর্গ সোনার বাংলা পরিণত হয় শ্মশানে, স্থান পায় বিশ্বের দরিদ্রতম দেশে।

যুগে যুগে কিন্তু এটাই শেষ নয়। মুখে দেশাত্মবোধ নিয়ে অনেকেই বাংলাকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছে অন্ধকারে। স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও কিন্তু তার বিশ্বস্তদের হাতে নিহত হন পঁচাত্তরের কালরাতে। পরিশেষে বলা যায়, আমাদের শত্রম্ন আমরাই। আমরা যদি দেশাত্মবোধ নিজের মধ্যে সঠিকভাবে ধারণ করি তাহলে হয়তোবা আর কখনো পলাশীর যুদ্ধে বেইমানির মতো দেশদ্রোহী কাজে আর কোনো প্রজন্ম লিপ্ত হবে না।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে