শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সুখকর স্মৃতিতে কক্সবাজার ও মহেশখালী দ্বীপ

মাহমুদা টুম্পা
  ২৮ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

নীলাম্বরীর নীল জলে পা ভিজানোর সুখ, কবে পূরণ হবে আমার আশায় বাঁধি বুক। একদিন অকস্মাৎভাবেই স্বপ্নগুলো পূরণ হয়ে গেল। রিসোর্স থেকে সকালে বের হলাম সি বিচের অপরূপ সৌন্দর্য দেখব বলে। তখন জোয়ার চলছিল। সমুদ্রের ঢেউ শুকনো বালির বুকে স্নিগ্ধ পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে। স্মৃতিস্বরূপ রেখে যাচ্ছে একটা দুটো ঝিনুক। আমাদের সঙ্গে থাকা বাচ্চাগুলো বিস্ময় নিয়ে দেখছে। ঝিনুক কুড়িয়ে অথৈই সাগরের বুকে ছুড়ে ফেলছে। আমি আর আমার শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকরাও উচ্ছ্বসিত তাদের আনন্দ দেখে। আমরা বেশ সময় নিয়ে সাগরের নান্দনিকতা দেখতে লাগলাম লাবণী পয়েন্ট সি বিচ থেকে। প্রাণ জুড়িয়ে গেল, মন ভরে গেল। সৃষ্টিকর্তার অপরূপ সৌন্দর্যের কারুকার্য মন থেকে অনুধাবন করলাম। অনেকেই সাগরে ডুব দিল, রাইডে উঠল, আবার অনেকে পা ভিজিয়ে হৈ-হুলেস্নাড়ে রিসোর্টে ফিরে এলো। সকালের নাশতা সেরে আমরা মহেশখালী দ্বীপের উদ্দেশে রওনা করলাম। কক্সবাজার থেকে ৬নং ঘাটে চলে এলাম। আমরা আলাদা আলাদা স্পিডবোটে বসে রইলাম। লোকভর্তি হওয়া মাত্র ক্ষিপ্ত গতিতে ছুটে চললাম। উঁচু-নিচু ঢেউয়ের সঙ্গে দুলুনি। বুকটা যেন ধক করে ওঠে। সেকি রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। খানিকটা পানি গায়ে ছিটিয়ে এসে সতেজতা ফিরে আনল। আমরা ২০ মিনিট পর মহেশখালী দ্বীপে পৌঁছালাম। এই সেই একমাত্র পাহাড়ি দ্বীপ। যার কথা বইয়ে পড়েছি। যা আজ চোখের সামনে। আলোড়িত হচ্ছি মনেপ্রাণে। দ্বীপটি সোনাদিয়া, মাতারবাড়ি ও ধলধাট নিয়ে সগৌরবে আকর্ষণীয় পর্যটক কেন্দ্র। এর মোট আয়তন ৩৮৮.৫০ বর্গ কিলেমিটার। কক্সবাজার থেকে মাত্র ১২ কিলেমিটার আমি দূরে। পাড়ি দিয়ে হয় বাঁকখালী নদীর কিছু অংশ এবং বঙ্গোপসাগরের মহেশখালী চ্যানেল। ১৯৫৯ সালে প্রবল ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটা দ্বীপ সৃষ্টি হয়। এটিই মহেশখালী দ্বীপ।

প্রথমেই গেলাম আমরা শুটিং ব্রিজে। এখানে বিভিন্ন মুভির দৃশ্য থাকে। এখানে দাঁড়িয়ে ম্যানগ্রোভ বনের ফিলিং পাওয়া যায়। ব্রিজে দাঁড়িয়ে যতদূর চোখে যায় অগণিত ঢেউয়ের বিপুল সমাহার। দূরে অস্পষ্ট পাহাড়। আর নিচের ম্যানগ্রোভ বন সৌন্দর্যকে আরও দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ব্রিজের নিচের সিঁড়িতে চলে গেলাম। উথাল-পাথাল ঢেউ এসে শিহরণ দিয়ে গেল। অসীম আগ্রহ ও উৎকণ্ঠা নিয়ে ব্রিজ ও ঢেউয়ের মিতালি দেখছি।

তারপর মাথা উঁচিয়ে থাকা দুই ধারের গাছগুলো অতিক্রম করে আমাদের ইজিবাইক ছুটে চলল আদিনাথ মন্দিরের দিকে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮৫.৩ মিটার উঁচুতে মৈনাক পর্বতের চূড়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ তীর্থস্থান আদিনাথ মন্দির। ৬৯টি সিঁড়ি পাড়ি দিতে হয়। এটিই রামায়ণের মৈনাক পর্বত। প্রতি বছর এখানে ফাল্গুন মাসে আদিনাথ মেলা হয়। কথিত আছে, এক কৃষক বনের মধ্যে হিন্দু দেবতা মহাদেবের মূর্তি পান। যার অন্য নাম মহেশ। তারপর এখানে মন্দির তৈরি করে মূর্তি সসম্মানে রাখা হয়। মহেশের সঙ্গে খালী (খাল অর্থে) লাগিয়ে নামকরণ করা হয় মহেশখালী দ্বীপ। ধর্মীয় বিধিনিষেধের জন্য মন্দিরে ঢোকা হয়নি। বাইরেই ছিলাম। দূর থেকেই মহিলাদের ঝুড়িতে রংবেরঙের ফুল দেখতে পাচ্ছিলাম। যা পুজোর জন্য নিয়ে যাচ্ছিল।

আদিনাথ মন্দিরে নাকি পাখিফুল দেখা যায়। ছোট ও চিরহরিৎ বৃক্ষ। ১২ থেকে ১৫ ফুট উঁচু। ৩০-৪০টি ফুল গুচ্ছবদ্ধ হয়ে একটি পূর্ণ ফুলে রূপ নেয়। ভেনেজুয়েলায় এটি গোলাপ নামে পরিচিত। বেশ সময় নিয়ে খুঁজলাম কিন্তু পাইলাম না। তবে এখানে স্থানীয় বাসিন্দাদের তাঁতের কাপড়, ব্যাগ, ঝুড়ি অত্যন্ত চমৎকার। মনে হয় তাদের জীবন্ত সত্তা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কাপড়ের নকশায়।

মহেশখালী দ্বীপ মিষ্টি পান ও আগুন পানের জন্য বিখ্যাত। এই পান নিয়ে স্থানীয় গায়িকা শেফালী ঘোষের বিখ্যাত একটা গান আছে। 'যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম- মহেশখালীর পানের খিলি তারে বানায় খাওয়াইতাম।' আমি সচরাচর পান খাই না। মহেশখালী দ্বীপে আসছি আর পান খাব না, কেমনে হয়। শখের বশে পান কিনে রিসোর্টে ফিরে একটুখানি খাইছিলাম। এখানের স্বর্ণ মন্দির, শুঁটকিপলস্নী, ঝাউবন, রাখাইনদের বসতি ঘুরে ঘুরে দেখলাম। এই দ্বীপে শুঁটকি, লবণ, পান চাষ করা। তাদের জীবনযাত্রা খুবই সাধারণ। মহেশখালীর নানা স্থান ও বিচিত্র স্থাপনা পর্যটককে আকৃষ্ট করে। ছোট্ট এই দ্বীপের শান্ত স্নিগ্ধ পরশ মনকে উজ্জীবিত করে তোলে। অনুভূতির রাজ্যে সংযোজন করে নতুন অভিজ্ঞতার স্পন্দন। তাই তো সৌন্দর্যের তৃষ্ণা মেটাতে হাজারও দর্শনার্থীর ভিড় জমে যায় মহেশখালী দ্বীপে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে