'একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়, 'আগের সেই শিক্ষকও নাই, সেই শিক্ষার্থীও নাই' এটা আমাদের পারিপার্শ্বিক অন্যসব সম্পর্কের মতোই সম্পর্কের ক্ষয়িষ্ণুতা নির্দেশ করে। অথচ পরিবারে জন্মগ্রহণ করা একটা মানবশিশু পরিবারের পরেই মানুষ হয়ে বেড়ে ওঠার কার্যকর শিক্ষা পেয়ে থাকে শিক্ষালয় ও শিক্ষক থেকে। কখনো কখনো পরিবারের চেয়ে শিক্ষকের কাছ থেকেই বেশি পায়।' এমনটাই বলছিলেন গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক মো. হাবিবুলস্নাহ বেলালী।
শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের সুসম্পর্কের উপর গুরুত্বারোপ করে এই শিক্ষক বলেন, 'শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রাণপূর্ণ বন্ধুত্ব, শ্রদ্ধা, স্নেহ ও মান্যতার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ছাড়া কার্যকর পঠন, পাঠন ও শিখন সম্ভবপর নয়।'
অপশিক্ষা, কুশিক্ষা, অন্ধত্ববাদ থেকে বের করে এনে একটি জাতিকে আলোর পথ চেনান শিক্ষক। তবে বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে নিয়োগে দুর্নীতি ও অনিয়ম থেকে শুরু করে ঘুষ, জালিয়াতি, প্রশ্নফাঁস, মাদকাসক্তি এমনকি ধর্ষণের মতো স্পর্শকাতর কর্মকান্ডেও শিক্ষকদের সম্পৃক্ততা দেখা যায়। নৈতিক অবক্ষয়ের ফলস্বরূপ ব্যাহত হচ্ছে মানসম্মত শিক্ষা। ফলে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক দিন দিন শুধু ক্লাসরুম পর্যন্তই আটকে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, 'জাতীয় দৈনিকে আসা কিছু লজ্জাস্কর ঘটনা ইঙ্গিত করে ইদানীং শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কের গভীরতা শুধু কমেছে তাই নয়- কখনো কখনো মনে হয় মুখোমুখি অবস্থানে আছে তারা। তবে এ অবস্থার জন্য উভয়েরই সমান দায় আছে। পারিপার্শ্বিক কারণ ছাড়াও সোহাগবিহীন শাসন ও শাসনের মধ্যে সোহাগ খুঁজে না পাওয়াই সম্পর্কের এ জটিলতার জন্য দায়ী হতে পারে।'
একজন শিক্ষক হিসেবে নিজ প্রত্যাশা নিয়ে তিনি বলেন, 'আমি শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীর সঙ্গে তেমন আচরণই করব, যেমন আচরণ আমি আমার শিক্ষক থেকে প্রত্যাশা করতাম। শিক্ষকের প্রতি মান্যতার যে জায়গাটা রেখেছি, আমার শিক্ষার্থীদের থেকেও আমি তা প্রত্যাশা করব। শিখন প্রক্রিয়ার দুটি অংশের এমন সৌহার্দ্যপূর্ণ ভাবনা হয়তো পারবে আমাদের ক্ষয়ে আসা শিখন সম্পর্ককে প্রাণপূর্ণ করতে।'
একজন ছাত্রের জীবনের লক্ষ্য থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সফলতার প্রতিটি সিঁড়িতে টেনে উপরে তোলার অবদান থাকে একজন শিক্ষকের। আবার শিক্ষকের নৈতিক অবক্ষয়েই মুখ থুবড়ে পড়ে অনেক ছাত্র।
গবি'র আইন বিভাগের ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী মোজাহিদুল ইসলাম নীরব। তার মতে, 'শিক্ষক হলেন খাঁটি মানুষ গড়ার কারিগর। ছোট্টবেলার 'অ আ ক খ' থেকে শুরু করে আজকের আইনের ধারা শেখা; প্রতিটি ধাপে শিক্ষকদের অবদান অতুলনীয়। জীবনের ঝুলিতে হাজারো স্মৃতি জড়ো হচ্ছে জীবনের মঞ্চে রোল পেস্ন করা এই শিক্ষকদের নিয়ে। কখনো হয়তো তারা রোল করেন অভিভাবকরূপে, কখনো হয়তো বা বন্ধুরূপে। আবার কিছু শিক্ষকরূপী অশিক্ষকের প্রশ্নফাঁস, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, নিয়োগ বাণিজ্য, ক্ষমতার অপব্যবহার, অপরাজনীতি, যৌন কেলেঙ্কারিসহ নানা ঘৃণিত কর্মকান্ড জাতিকে ঠেলে দিচ্ছে ধোঁয়াশার দিকে। তাই শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সবার সচেতন মনোভাব নিয়ে দেশগঠনের কাজে নেমে পড়া যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্র-শিক্ষকের সচেতন মনোভাব ও স্বচ্ছ পরিকল্পনা শিক্ষিত ও দক্ষ জাতি গঠনে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। একজন নিষ্ঠাবান শিক্ষকই জাতির কর্ণধার।'
আইন বিভাগের শিক্ষক তৌহিদুল ইসলাম তুহিন বলেন, 'বাবা শিক্ষক ছিলেন, আমার কর্মজীবন শিক্ষকতার মতো মহান পেশা দিয়ে শুরু করতে পেরে আমি আনন্দিত এবং গর্বিত। তবে দুঃখের বিষয়, শিক্ষকতা মহান পেশা হলেও এই পেশায় মেধাবীরা আসতে চায় না। যারা আসেন তারা আবার এটাকে ব্যবসা করার উপজীব্য বিষয় বানিয়ে ফেলেছেন। পুঁজিবাদী এ যুগে শিক্ষা হয়ে গেছে অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার। অন্যদিকে বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থায় জ্ঞান বিলিয়ে জীবনধারণ করাও কঠিন হয়ে গেছে। ফলস্বরূপ শিক্ষা আর মনুষ্যত্বের জায়গায় নেই। এদিকে আবার রাজনীতি শিক্ষাকে মূলধারার থেকে নিয়ে গেছে অনেক বাহিরে। তাই, সমাজ, রাষ্ট্র যেন শিক্ষকদের সম্মান এবং মর্যাদা দেয় এ প্রত্যাশা কামনা করি।'
দেশের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার প্রত্যয়ে শিক্ষকদের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই।
এ বিষয়ে বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের শিক্ষার্থী মো. জান্নাতুল ইসলাম বলেন, 'অসীম সকল গুণের মেলবন্ধনই একজন শিক্ষক, মানুষ গড়ার কারিগর। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত লম্বা খাতা নিয়ে বসলেও জাতির আলোক বর্তিকাবাহীকে নিয়ে লেখার শেষ হবে না। তিনি আমাদের বন্ধু, দার্শনিক এবং পথপ্রদর্শক। পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে, যে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের শিক্ষা অর্জন করি, তা বাকি জীবন বহন করে বেড়াবো। উচিত-অনুচিত বোধশক্তি, সততা, ন্যায়-নীতি, মনুষ্যত্ববোধ, দেশপ্রেমসহ নানা মানবীয় গুণাবলিতে গুণান্বিত হওয়ার পেছনের হিরো একজন শিক্ষক। সভ্যতার উন্নতি অগ্রগতির কান্ডারিও তারা। এ জন্য তাদের যথাযথ ভক্তি আর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা উচিত।'