টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেওয়া এক কিশোর ওইটুকুন বয়সেই খুব ডানপিটে, মানবদরদি ও সাহসী ছিলেন। মানুষের বিপদে-আপদে সব সময়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। কী আন্দোলন-সংগ্রাম, কী সামাজিকতা, কী মানবিক মন, কী নৈতিকতা, কী সততা- সবদিকেই তিনি ছিলেন সেরা। বক্তৃতায় তার বজ্র কণ্ঠস্বর শুধু এই তলস্নাটে নয় তার সমসাময়িককালে পৃথিবীর এক অদ্বিতীয় বক্তা হিসেবে সর্বমহলে স্বীকৃতি পেয়েছেন। তার নেতৃত্ব গুণের কারণে খুব অল্প সময়েই তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ হিসেবে বাঘা বাঘা রাজনীতিবিদদের ডিঙিয়ে সবার প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। তিনিই বঙ্গবন্ধু। তিনি আমার নেতা, তিনি তোমার নেতা, তিনি আমাদের নেতা- তিনি সবার নেতা। তিনিই বাঙালির অকৃত্রিম বন্ধু, বঙ্গবন্ধু।
একজন মানবদরদি নেতার নাম- বঙ্গবন্ধু। একজন কৃষকদরদি নেতার নাম বঙ্গবন্ধু। একজন শ্রমিকবান্ধব নেতা- বঙ্গবন্ধু। একজন খাঁটি মুসলমানের নাম- বঙ্গবন্ধু। একটা অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রাতিষ্ঠানিক স্তম্ভ- বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু শুধু একটি নাম নয়, বঙ্গবন্ধু একটি প্রতিষ্ঠান। বঙ্গবন্ধু মানেই ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুই আদর্শের বাতিঘর। একজন নারীবান্ধব মহান নেতা বঙ্গবন্ধু। বিশ্বনেতাদের আইডল একজন বঙ্গবন্ধু। খেলাধুলার পথপ্রদর্শক বঙ্গবন্ধু। বজ্র কঠিন সাহসী উচ্চারণের নাম বঙ্গবন্ধু।
টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়ায় প্রতিটা দিন প্রতিটা মুহূর্তে বঙ্গোপসাগরের তীরে ঢেউ আছড়ে পড়ার মতো ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়- বঙ্গবন্ধু নামটি। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, কর্ণফুলীর জোয়ারের মতো প্রতিনিয়ত মানুষের মনের ভালোবাসার জোয়ারে ফুলে-ফেঁপে ওঠে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নামটি। কী এক জাদুকরি কণ্ঠের ছোঁয়ায় মানুষের মনে স্থায়ী আসন গেড়ে নিলেন বঙ্গবন্ধু। যে নামের ভালোবাসায় মানুষের মনে আবেগ উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। যে নামের দুর্বিনীত আদর্শে মানুষ দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ মুজিবাদর্শের রাজনীতিতে ভালোবাসার ঢালি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আজ এই ছোট্ট পরিসরে গল্পের ছলে হলেও বঙ্গবন্ধুর কথাই বলতে চাই।
শেখ মুজিব শুধু একটি নাম নয়, একটি সহস্র শব্দের কবিতা, একটি অসমাপ্ত উপন্যাস। কবিতার ভাষায় বলতে চাই-
'তুমি জন্মেছিলে বলেই জন্মেছে এই দেশ,
তোমার আরেক নাম স্বাধীন বাংলাদেশ।'
একটি শিশু জন্ম নিয়েছিল আজ থেকে শত বছর আগে। এই শিশুটির শৈশব, কৈশোর, তারুণ্যতার দিনগুলো কেটেছে খুব সহজ-সরল জীবনযাপনের মাধ্যমে। যৌবনের দিনগুলো কেটেছে দেশ মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের মধ্যদিয়ে। সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন বুকে নিয়ে। দেশের মানুষের দুবেলা দুমুঠো খেয়ে শান্তিতে বসবাস করার স্বপ্ন চোখে নিয়ে। সমাজ পরিবর্তন, ছাত্র-জনতা, কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি জনতার অধিকার আদায়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাস, রাজপথে উত্তাল আন্দোলনে যার কেটেছে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। যে ছেলেটি আর দশ জন শিক্ষার্থীর মতো নিজে পড়ালেখা করে নিজের জন্য পরিবারের জন্য কিছু করতে হবে এই বিষয়টি ভাবনায় না এনে দেশ-মাটি ও মানুষের অধিকার আদায়ে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন।
সামরিক জান্তার কাছ থেকে অধিকার আদায় করতে গিয়ে জেল-জুলুম-নির্যাতন সয়েছেন। দিনের পর দিন খেয়ে না খেয়ে আন্দোলনকে জাগিয়ে তোলার জন্য দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছেন। নিজের আরাম-আয়েশের দিকে তাকাননি। নিজের পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতার দিকে তাকাননি। তিনি তাকিয়েছিলেন সাত কোটি মানুষের দিকে। তিনি ভালোবেসেছিলেন সাত কোটি জনতাকে। ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৭ মার্চ এক জ্বালাময়ী ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, 'এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' এই মহাসমাবেশের রেষ ধরেই অবশেষে একদিন স্বাধীনতার ঘোষণা করা হলো। সাত কোটি বাঙালির অধিকার আদায়ে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করার অপরাধে তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হলো পশ্চিম পাকিস্তানে। দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী রক্তঝরা দিনগুলো পেরিয়ে অবশেষে এই বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করল। প্রাণ দিল ত্রিশ লাখ শহীদ। পঙ্গু হলো লাখ লাখ মানুষ। ইজ্জত হারালো লাখ লাখ নারী। উনিশশ' বাহাত্তরের দশ জানুয়ারি বীরের বেশে প্রাণের দেশে ফিরে এলেন সাত কোটি মানুষের স্বপ্নপুরুষ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে পরিপূর্ণতায় ভরিয়ে তোলার জন্য রাতদিন সংগ্রাম করে যাচ্ছিলেন।
কিন্তু... পনের আগস্টের এক কাল রাত্রি। কোনো এক নির্জন কুঠিরে দফায় দফায় বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। শেষ মুহূর্তে পরিকল্পনার চুলচেরা বিশ্লেষণ। এদিন বাংলাদেশের আকাশে কোথাও চাঁদের আলো দৃশ্যমান হয়নি। লাখ লাখ তারা আকাশের বুকে মুখ লুকালো। সময়ের বুকে কালো দাগ এঁকে দিল। ঘাতকের ট্যাঙ্ক চুপিসারে ছুটতে লাগল, গন্তব্যে। ধানমন্ডি বত্রিশ- মহানায়কের বাসভবন। এরপর....