শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রণকাইলের পদ্ম ও শাপলার বিলে একদিন

ম মো. শাহীন সরদার
  ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০

ফরিদপুর জেলার পলস্নী কবি জসিমউদদীনের বাড়ি থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে রণকাইল গ্রাম। রাস্তার দুই পাশে গ্রাম তার দুই পাশে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ফসলের মাঠ। যেখানে কৃষকের ঘামে সোনা ফলে। সোনালি আঁশ ও পেঁয়াজে ভরে ওঠে দুই পাশের মাঠ। রণকাইল গ্রামের পূর্ব পাশে দিগন্ত বিস্তৃত আকাশ যেন বিশাল মাঠের উত্তর ও দক্ষিণে নেমে পড়েছে। মাঠের উত্তর দিকে বিখ্যাত অচিন গাছ, দক্ষিণ প্রান্তে প্রাচীন বটতলা যেখানে প্রতি বছর মাঘী পূর্ণিমার দিনে মেলা বসে তারই মাঝে অবস্থিত একসঙ্গে তিনটি হরাই, চাপাই ও রঘুয়ার বিল। বিলের চারপাশে পশ্চিমে রণকাইল, পূর্বে ভাবুকদিয়া ও জটারকান্দি; উত্তরে ফুরসা গ্রাম। বিল হলো এমন এক উন্মুক্ত জলরাশি যেখানে সারাবছর পানি থাকে বর্ষাকালে তা বিশালতা ধারণ করে। বর্ষাকালে রণকাইলের বিল তার বিশালতা ফিরে পায়, বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশি মাছে ভরে ওঠে বিল। দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি এমনিতেই সৌন্দর্যপিপাসুদের হৃদয় আকৃষ্ট করে। এতে আরও নতুন মাত্রা যোগ করে বিলজুড়ে সাদা রঙে ছড়িয়ে থাকা জাতীয় ফুল শাপলা, গোলাপি রঙের অপরূপ সৌন্দর্যের জলজ ফুলের রানী পদ্মফুল। এছাড়া আরও কচুরিফুল, জানা-অজানা বাহারি রঙের জলজ ফুল।

আমরা দুই ভাই-বোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য বেশির ভাগ সময় বাড়ি থেকে দূরে থাকা হয়। গ্রামে এলে বাড়ির সঙ্গেই হওয়ায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সবসময়ই একবার ঢুঁ মেরে যাওয়া হয়। এবারও নির্মল প্রকৃতির হাতছানিতে পরিবারের সঙ্গে নৌকায় গিয়েছিলাম আমাদের রণকাইল গ্রামের হরাই ও চাপাই বিলের সৌন্দর্যে নিজেদের বিলিয়ে দিতে। দুই বিলেই ফুটেছে শাপলা ও পদ্ম ফুল। বিলে কাকডাকা ভর দুপুরে চারপাশে মানুষ পাটের আঁশ ছাড়াতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। চারপাশে পাট, পাটখড়ি শুকাতে দিচ্ছে, বিস্তীর্ণ মাঠ, মাঠভরা বিস্তীর্ণ জলরাশি, পানি ঢেউ খেলছে, বাতাস চুল উড়িয়ে নিচ্ছে বিলের মধ্যদিয়ে বয়ে চলছে নৌকা। এ যেন পলস্নী কবি জসিমউদদীনের এক অপরূপ পলস্নী, জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলার প্রতিচ্ছবি। চোখ জুড়ানো নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক পরিবেশ। জোৎস্না রাতে নিরিবিলি বিলে পানির কলকাকলি, ফুলের সৌরভ, বাতাস আর চাঁদের সঙ্গে সেই মিতালি জমে ওঠে এখানে। মুহূর্তেই মনে আনে প্রশান্তি, দূর করে সব ক্লান্তি অবসাদ।

ফরিদপুর জেলা শহর থেকে বাসে কানাইপুর নেমে এখান থেকে যে কাউকে জিজ্ঞাসা করে রণকাইল গ্রামের সরদার বাড়ি চলে এলেই হারিয়ে যেতে পারবেন প্রকৃতির মধ্যে। ভাড়া লাগবে ফরিদপুর থেকে কানাইপুর ২০ টাকা, কানাইপুর থেকে রণকাইল ২০ টাকা করে। রণকাইল সরদার বাড়ির পাশেই হরাই বিল। রণকাইল স্কুলের রাস্তা দিয়ে চাপাই বিল ও পাকুরপাড়া থেকে হরাই বিলের দিকে রাস্তা রয়েছে।

রণকাইল গ্রামের মো. মুন্নু সরদার জানান, ধুলোবালি আর ইট-পাথরের জীবন থেকে পরিবার নিয়ে কিছু ভালো মুহূর্ত কাটানোর জন্য এই বিল হতে পারে এক আদর্শ স্থান। স্থানীয় বিষ্ণু মাঝি বলেন, ছোটবেলা থেকেই এ বিলে বেড়ে ওঠা। একেক ঋতুতে একেক সাজে সজ্জিত হয় বিলটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী স্থানীয় জুলিয়া সুলতানা বলেন, প্রকৃতি যে কাউকে সহজে আকৃষ্ট করে। পড়ালেখার জন্য বাইরে থাকা হলেও বাড়ি এলে এখানে যাওয়া হয়। এত বড় মাঠ ও সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর বিল আমি কম দেখেছি।

বিলের সৌন্দর্য ও জলজ সম্পদ রক্ষায় কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। বিলের অস্তিত্ব রক্ষায় অবৈধ ড্রেজিং বন্ধ করে দ্রম্নতই প্রয়োজন সরকারিভাবে পরিকল্পিত ড্রেজিং। বৃদ্ধি করতে হবে পর্যটকদের জন্য আরও সুযোগ-সুবিধা।

রণকাইল বিলের সৌন্দর্যের কথা কবিতায় কবিতায় জানান রণকাইলের স্থানীয়

মো. মুন্নু সরদার

হরাই-চাপাই

সত্য কিছু তথ্য শুনাই কল্প কথার মতো

অল্প দিনেই হারিয়ে গেছে দৈব-বাণীর মতো

হরাই-চাপাই বিলের শোভা দেখিতে যেমন

তাদের কথা বলতে আমার খুশি ভরা মন

হরাই বিলের পাড়ির পরে বৃদ্ধ বটের গাছ

সেই গাছেতে বসে কাটায় কাক তিতিয়া বাজ

দুই বিলেরই দু'ধার দিয়ে আছে দুটি গ্রাম

রণকাইল আর ভাবুকদিয়া গ্রাম দুটির নাম

মাছের কথা বলব কী তার আমি যাহা জানি

সব রকমের মাছে ভরা, মাছ ছাড়া নাই পানি

কই, মাগুর আর শিং, পুঁটি মাছ পাবদা বোয়াল, শোল

হর-হামেশায় মাছের গুঁতায় ভাঙত নায়ের খোল

জলজ ফুলের মধ্যমণি শাপলা-পদ্মফুল

ঝাপটা বাতাস এসেই তাদের গায়ে দিত দোল

বর্ষাকালে পদ্মফুলের মন-মোহনী রূপ

শালুক পাতায় হাত লাগিয়ে কৃষাণ মেয়ের ডুব

বিলবিলা আর পানকৌড়িদের আনন্দ জলকেলি

নিহের পাতায় নিহের তোলা ডোঙ্গা ঠেলাঠেলি

শালুক, নিহের, পদ্মপাগল চেপের খইয়ের কথা

শুনলে এখন বলবে সবাই পাগল বেটার মাথা

হায়রে আমার ঐতিহ্য আর স্মৃতির সেসব দিনের

বাতাস পেলেই পালতোলা নায় কাটতো সারাদিন

বিল সে আমার স্মৃতির পটে ছবির জাদুঘর

যৎসামান্যই লেখা হলো বিবরণ তারপর।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে