শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিশুদ্ধ বাংলাচর্চা সম্পর্কে তারুণ্যের ভাবনা

বাংলা ভাষা। আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা। এই ভাষাতেই আমরা একে অন্যের কাছে সুখ-দুঃখ-চাওয়া-পাওয়া-বেদনা-আবেগ-ভালোবাসা ইত্যাদি প্রকাশ করি। কবি কিংবা লেখক মনের মাধুরী মিশিয়ে এ ভাষাতেই লিখে যান কতশত গল্প-প্রবন্ধ-উপন্যাস-কবিতাসহ কত কিছু। ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে এমন নজির কম পৃথিবীতে। বাঙালিরা ভাষার জন্য পিচঢালা রাজপথ লাল করেছে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, হাজারও ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া বাংলা ভাষা ভালো নেই। আজ ভাষার দূষণ হচ্ছে না এমন জায়গা পাওয়া দায়। ঠিক এমন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে, ভাষার বিশুদ্ধ চর্চায় আমাদের কী করণীয় হতে পারে, সে সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের মতামত তুলে ধরেছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী- মারুফ হোসেন।
নতুনধারা
  ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় বাংলার ব্যবহার

নিশ্চিত করতে হবে

এস এ এইচ ওয়ালিউলস্নাহ

শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।

মহান ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পেরিয়ে গেলেও আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাকে ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছি। এখনো আমরা বিশ্ববিদ্যালয়সহ নিজেদের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় বাংলার চর্চা ও ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারিনি। আদালতের অধিকাংশ রায় লেখা হয় ইংরেজিতে। চীন, জাপান, কোরিয়ার মতো দেশগুলো যদি তাদের প্রাগৈতিহাসিক চিত্রলিপির বর্ণমালা দিয়ে মহাকাশ গবেষণা আর আণবিক শক্তি গবেষণার মতো কাজগুলো করতে পারে তাহলে আমরা পারব না কেন? ভাষা দূষণকে ভয়ানক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে এখনই। কেননা সঠিক ব্যবহার, চর্চা আর সার্বজনীনতার ওপর নির্ভর করে ভাষার সমৃদ্ধি। কাজেই দেশের সর্বত্র বাংলার ব্যবহার আবশ্যক করতে হবে।

মাতৃভাষার বিশুদ্ধ চর্চা জরুরি

শাকিরুল আলম শাকিল

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।

ভাষার জন্য রক্ত ঝরাতে হয়েছে পৃথিবীতে এমন দৃষ্টান্ত অনন্য। বাঙালি রক্ত দিয়ে নিজের ভাষার মান অক্ষুণ্ন রেখেছে। এটি যেমন গৌরবের তেমনি হতাশার খবর হলো আমরা প্রায়ই দেখতে পাই বাংলা ভাষার অপপ্রয়োগ, অশুদ্ধ উচ্চারণ, ভিনদেশি ভাষার মিশ্রণ হচ্ছে। যে বাঙালি মায়ের বুলিতে কথা বলার জন্য রাজপথে তাজা প্রাণ দিল, সে বাঙালি যখন ভাষার শুদ্ধ চর্চা থেকে বিরত থাকে- তা সত্যিই পীড়াদায়ক। একটু সচেতন থাকলেই আমরা মাতৃভাষার বিশুদ্ধ চর্চা অব্যাহত রাখতে পারি। প্রয়োজন আত্মশুদ্ধি আর দেশপ্রেম। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম, সংবাদপত্র, নাটক, সিনেমা, সংগীত দারুণ ভূমিকা রাখতে পারে।

মুখের ভাষা দিয়ে সব সমস্যা জয় করা সম্ভব

ফারহানা ইয়াসমিন

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।

মনের ভাব প্রকাশের বাহন হলো ভাষা- ছোটবেলা থেকে জেনে আসা লাইনগুলোর মধ্যে এটি একটি। লাইনটি যতই সাধারণ হোক না কেন, এর অর্থ বিশালের থেকেও বিশাল। ধরুন, আপনি এমন একটা দেশে আছেন এবং সেখানে বিরাট এক বিপদে পড়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় সেখানের কেউই আপনার ভাষা বোঝে না, কাউকেই আপনি আপনার সমস্যার কথা বোঝাতেই পারলেন না। তাহলে সেই সমস্যার সমাধান কীভাবে পাবেন? ওই মুহূর্তে আপনি হবেন পৃথিবীর সব থেকে অসহায় প্রাণী। তবে উলেস্নখ করার বিষয়, এমন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য ভাষা-শহীদরা জীবনের বিনিময়ে বাংলা ভাষাকে সুপরিচিত করে গেছেন বাংলার বুকে। সেই অর্জিত বাংলা ভাষা দূষণ না করে, বরং আমাদের উচিত সুন্দর করে ভাষাটি ব্যবহার করে জীবনের প্রতিটি উত্থান ও পতনের সম্মুখীন হওয়া।

ভাষা দূষণ ও আঞ্চলিকতা এক জিনিস নয়!

হোসনেয়ারা খাতুন

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া।

মাতৃভাষার জন্য দিলাম শত শত প্রাণ, তবু কেন ভাষার দূষণে যায় না আমাদের এতটুকু মানসম্মান! বলছিলাম ভাষা দূষণ সম্পর্কে। আমরা অনেকেই কথা বলার সময় বা লেখার সময় ভাষার নানা মিশ্রণ করে থাকি। বিশেষ করে লেখার ক্ষেত্রে আমরা বাংলিশে বেশি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি এবং কথা বলার সময়ও ভাষার শুদ্ধ উচ্চারণ না করে তা বিভিন্নভাবে বিকৃত করে বলে থাকি। যা আসলেই দুঃখজনক। অবশ্যই আঞ্চলিকতা থাকবে মানুষের মধ্যে। আঞ্চলিকতা না থাকলে ভাষার মাধুর্য থাকে না। অনেকে আঞ্চলিকতা ও ভাষা দূষণকে একই অর্থ বুঝে তর্ক-বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। শুধু ভাষার মাস নয়, আসুন আমরা বছরের প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহূর্ত ভাষাদূষণ থেকে দূরে থাকি।

ভাষাদূষণ করে স্মার্ট হওয়া কাম্য নয়

অনিল মো. মোমিন

শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

দাম দিয়ে কেনা বাংলা আমাদের গৌরব ও অহংকারের প্রতীক। স্বাধীকার, সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার জন্য রক্তক্ষয়ের কালজয়ী ইতিহাস থাকলেও ভাষার জন্য বাঙালির রক্তদানের মতো ঘটনা কোনো ইতিহাসে খুঁজে মেলা ভার। পৃথিবীতে প্রচলিত সাড়ে তিন হাজার ভাষার মধ্যে মাতৃভাষা বিবেচনায় বাংলার স্থান ষষ্ঠ। স্মার্ট হওয়ার নামে এখন অনেককে ভাষা বিকৃতি করতে দেখা যায়। কথায়, লেখায় কিংবা উচ্চারণে আমরা এখন বাংলাকে অনেকেই ভুলভাবে উপস্থাপন করি। অশুদ্ধ উচ্চারণ, বিকৃত বানান, ব্যবহারে অসচেতনতা ইত্যাদি যেন স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। ভাষার এমন দূষণ প্রতিরোধে সবাইকে সচেতন হতে হবে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে।

ভাষাদূষণ রোধে সচেতনতা জরুরি

নাঈমা আক্তার রিতা

শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

পহেলা বৈশাখ কিংবা ভাষার মাসে আমরা ভাষাপ্রেমী বাঙালিরা মরিয়া হয়ে উঠি ভাষার টানে। অথচ বর্তমানে বিয়ে বাড়িতে, বনভোজনে, বছরব্যাপী নানান আয়োজনে, এমনকি শিক্ষা সফরেও বাজছে হিন্দি কিংবা বিটিএসের গান। যেই বাংলার জন্য রফিক-শফিক-জব্বারদের রক্তে রাজপথ ভেসেছিল সেই বাংলায় এক মিনিট কথা বলতে পারাটা বর্তমান প্রজন্মের কাছে ভীষণ কঠিন বিষয়। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো দেশের অভ্যন্তরেই সর্বস্তরে ভাষাটির প্রয়োগ নেই এবং ভাষাটির অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা নেই। দুঃখের সঙ্গেই বলছি, ভাষাদূষণ বেশি দেখা যায় আমাদের শিক্ষিত সমাজের মধ্যেই। ভাষাদূষণ রোধে সবার আগে নিজেকে সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি ১৯৮৭ সালের ভাষা প্রচলন আইন কার্যকর করতে হবে।

ভাষার মিশ্রণ কাম্য নয়

লাইজু আক্তার

শিক্ষার্থী, নারায়ণগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ।

বাঙালি ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে। তবুও নিজের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায় করে নিয়েছে। ভাষা সৈনিকদের প্রাণ দিয়ে ছিনিয়ে আনা অধিকারের জন্য আজ আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, আমরা সেই ভাষার মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হচ্ছি। আমরা এতটাই আধুনিক হয়েছি, না আমরা আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলি আর না বলি প্রমিত ভাষায়। আমরা একটা নতুন ভাষার জন্ম দিয়েছি 'বাংলিশ' নামে। আমরা এখন বাংলার সাথে ইংরেজি, উর্দু, ফারসি, হিন্দির মিশ্রণে কথা বলি। কথায় কথায় যাতে আমরা বাংলা ভাষার সাথে অন্য ভাষার মিশ্রণ না করি সেদিকে লক্ষ্য রাখা উচিত।

ভাষার মান রক্ষা করতে হবে

হাসান মাহমুদ শুভ

ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর।

আমরাই একমাত্র জাতি যারা ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছি। যা ইতিহাসে বিরল! বাংলা ভাষা আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, আবেগ, ভালোবাসা, চেতনা, অহংকার, বেঁচে থাকার অস্তিত্ব। অথচ আমরা সেই ভাষার সঠিক মর্যাদা রক্ষা করতে পারিনি! বাংলা ভাষার অপপ্রয়োগ এবং ভিনদেশি ভাষার ক্রমবর্ধমান আগ্রাসনে বাংলা ভাষার নিজস্বতা ও ভাষাগত ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, ব্যাংক-বীমা থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে ইংরেজিসহ ভিনদেশি ভাষার ছড়াছড়ি। এমন পরিস্থিতিতে বাংলা ভাষার নিজস্বতা ও মর্যাদা রক্ষার্থে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

শুদ্ধ বাংলা ভাষার চর্চা জরুরি

ফারহানা আফসার মৌরী

শিক্ষার্থী, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলিশ শব্দটির সাথে আমরা কমবেশি সবাই পরিচিত। আধুনিক সাজতে গিয়ে বাংলা কথার সাথে দু'চারটে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করা একটা ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাথে সাথে বর্তমান প্রজন্ম হারিয়ে ফেলছে একুশের চেতনা! ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রম্নয়ারি যে ভাষা শহীদরা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন শুধু বাংলা ভাষার মর্যাদার জন্য; সে একুশের চেতনা ভুলে গিয়ে স্মার্টনেসের মানদন্ড হিসেবে বাংলাকে ইংরেজি ভাষার পিছনে ফেলে দিচ্ছি। এতে শুধু বাংলা ভাষা দূষণই হচ্ছে না, সাথে গোটা বাঙালির ইতিহাসকেও অবমাননা করা হচ্ছে। তাই তরুণ প্রজন্মের কাছে একটাই চাওয়া! একুশের চেতনাকে বুকে ধারণ করে শুদ্ধ বাংলা ভাষার চর্চা করা হোক।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে