শ্রীমঙ্গল শহরটা ছোট্ট, তবে বেশ গোছানো। এই শহরের সব স্থাপনার মধ্যেই নান্দনিকতার ছাপ। শহরের বেশির ভাগটাজুড়েই রয়েছে চা-বাগান। এখানে আপনি যেদিকেই তাকাবেন দুচোখ জুড়ে দেখবেন চায়ের বাগান। যা দেখলে চোখ জুড়ে খেলে যাবে এক অপরূপ সুন্দর ও সবুজের সমারোহ। তাই এবার মিনহাজ উদ্দিন রুবেল ভাই ও আমি বাইক নিয়ে ঘুরে আসি শ্রীমঙ্গলের আকর্ষণীয় চা বাগানে-
চা বাগান মানেই 'অ্যাডভেঞ্চার'। সবুজের চাদরে মোড়ানো চা বাগান আমাদের কাছে খূবই আকর্ষণীয়। বাংলাদেশে মোট ৭টি ভ্যালি রয়েছে এর মধ্যে সিলেট বিভাগে রয়েছে ৬টি। এই ভ্যালিতে মোট চা বাগানের সংখ্যা ১৩৮টি। শুধু শ্রীমঙ্গলে রয়েছে ৩৮টি চা বাগান। এ জন্য শ্রীমঙ্গলকে চায়ের রাজধানীও বলা হয়। এত চা বাগান, আপনি কোন বাগান দেখতে যাবেন সিদ্ধান্ত নিতে কষ্ট হবে। কারণ শ্রীমঙ্গলের পূর্বদিকে কিছু অংশ হাওড় ছাড়া পুরো উপজেলাজুড়ে শুধু চা বাগান। আপনি যখন মাইলের পর মাইল চা বাগানের ভিতর দিয়ে চলবেন তখন আপনার মনে হবে বিশ্বের সব সৌন্দর্য যেন আপনার সামনে। একটি রিকশা, মিশুক কিংবা প্রাইভেট কার নিয়ে প্রবেশ করুন চা বাগানের ভিতর। চা বাগানের ঢোকার পর মনে হবে ভিন্ন পরিবেশ। মনে হবে কোনো দক্ষ শিল্পী যেন মনের মাধুরী মিশিয়ে স্তরে স্তরে সবুজকে সাজিয়ে রেখেছে। চারপাশে কেবল সবুজের মেলা। চা বাগান দেখা শেষ হয়ে গেলে আপনি চলে যেতে পারেন লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে। শ্রীমঙ্গল থেকে ভানুগাছ-কমলগঞ্জ রাস্তায় ৭ কিলোমিটার এগোলেই লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। জীববৈচিত্র্য ও বন্যপ্রাণীর মহামিলনের নান্দনিক সৌন্দর্যের স্থান লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যমন্ডিত লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ট্রপিক্যাল ফরেস্ট'খ্যাত। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এই উদ্যানে পশু-পাখি দর্শনের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান। যেখানে উঁচু-নিচু পাহাড়ের গায়ে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে হাজার হাজার প্রজাতির লাখ লাখ বৃক্ষ। ন্যাশনাল পার্কে প্রবেশ করা মাত্রই আপনি দেখবেন চারদিকে হালকা অন্ধকার রাস্তায় দু'পাশের বৃক্ষগুলো দিবাকরের আলোক রশ্মিকে আটকে রেখেছে। মাঝেমধ্যে বৃক্ষসারির মগডালে চোখ রাখুন দেখবেন বানর আর হনুমান লাফালাফি করছে। একটু ভেতরে প্রবেশ করলে আপনার চোখে পড়বে খাটাস, বনমোরগ, উলস্নুক, মেছোবাঘ, বন বিড়ালসহ বিভিন্ন জীবজন্তু আর পার্কের বিশাল বিশাল বৃক্ষরাজি, জীবজন্তুর হুঙ্কার, ঝিঁঝি পোকার শব্দ, বানরের লাফালাফি, ঝাঁক ঝাঁক উলস্নুকের ডাকাডাকি একটু সময়ের জন্য হলেও আপনার ব্যস্ত জীবনের ক্লান্তি দূর করে মনে এনে দেবে প্রশান্তির ছোঁয়া। সীমিত শহরের ব্যস্ত জীবনের ফাঁকে এখনো মানুষ পেতে চায় শ্যামল অভয়ারণ্যের ছোঁয়া কিংবা একটু নিস্তব্ধতার একাকিত্ব।
শ্রীমঙ্গল থেকে শ্যামলীর উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার পর পরই প্রথমে চোখে পড়বে রাস্তার দু'পাশে দৃষ্টিজুড়ে চায়ের বাগান। বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের রাস্তা পেরিয়ে চোখে পড়বে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষগুলো। হঁ্যা, এগুলোই রাবারগাছ। এর পর পরই সহজেই চোখে পড়বে কাশফুলের সাদা পাহাড়। নীল আকাশের নিচে সবুজের গালিচা, তারই একপাশে শরতের বাতাসে দোল খেয়ে যাচ্ছে কোমল কাশফুলগুলো। আর হঁ্যা বেড়ানোর ফাঁকে এককাপ চা হলে মন্দ হয় না। রীতিমতো অবিশ্বাস্য। বিস্ময়কর তো বটেই। এক কাপে ৭ রঙের চা! এটি উদ্ভাবন করেছেন রমেশ রাম গৌড়। আলোড়ন সৃষ্টিকারী রমেশের চায়ের দোকানে খুব সহজেই পৌঁছাতে পারেন। শ্রীমঙ্গল শহরের কালিঘাট রোড ধরে এগিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের রাস্তায় যেতে বামদিকে চেখে পড়বে বিজিবির ১৪ রাইফেলস ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর এলাকায় মিনি পার্কের আদলে গড়ে ওঠা 'নীলকণ্ঠ চা কেবিন। মিডিয়ার বদৌলতে তার আবিষ্কৃত দুই থেকে আট রঙা চায়ের খ্যাতি দেশের সীমা ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে ভিন দেশে। দেশের উচ্চপদের সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তা, বিভিন্ন দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত, রাজনীতিবিদ, চলচ্চিত্র ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা পর্যটকরা তার চায়ের স্বাদ নিয়েছেন। রমেশের সঙ্গে তার ছবি তুলেছেন। পরিদর্শন খাতায় লিখে গেছেন বিস্ময়কর রমেশের চায়ের ভূয়সী প্রশংসা।
শ্রীমঙ্গলে এসে শুধু সবুজের ছোঁয়া নেবেন তাতো হয় না একটু পানির ছলছল শব্দ শোনাও তো দরকার। তাই চলে যান শহরের কাছাকাছি জাগছড়া চা বাগানের ১৪নং সেকশনে যজ্ঞ কুন্ডের ধারায়। সেখানে রয়েছে অপরূপ সৌন্দর্য সমৃদ্ধ শ্রীমঙ্গলের একমাত্র ঝর্ণা। যারা এ ঝর্ণাকে প্রথম দেখবেন তারা অবশ্যই বিস্মিত হবেন। এটিও অপরূপ একটি সৃষ্টি। ঝর্ণাটি দেখতে আপনি শ্রীমঙ্গল শহর থেকে মৌলভীবাজার রোড হয়ে কাকিয়াবাজার নেমে ডান দিকে জাগছড়া চা বাগানে যাবেন অথবা শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ভাড়াউড়া ও সোনাছড়া চা বাগান হয়ে মেঠো রাস্তায় জাগছড়া চা বাগানে গিয়ে যে কাউকে জিজ্ঞেস করে আপনি চলে যাবেন জাগছড়ার ১৪নং সেকশনে। সেখানে চোখে পড়বে একটি ব্রিজ। ব্রিজের ডান পাশ দিয়ে ছড়ার পাড় ধরে একটু সামনে এগিয়ে গেলেই শুনতে পাবেন শাঁ শাঁ শব্দ। নেমে পড়বেন পাহাড়ি ছড়ায় দেখবেন কোনো জাদুকর মাটিতে অপরূপ কারুকাজ করে পানিপ্রবাহের পথ করে দিয়েছে। আমরা চারদিকের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। এবার বাড়ি ফেরার জন্য রওনা দেওয়ার পালা। তবে কিছু সময়ের জন্য মনে হচ্ছিল আরও কিছু সময় যদি সেখানে আড্ডা দেওয়া যায়। কি সুন্দর সব কিছু! কিন্তু জীবনের তাগিদে ফিরে আসতে তো হবে। এরপর বাইক করে ফিরলাম প্রিয় শহরের উদ্দেশ্যে।
পরিশেষে বলতে চাই, প্রকৃতির পরম মমতায় গড়া এ অঞ্চলের সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। সবুজের মধ্যে হারিয়ে যেতে এরচেয়ে ভালো পছন্দ হতে পারে না। এখানে সংস্কৃতির বিচিত্রতা দেখা ছাড়াও এ অঞ্চলের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য দর্শনীয় স্থান ভ্রমণপিপাসুদের তৃষ্ণা মেটাবে।