বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

কী ভাবছেন তারা বাংলা ভাষা নিয়ে

বাংলা ভাষা বাঙালির হৃদয় স্পন্দন। ভাষা আন্দোলনের মধ্যে শুরু হয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা। এই চেতনা থেকেই বাঙালি স্বাধীন জাতি। বাঙালি জাতির পরিচয়বাহক এ বাংলা ভাষা আজ কালের স্রোতে দূষিত। বিভিন্নভাবে বাংলা ভাষার মধ্যে অন্য বিদেশি ভাষা প্রবেশের ফলে ভাষার সৌন্দর্য হারিয়ে যাচ্ছে। প্রয়োজনের নামে কমিয়ে ফেলা হচ্ছে বাংলা ভাষার মর্যাদা। মুখে মুখে গৌরবের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে বিদেশি ভাষা। বাংলা ভাষার মর্যাদা অক্ষুণ্ন এবং ভাষাকে জীবিত রাখতে ভাষার মাসে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কী ভাবছেন তা তুলে ধরেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস সাংবাদিক আবু সুফিয়ান সরকার শুভ
নতুনধারা
  ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

বাংলা ভাষার মর্যাদা অটুট থাক

সাবিহা তাবাসসুম শুচি

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের ঝুলিতে সবচেয়ে গৌরবময় অর্জন হলো মাতৃভাষা বাংলা। আমরা গর্ব করে বলতে পারি, পৃথিবীর বুকে আমরাই একমাত্র জাতি যারা ভাষার মান রাখতে রক্ত দিয়েছি। কিন্তু আমরা কি যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারছি আমাদের এই রক্তাক্ত ভাষাকে? বিভিন্ন বিদেশি ভাষার সংমিশ্রণে আমাদের মিষ্টি মাতৃভাষা হারিয়েছে তার শ্রম্নতিমাধুর্য। শিক্ষা, চাকরিসহ আরও অনেক ক্ষেত্রেই বাংলার তুলনায় ইংরেজি ভাষায় পারদর্শিতাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তবে হঁ্যা, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এগিয়ে থাকার জন্য আমাদের অবশ্যই অন্যান্য ভাষা চর্চার প্রয়োজন আছে; কিন্তু সেটা মাতৃভাষাকে পেছনে ফেলে নয়। আমাদের দেশের কিছু নাটক ও চলচ্চিত্রে বর্তমানে ভাষার অপব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আবার কিছু তরুণ লেখক অর্থ ও খ্যাতির জন্য ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ না রেখেই বইমেলায় একের পর এক বই প্রকাশ করে যাচ্ছেন, যাতে বাংলা ভাষার মর্যাদা ও সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে তরুণ প্রজন্মের উচিত বাংলা ভাষা চর্চা ও গবেষণার প্রতি আরও বেশি উদ্বুদ্ধ হওয়া। শুদ্ধ ও সুন্দর বাংলা চর্চার মাধ্যমে কথোপকথনকে আরও বেশি আড়ম্বরপূর্ণ করে তোলা।

তরুণদের অনুপ্রেরণার নাম ফেব্রম্নয়ারি

সোহানুর রহমান সুবেল

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

ফেব্রম্নয়ারি তোমার কথা মনে হলেই কানে বাজে তরুণদের জয়ধ্বনি। ফেব্রম্নয়ারি নামটা শুনলেই কেন জানি রক্তে কেমন একটা টান লাগে। পরক্ষণেই মনে পড়ে এই মাসটার জন্য যে অনেকেই রক্ত দিয়েছে। কারণ তাদের রক্ত যে আমাদের রক্তে বয়ে চলেছে। এর জন্যই হয়তো আমাদের এতটা টান। ফেব্রম্নয়ারি শুনলেই মনে পড়ে যায় রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত আরও নাম না জানা অনেকেই যাদের জন্য আমাদের মুখের এই ভাষাকে আপন করে পেয়েছি। তারা না জন্ম নিলে হয়তো বাংলা ভাষার জন্ম হতো না। তারা রয়ে যাবেন ফেব্রম্নয়ারির সকালবেলার সূর্য উদয় হয়ে। তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আজকে আমরা হাস্যোজ্জ্বল সূর্য উদয় দেখতে পারি। তাদের জন্য তরুণরা আজকে শক্তি করে বলতে পারে তারুণ্যে মানুষকে জিততে শেখায়, তারুণ্য মানুষকে ত্যাগ শেখায়, কীভাবে অধিকার আদায় করা হয় তা শেখায়। তাই আজকের তরুণরা তাদের বুকে ধারণ করে নিজেদের বড় হয়ে ওঠার স্বপ্ন বোনে। তাই এই সময়ের তরুণরা চায় তাদের মতো আত্মত্যাগী হয়ে নিজেকে গড়ে তুলতে। ১৯৫২ তারই এক কোণ আমাদের সকলের ভিতরে জীবিত অবস্থায় রয়ে যাবে চিরজীবন।

বাংলা ভাষার অবহেলা বন্ধ হোক

আজহারুল ইসলাম শুভ্র

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

'ফেব্রম্নয়ারি' মনে করিয়ে দেয় ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংগ্রাম, চেতনা আর সালাম, রফিকদের ত্যাগ-তিতিক্ষার অশ্রম্নঝরা গল্প। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের পর অনেকবার ভাষা দিবস পালিত হয়েছে, শহীদদের স্মরণ করে অনেকবার বেদিতে ফুল দেওয়া হয়েছে; কিন্তু সর্বস্তরের বাংলা কি আজও চালু হতে পারেনি। আমরা এখনো বাংলা ভাষাকে প্রাপ্য সম্মান দিতে পারিনি। এখনো অফিস, আদালত, মন্ত্রণালয়, সচিবালয়গুলোতে ইংরেজির যৌবন চলে। পথে-ঘাটে দোকানপাটের দিকে তাকালেই দেখা যায় ইংরেজির প্রচলন। বড় বড় সরকারি-বেসরকারি প্রোগ্রামের ব্যানারের দিকে তাকালেও দেখা যায় ইংরেজির প্রচলন। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো সিলেবাস থেকে বাংলা তুলে দিতে অস্থির। অনেকেই বাংলা ভাষায় কথাই বলতে পারে না। যেই ভাষার জন্য তাজা প্রাণ দেওয়া হয়েছিল, জীবন দেওয়া হয়েছিল সেই ভাষা আজ অবহেলিত। আমরা সালাম, রফিকদের রক্তের সম্মান দিতে ব্যর্থ হচ্ছি। শুধু ২১ ফেব্রম্নয়ারিতে ভাষা দিবস পালন করেই ক্ষান্ত না হয়ে বাংলা ভাষাকে সর্বস্তরের ভাষা হিসেবে প্রচলন করা হোক। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে বাংলা ভাষার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হোক।

ভাষার মাসে ভাষা বিকৃতি বন্ধ হোক

ইমতিয়াজ আহমেদ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

ভাষার মাস ফেব্রম্নয়ারি এই সালাম, বরকত ও রফিকদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ হয়; কিন্তু ভাষা বিকৃত করার ফলে তাদের সেই আত্মত্যাগের তেমন কোনো মূল্যই আমরা দিতে পারিনি। আজ-কাল চারদিকে যেন ভাষাকে নিয়ে রসিকতা। আমরা আমাদের আপনজনদের নাম বিকৃত করে উচ্চারণ করে থাকি। হয়তো তা করা হয় রসিকতার সুরে; কিন্তু নিঃসন্দেহে তা ভাষার বিকৃতি। আজ-কাল ভাষা বিকৃতির কেন্দ্রস্থল যেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো। এখানে মানুষজন বিভিন্ন স্ট্যাটাস, কমেন্টস এবং মেসেজ করার সময় বাংলা ভাষার বিভিন্ন শব্দের বানানে অনেক ভুল করে থাকে এবং রসিকতা করে অনেক শব্দ উচ্চারণ করে থাকে যা ভাষার স্বাভাবিক বিকাশকে নষ্ট করে। আবার অনেকেই আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা মানুষকে নিয়ে রসিকতা করে যা মোটেই কাম্য নয়- কেননা অঞ্চলভেদে ভাষার পরিবর্তন বা উপভাষাগুলোই হলো ভাষার সৌন্দর্য। সর্বোপরি ভাষার মাসে ভাষা বিকৃতি বন্ধের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে মাসটিকে উদযাপন করি।

বাংলা ভাষাকে সম্মান করা উচিত মন থেকে

রাকিব হোসেন

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

ভাষা! সম্পূর্ণরূপে, সহজতর উপায়ে এবং দ্বিধাহীনতার সঙ্গে মাধুর্য মিশিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করার মাধ্যমই ভাষা। দেশ, জাতি, বর্ণ, গোষ্ঠী ইত্যাদি ভেদ হলেও সব মানুষই মায়ের মুখ থেকে শেখা ভাষায় কথা বলতে সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। আর বাঙালি জাতির এই মাতৃভাষা 'বাংলা'র সম্মান রক্ষার্থে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রম্নয়ারি ভাষা আন্দোলন নামে একটি প্রতিবাদ করেছিল যা পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম কোনো অভাবনীয় ঘটনা। সালাম, বরকত, জব্বার, শরিফ, শফিউর নাম না জানা আরও কতই না ভাষাপ্রেমিক মানুষ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রম্নয়ারি ভাষার জন্য শহীদ হয়েছিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে দিয়ে যাতায়াত করার সময় মনের অন্তরালে কল্পনার মাধ্যমে ভেসে ওঠে সালাম, বরকতের সেই প্রতিবাদের গর্জন-রূপ এবং শহীদ হওয়ার দৃশ্যপট। কিন্তু আফসোসের বিষয়- শহীদ হওয়া, রক্ত দেওয়া এবং প্রতিবাদের মাধ্যমে পাওয়া বাংলা ভাষাকে সঠিক সম্মান-মর্যাদা আমরা দিচ্ছি না। বরং ইংরেজি ভাষা কিংবা মিশ্রিত বাংলা-ইংরেজি ভাষার মতো অপব্যবহার করছি। আমাদের উচিত, মন থেকে বাংলা ভাষাকে সম্মান করা।

ভাষার মাসেই শুরু হোক বাংলার শুদ্ধ ব্যবহার

আফরিতা জাবিন অমি

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

'ফেব্রম্নয়ারি' বাতাসে জয়ের আভাস, প্রকৃতিতে বিজয়ের উলস্নাস, এ যে ভাষার মাস। ভাষার এই আন্দোলনে প্রথম শহীদ রফিক। এমন অসংখ্য তাজা প্রাণ তাদের বুকের রক্ত দিয়ে অর্জন করেছে অ, আ, ক, খ। এই অর্জন অমূল্য, তাই ভাষার সম্মান রক্ষা আমাদের অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু বর্তমানে তরুণ প্রজন্ম বাংলা ভাষার শুদ্ধ প্রয়োগে খানিকটা ব্যর্থ। তারা বাংলা ভাষার সঙ্গে তথাকথিত আরও ভাষা জুড়ে বাংলা ভাষাকে বানিয়ে দিয়েছে 'বাংলিশ'। যা ভাষার ব্যঙ্গ বলা চলে। তাছাড়া বর্তমানে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের ছোটবেলা থেকেই ইংরেজি শিক্ষায় উৎসাহিত করে কিন্তু শুদ্ধ বাংলা শিক্ষা দেওয়ায় তাদের কোনো আগ্রহ নেই। আরও বেশ কিছু কর্মস্থল এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখন বাংলা বলাকে অনুৎসাহিত করা হয়, এমনকি বাংলা বলাটাকে অপমানজনক মনে করা হয়। দেশের সর্বোচ্চ আদালতেও পুরোপুরি শুদ্ধ বাংলা ভাষার ব্যবহার হয় না, এতে আমাদের ভাষা শহীদদের ত্যাগ এবং অর্জনকে লাঞ্ছিত করা হয়। এই ভাষার মাসে দূর হোক বাংলা ভাষার অসম্মান এবং গস্নানি। চর্চা হোক শুদ্ধ বাংলার, জয় হোক অ, আ, ক, খ'র।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে