বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শিলাইদহের রবীন্দ্র কুঠিবাড়িতে একদিন

আবদুলস্নাহ আল মামুন
  ২৮ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

ডিসেম্বরের শেষ। শীতের তীব্রতা ক্রমেই বাড়তে শুরু করেছে। আমি ছুটি শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরলাম। দুই একের মধ্যে ক্লাস শুরু হবে, তার প্রস্তুতি নিচ্ছি। হঠাৎ করে সুমন ফোন করে বলল, ওরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শীতের ছুটিতে ক্যাম্পাসে আসছেন, ওদের পাবনা আর কুষ্টিয়া ঘুরে দেখাতে হবে।

পাবনা, কুষ্টিয়া এ দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প-সংস্কৃতির ধারক ও বাহক জেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম। শত শত বছর ধরে এই জেলা দুটি নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্যকে লালন করে আসছেন। দুদিনের সফরে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চার বন্ধু সুমন, রাহাত, ইশাদ, নাজমুল এসেছে। প্রথম দিন পাবনা, দ্বিতীয় দিন কুষ্টিয়া দেখাতে হবে। প্রথম দিনে পাবনার পর্ব শেষ করে দ্বিতীয় দিন বের হলাম কুষ্টিয়ার উদ্দেশে।

কুষ্টিয়ার কথা শুনলেই অনেক গুণী মানুষের কথা মনে পড়ে যায়, আবার মনে পড়ে যায় গ্রামে বিক্রি করা তিলের খাজার কথাও। এই কুষ্টিয়াতেই বেড়ে উঠেছেন ফকির লালন সাঁই, সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন, বাঘা যতীন, কাঙাল হরিনাথ মজুমদারসহ বিখ্যাত মানুষজন। আবার এখানেই পদধূলি দিয়েছেন আরেক বিখ্যাত মানুষ, সাহিত্যের বিশ্বকবি কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি নিয়েই এখানে গড়ে উঠেছে শিলাইদহ রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি। আমাদের গন্তব্য রবীন্দ্রনাথের সেই শিলাইদহের কুঠিবাড়িতেই।

পাবনা শহর থেকে শিলাইদহের দূরত্ব অল্প। কিছু পথ অটোরিকশাতে গিয়ে পদ্মা নদী পার হলেই শিলাইদহ। নদীর দুই পারই কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার অন্তর্ভুক্ত হলেও এ পারে মানুষের যাতায়াত পাবনা শহরকে কেন্দ্র করে।

ভোরের মিষ্টি আলো গায়ে মেখে আমরা শিলাইদহের উদ্দেশে বের হলাম। শীতটা কনকনে না হলেও এর তীব্রতা ছিল বেশ। একটা অটো নিয়ে আমরা রওনা দিলাম ঘাটের দিকে, সেখান থেকেই নৌকায় নদী পার হবো। অটো যেখানে নামিয়ে দিল সেখান থেকে বিস্তৃর্ণ চর শুরু। শীতকালে নদীর পানি কমে যাওয়ায় পদ্মায় চর জেগে ওঠে। সকালের মিষ্টি আলো এই চরের দৃশ্যতে অন্যরকম এক সৌন্দর্য এনে দেয়। চারদিকে সরিষার খেত আর মাঝখানে আঁকাবাঁকা মেঠোপথ। বাংলার প্রকৃতি যে কত সুন্দর তা এ দেশের চরাঞ্চল, নদী, হাওড়-বাঁওড়গুলো ঘুরে না দেখলে বোঝা যায় না। আমরা ইঞ্জিনচালিত একটা নৌকায় করে পঁয়তালিস্নশ মিনিটে পদ্মা পাড়ি দিয়ে পৌঁছে গেলাম শিলাইদহে।

শিলাইদহ পদ্মা নদী বিধৌত অঞ্চল হওয়ায় এর কদর অনেক আগ থেকেই ছিল। ইংরেজ আমলে এখানে নীলের চাষ হতো। রবীন্দ্রনাথের কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার শিলাইদহে জমিদারি নেওয়ার আগে শেলী নামের এক ইংরেজ এখানে নীলের চাষ করত। শেলী এবং পদ্মা নদীর স্রোতের 'দহ' থেকে পালাক্রমে শিলাইদহ নামটির উৎপত্তি ঘটে।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮০৭ সালে কুষ্টিয়া অঞ্চলের জমিদারি পান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারি দেখাশোনার জন্য ১৮৮৯ সালের নভেম্বর মাসে সর্বপ্রথম শিলাইদহে আসেন। ১৯০১ সাল পর্যন্ত তিনি অনিয়মিত বিরতিতে এখানে জমিদারি পরিচালনা করেন। এই কুঠিবাড়ি থেকে তিনি পতিসর ও সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের জমিদারি দেখাশোনা করতেন।

শিলাইদহে দীর্ঘ ১২ বছরের যাতায়াতে কবিগুরুর অনেক স্মৃতি এখানে তৈরি হয়েছে, যেগুলো আজও দৃশ্যমান। কবি এখানে কাটিয়েছেন দিনের পর দিন, নির্জনে নিভৃতে লিখেছেন অসংখ্য কবিতা আর গান। এখানে বসে তিনি রচনা করেছেন সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালীর মতো বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। ১৯১২ সালে এখানে বসেই 'গীতাঞ্জলি' কাব্যের ইংরেজি অনুবাদ শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির কারণে শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে পায়ের ধুলা পড়েছে জগদীশ চন্দ্র বসু, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, প্রমথ চৌধুরীর মতো বিখ্যাত মানুষের। এই কুঠিবাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত মানুষ মীর মশাররফ হোসেনের।

দূর থেকে পিরামিড আকৃতির ছাদের একটা বাড়ি দেখা যায়, যেটিকে অন্যসব বাড়ি থেকে সহজেই আলাদা করা যায়। টিকিট কিনে আমরা চার বন্ধু ভেতরে প্রবেশ করলাম। ভেতরে প্রবেশের আগে জেলা পরিষদের 'গীতাঞ্জলি' আর 'সোনার তরী' ভবন দুটি কবি গুরুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সাজানো ঘুচানো একটি বাড়ি। পথের দু'পাশে ফুল ফুটে আছে। তিনতলা বাড়ি যেখানে রুম সংখ্যা ১৮টি, নীচতলায় ৯টি, দোতলায় ৭টি ও তিনতলায় ২টি কামরা রয়েছে। নিচতলা আর দোতলার পুরোটাই জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে, তিনতলায় দর্শনার্থীদের প্রবেশাধিকার নেই।

পুরো বাড়িতে কবির ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র, আসবাবপত্র এবং ছবিগুলো স্থান পেয়েছে। এগুলোর মধ্যে আছে কবির অনেক দুর্লভ ছবি, কবির ব্যবহৃত পালকি, কাঠের চেয়ার, টি-টেবিল, খাট, সোফাসেট, আরাম চেয়ার, পালং, আলনা, আলমারি, স্পিডবোট, পদ্মা বোট, চিত্রকর্ম, কবিতা, হাতে লেখা চিঠি, পানি পরিষ্কার যন্ত্র, সিন্দুক, ঘাস কাটার যন্ত্র, মাটি মসৃণ করার যন্ত্র, ছিন্নপত্র ইত্যাদি। আরও আছে চঞ্চলা ও চপলা নামের দুটো স্পিডবোট, পল্টুন, আট বেহারা পালকি। দোতলায় রয়েছে একটি নজরকাড়া বারান্দা।

বাড়িটির পশ্চিমপাশে আছে পুকুরপাড়ের শান বাঁধানো বকুলতলা। এই বকুলতলাতে স্মৃতি হিসেবে গাছ লাগিয়েছেন ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরী। এরপাশে আছে দর্শনার্থী শিশুদের খেলার জায়গা এবং শৌচাগার। পূর্ব ও উত্তর পাশে রয়েছে সারি সারি আমের বাগান। এই বাগানে কবির সময়কার আমগাছগুলো এখনো আছে, যেগুলোকে স্মৃতি হিসেবে চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে। ভবনটির পেছনে কবির টেনিস কোট এখনো দৃশ্যমান। পশ্চিম পাশে মূল ভবনের সঙ্গে রয়েছে কবির ব্যবহৃত রান্নাঘর, চৌবাচ্চা এবং গভীর কূপ। এ ছাড়া ভবনটির মূল সীমানার মধ্যে দর্শনার্থীদের জন্য একটি পাঠাগার তৈরি করা হয়েছে।

প্রায় ১১ একরের এই ঐতিহাসিক স্থানটি ঘুরে দেখার সময় ছোট ছোট স্পিকারে শোনা যায় রবীন্দ্রসংগীত। দর্শনার্থীরা তখন নিজেদের আনমনেই গেয়ে ওঠেন, 'যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে' কিংবা 'আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে'। দেশ বিভাগের পর জমিদারি প্রথা বাতিল হয়ে যাওয়ার পর ১৯৫৮ সাল থেকে এই বাড়িটি সরকারের অধীনে চলে যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কবির বিভিন্ন শিল্পকর্ম সংগ্রহপূর্বক একে একটি জাদুঘর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমানে এটি বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে রয়েছে।

ভারত-বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে কুঠিবাড়ির সম্প্রসারিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বর্তমানে ভবনটির বাইরে অনুষ্ঠান করার জন্য মঞ্চ এবং একটি অডিটোরিয়াম তৈরি করা হয়েছে। যেটি রবীন্দ্র কুঠিবাড়ির প্রাঙ্গণকে আরও সৌন্দর্যমন্ডিত করে তুলেছে।

পুরো বাড়িটি ঘুরে দেখার পর কুষ্টিয়ার বিখ্যাত কুলফি আইসক্রিম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম নতুন গন্তব্যে। পেছনে ফেলে রেখেছি ১০০ বছরেরও বেশি পুরনো প্রাচীন এই স্থাপনা। যতটুকু দেখেছি তার চেয়ে অদেখার সংখ্যাই বেশি হবে। সময়ের আবর্তে এখান থেকে হয়তো হারিয়ে গেছে কবির অনেক স্মৃতি আবার অনেক স্মৃতি হয়তো অপ্রকাশিতই থেকে গেছে। এই বাড়ি নীলচাষ ও জমিদারির অনেক কালো দাগ আমাদের অগোচরেই বয়ে বেড়াচ্ছে। আজকে যেটি মানুষের চিত্তবিনোদনের জায়গা এককালে হয়তো এখানেই চোখের অনেক জল গড়িয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে