শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঘুরে এলাম মন ভোলানো দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার

রায়হান উদ্দিন
  ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মোহনীয় আকর্ষণে আঁকড়ে ধরে আছে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার। যারা ভ্রমণ করতে পছন্দ করেন তারা সময় পেলেই ছুটে যান কক্সবাজারসহ অনেক পর্যটন এলাকায়। সবাই দল বেঁধে একসঙ্গে যাওয়ার জন্য সময় খুঁজে নিই ছুটির দিন। এবারও বাড়ির সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। কোথায় ঘুরতে গেলে ভালো হবে সেটা নিয়েই আলোচনা। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম এবার বাড়ির সবাই মিলে ঘুরতে যাব কক্সবাজার। জমবে আড্ডা, ঘুরব আমরা কক্সবাজার। এ আনন্দভ্রমণে আমাদের সঙ্গী ১৬ জন। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম বৃহস্পতিবার উঠব গাড়িতে ২ দিন ঘুরে শনিবার চলে আসব। বহদ্দারহাট বাস কাউন্টারে যখন আগেভাগে টিকিট কিনতে গেলাম তখন মোস্তফা, তাওসিফ কল দিয়ে বলে ওরাও নাকি যাবে আমাদের সাথে। আমাদের সঙ্গী হয়ে গেল ১৮ জন। টিকিট কিনতে গেল রবিন। রবিন সব দায়িত্ব সামলাবেন। সবাইকে বলা হলো রাত ২টায় গাড়ি ছাড়বে, সবাই যেন বাস কাউন্টারে ১টার মধ্যে থাকে। আমরা বের না হতেই রাশেদ কল দিল ও বাস কাউন্টারে গিয়ে বসে আছে অনেকক্ষণ ধরে। আমরাও গিয়ে চাটগাঁও বাস কাউন্টারে পৌঁছলাম। আমরা পৌঁছতে না পৌঁছতে টুটুল এসে পৌঁছল।

মিজানরা আসার আগেই সিনিয়র ভাই জাবেদ ভাইরাও এসে পৌঁছেছেন, মিজানরা পৌঁছেছে গাড়ি ছাড়ার একটু আগে। রওনা দিলাম কক্সবাজারের উদ্দেশে। আমাদের গাড়ি ছেড়েছে রাত ২টা ১০ মিনিটে। আমাদের বাস ভাড়া পড়ল জনপ্রতি ৩৭০ টাকা। কক্সবাজারে কলাতলি বিচের সামনে নামলাম ৫টা ২০ মিনিটে। সড়কপথে ঢাকা থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার আর চট্টগ্রাম থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে রয়েছে দীর্ঘতম এই সমুদ্রসৈকত। রাতের বেলায় জ্যামের ক্লান্তিটা সহ্য করতে হয় না। আরামে গন্তব্যে চলে যাওয়া যায়। আমরা তাই রাতেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমরা নেমেই কলাতলি মোড় থেকে ভিতরে গলিতে হোটেল খুঁজতে শুরু করলাম। ছুটির দিন থাকাই পর্যটক অনেক। একটু দেখেশুনে নিয়ে নিলাম হোটেল? ঘুরে দেখেশুনে হোটেল নেওয়া ভালো। আমরাও দরদাম করে নিয়ে নিলাম হোটেল। হোটেল নেওয়ার সময় অনেক দালাল দেখা যায়, তাই সাবধান থাকবেন। হোটেলে কিছুক্ষণ রেস্ট করেই বের হয়ে গেলাম। সবাই মিলে নাশতা করে চলে গেলাম সুগন্ধা বিচে। হেঁটেই চলে যাওয়া যাবে। দেখলাম বালুকাময় সমুদ্রসৈকত। নোনাজলে ফেনিল ছাপ স্পষ্ট, সমুদ্রের গর্জন কিনারে চলে আসে, আছড়ে পড়ে ঢেউ। তা দেখে সবাই মুগ্ধ হচ্ছে? দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, যার সুদীর্ঘ ১২০ কিলোমিটার। শুধু তাই নয়, দিগন্ত বিস্তৃত নীল সমুদ্র, সারি সারি ঝাউবন, শীতল বাতাস, আশপাশের পাহাড় দীর্ঘ এ সমুদ্রসৈকতের মনোরম দৃশ্য মনের মধ্যে মুহূর্তে প্রশান্তি এনে দিচ্ছে। বিকালের দৃশ্য দেখার মতো। অস্তের সময় দিগন্তের চারদিকে স্বপ্নিল রং জোড়ানো সে বিদায় জানায়। এসব সৌন্দর্যের পসরা নিয়ে বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে রচনা করেছে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার। এসব দেখেই আমরা মনোরম দৃশ্যগুলো উপভোগ করছি সবাই। সমুদ্রের সুগন্ধা বিচে নেমে নোনা পানিতে বড় বড় ঢেউয়ের মধ্যে মজা করতে পেরে সবার মধ্যে কি আনন্দ না বইছে। সবাই গোসল করার সময় রাশেদ প্রিয় চশমাটা ঢেউয়ের সঙ্গে চলে গেল, তবুও সে ঢেউ তাকে হতাশ করেনি? ঢেউ দেখে সে অনেক মুগ্ধ হয়েছে। হাসান ভাইয়ের চশমা পড়ে গেলেও ধরে পেলল। তিনি চশমা ছাড়া এক মিনিটও চলতে পারেন না। ভাগ্যবশত পেয়েও গেল চশমা। আর সিরাজ আঙ্কেল যাওয়ার সময় বলে রাখছিল সমুদ্রে নামবে না। কিন্তু সমুদ্রের এরকম ঢেউ, সমুদ্রের এত সৌন্দর্য দেখে ওনিও না নেমে থাকতে পারল না। আপনারা সমুদ্রে নামার আগে মোবাইল, টাকা সাবধানে রাখবেন। প্রয়োজনীয় কোনো জিনিস নিয়ে সমুদ্রে নামবেন না? গোসল করে চলে গেলাম লাবণী পয়েন্টের সেদিকে। আমরা দুই দল ভাগ করে ফুটবল খেললাম সমুদ্রের পাড়ে। খেয়াল রাখবেন দূরে গিয়ে খেলার জন্য যে কোনো খেলা, যেখানে পর্যটক থাকে না। কারণ বল গায়ে পড়েও অঘটন ঘটতে পারে যে কারও। তাই দূরে গিয়ে খেলার চেষ্টা করবেন। আমরা ফুটবল খেলেই আবার নোনা পানিতে লাবণী পয়েন্টে সবাই মিলে গোসল করলাম। এরপর চলে গেলাম হোটেলে। মনে রাখবেন সমুদ্রে গোসল করে আবার হোটেল বা পুকুরে, টাকা দিয়ে হলেও গোসল করে নেবেন।

আমরা গোসল সেরে দুপুরের ভাত খেতে চলে গেলাম। আমরা কয়েকটা রেস্টুরেন্টে দাম দেখলাম। কারণ এক এক দোকানে এক এক দাম খাবারের। তাই দেখেশুনে একটাতে বসলাম সবাই। আমরা জনপ্রতি ১০০ টাকা করে খাওয়া যাবে ভালো করে এরকম একটা রেস্টুরেন্ট পেলাম। মামার দোকানে অনেক ভালো রান্না হয়। ভ্রমণপিপাসুরা সুগন্ধা বিচ থেকে মূল সড়কের পাশেই ভিতরে করে অনেক রেস্টুরেন্ট পাবেন যেখানে খেতে পারবেন। আমরা ভাত খেয়ে ২ ঘণ্টার মতো হোটেলে রেস্ট করলাম। বিকাল ৪টা করে চলে গেলাম শৈবাল বিচে। আমরা তাড়াতাড়ি যাওয়ার জন্য টমটম নিলাম। টমটমের ভাড়া ৫০ টাকা করে নিল ২টা টমটম। আমরা সবাই ২টা টমটমে বসলাম। শৈবাল বিচে গিয়ে দেখি অসম্ভব সুন্দর। সন্ধ্যাকালে শৈবাল বিচে গেলে অনেক সুন্দর দৃশ্য দেখা যায়। সন্ধ্যার পর আমরা সমুদ্রের পাড়ে হেঁটে হেঁটে সমুদ্রের মায়াবী রূপ দেখে দেখে সুগন্ধা বিচের সেদিকে গিয়ে বের হয়ে নাশতা করলাম। তারপর আবার হোটেলে গিয়ে রেস্ট করলাম। রেস্ট করার সময় সবাই একরুমে এসে অনেক মজা করল। রবিন আর মিজান নাচতে শুরু করল। আমরা সবাই হাততালি দিচ্ছিলাম। ছবি, ভিডিও করছে শওকত আঙ্কেল। আমরা ১০টা করে রাতের খাবার খেলাম। রাতের খাবার খেয়ে চলে গেলাম লাবণী বিচের সেদিকে। সবাই বিচে চেয়ার নিয়ে বসে থাকল। শীতল হাওয়া লাগছে গায়ে ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব কত না অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য? তার মধ্যে কানে বাজতেছে সমুদ্রের গর্জন। তা দেখতে দেখতে আরিফ শুরু করে দিল তাসরিফ খানের গাওয়া গান 'মন বসে না শহরে ইট পাথরের নগরে, তাই তো আসলাম সাগরে; তাই তো আইলাম সাগরে। এই সাগর পাড়ে আইসা আমার মাতাল মাতাল লাগে।' আমরা সবাই ওর সঙ্গে গাওয়া শুরু করে দিলাম। ইকবালও মোবাইলে ছেড়ে দিল জেমস ও আইয়ুব বাচ্চুর গান।

আমরা সমুদ্রের পাড় থেকে রাত ১টা বাজে চলে এলাম। ভোরে উঠেই চলে গেলাম সূর্য উদিত হওয়ার দৃশ্য দেখতে। তাকিয়ে রইলাম বারবার, সমুদ্র থেকে উঠছে আবার, আলোকিত হয়ে যাচ্ছে চারপাশ। এরপর নাশতা করলাম সবাই মিলে। নাশতা করেই ঝাউবাগানে চলে গেলাম। ঝাউবাগানের অপরূপ সৌন্দর্য দেখে যে কারও মন প্রশান্তিতে নিমিষেই ভরে যাবে। সমুদ্রের চিরায়ত সৌন্দর্যের চেয়ে বালিময় পরিবেশে সবুজ গাছের সারির ছবি যে কাউকে মুগ্ধ করে। আবার ডলফিন বিচে গিয়ে নেমে গেলাম গোসল করতে? মাহফুজ বলল সে নামবে না। আমাদের সবার মোবাইল, ঘড়িসহ প্রয়োজনীয় জিনিস সবকিছু তাকে রাখতে দিলাম। সবাই নামলাম সমুদ্রে, গোসল করলাম, মজা করলাম অনেক। কক্সবাজার গেলে পর্যটকরা সাধারণত কলাতলি, ডলফিন ও লাবণী সৈকতে গোসল করে। এরমধ্যেই লাবণী পয়েন্টে ভিড় বেশি হয়। আমরা ৩টাতেই গোসল করলাম। এরপর হোটেলে গিয়ে গোসল করে নিলাম ১১টার মধ্যে। কারণ হোটেল ছেড়ে দিতে হবে ১১টা বাজে? আমরা একদিনের জন্য নিয়েছি হোটেল। এরপর সবার জিনিসপত্র হোটেলের রিসিপশনে রেখে সবাই মিলে পরিবারের জন্য কেনাকাটা করতে চলে গেলাম লাবণী পয়েন্টের সেখানে ঝিনুক মার্কেটে। সবাই যে যার মতো কেনাকাটা করল। আপনারা চাইলে বার্মিজ মার্কেটেও যেতে পারবেন, সেখানে পাইকারি দামে আচার, চকোলেটসহ বিভিন্ন কিছু বিক্রি করা হয়। সুগন্ধা বিচের সেখানেও অনেক দোকান আছে, সেখান থেকেও কেনা যাবে। সুবিধা মতো যে কোনো জায়গা থেকে কেনা যায়। আমরা সবাই কেনাকাটা করার পর ক্লান্ত হয়ে সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে চেয়ারে বসল সবাই। একটা চেয়ার নাকি ১ ঘণ্টা ৩০ টাকা করে। সবাই বসে সেখানে আড্ডা দিলাম। এমন সময় ছোট বাচ্চা দুইটা এসে বলছে মাসাজ করবে নাকি? বাবু বলতেছে কত টাকা? বাচ্চা দুইটা ৩০ টাকা বলল। রিফন, ছাবের বলতেছে আমাদের করে দাও ২০ টাকা করে। বাচ্চা দুইটাও রাজি হলো। মাসাজ করতে করতে বাচ্চা দুইটা গানও করল। জাবেদ ভাইও মাসাজ করে নিল। জাবেদ ভাই জিজ্ঞেস করছে বাচ্চা দুইটাকে কত টাকা পাই দিনে? ওরা বলছে- একটু রাত পর্যন্ত থাকলে ১৫০০ টাকা কামানো যায়। ১ ঘণ্টা শেষ হওয়ার পরে চেয়ার ছেড়ে দিতে বলল। দুপুরের সময়ও হয়ে গেল। আমরা রেস্টুরেন্টে গিয়ে দুপুরের ভাত খেলাম। আমরা ভাত খেয়ে রিসিপশনে যেতেই হাসান ভাই বলল ওনার আরও কিছু জিনিস কিনতে হবে। ওনি আর এমরান গিয়ে কিনে নিয়ে এলো। ওনারা আসা মাত্রই আমরা সবার যাবতীয় জিনিসপত্র নিয়ে টমটমে উঠলাম। ভাড়া নিল ১ গাড়ি ৫০ টাকা করে কলাতলি মোড়। কলাতলি মোড়ে গিয়ে টিকিট নিয়ে ফেললাম। ছুটির দিন হওয়ায় যাত্রীর চাপ বেশি। আমরা ৪টার টিকিট পাইলাম। ৪টা ১০ মিনিট করে গাড়ি ছাড়ল। সমুদ্রসৈকত ছাড়াও আপনারা চাইলে ইনানী বিচ, হিমছড়িও ঘুরে আসতে পারেন। এ ছাড়া কক্সবাজার শহরে বার্মিজ মার্কেট, বৌদ্ধ মন্দির, হিলটপ রেস্টহাউস ইত্যাদি কক্সবাজার ভ্রমণের অন্যতম দ্রষ্টব্য স্থান। এক মজার অনুভূতি নিয়ে যে যার বাসায় চলে এলাম। মানসিক প্রশান্তি এবং বিনোদনের জন্য কক্সবাজার অন্যতম দর্শনীয় স্থান। সৌন্দর্যের পসরা নিয়ে মোহনীয় আকর্ষণে কেড়ে নিই এই সমুদ্রসৈকতটি। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত একটি মায়াবী ও রূপময়ী সমুদ্রসৈকত।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে