রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

প্রকৃতির স্বর্গরাজ্য সিলেট ভ্রমণের অভিজ্ঞতা

আহসান হাবীব রানা
  ১১ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০

পাহাড়, ঝরনা আর সবুজের প্রাচুর্যে ভরা সিলেটে ছড়িয়ে আছে দৃষ্টিনন্দন সব পর্যটনকেন্দ্র। সবুজে মোড়া পাহাড়ের কোলঘেঁষা পাথুরে নদী, বন, ঝরনা, চা-বাগান কী নেই এখানে! সিলেটের বৈচিত্র্যে ভরা সৌন্দর্য দেখতে ছুটে আসেন পর্যটক আর ভ্রমণপ্রিয় মানুষ। সিলেটের অপরূপ সৌন্দর্য অবলোকন ও সিলেটের ঐতিহ্য সম্পর্কে জ্ঞান অন্বেষণ করে নিজেদের জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের দিনগুলোকে রাঙিয়ে জীবনের ক্যানভাসে বেঁধে রাখতে সম্প্রতি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকসাহিত্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা সিলেট ভ্রমণ করে আসি।

আমাদের বিভাগের প্রত্যেক বছরের শেষ সেমিস্টারে একটা কোর্স থাকে ফিল্ডওয়ার্ক বা ক্ষেত্রসমীক্ষা নামে। যেই কোর্সের অধিনে আমরা নির্দিষ্ট কোনো জেলায় গিয়ে থাকি ওই এলাকার লোকজ জীবন ও স্থানীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে। লোকসাহিত্যের শিক্ষার্থী হিসেবে ক্ষেত্রসমীক্ষার মাধ্যমে আমরা প্রত্যেক বছর দেশের নির্দিষ্ট একটা জেলার মানুষের ঐতিহ্য, জীবনযাত্রা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে হাতেকলমে বিশদ জ্ঞান অন্বেষণের চেষ্টা করি ও দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে আসি।

প্রথম বর্ষে পঞ্চগড়, দ্বিতীয় বর্ষে কক্সবাজার এবং তৃতীয় বর্ষের ক্ষেত্রসমীক্ষার স্থান নির্বাচনের সময় এবার আমাদের কোর্স শিক্ষকসহ সবাই মিলে পরিকল্পনা করি পাহাড়, ঝরনা ও সবুজের লীলাভূমি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রাচুর্যে ভরা ও পুণ্যভূমি সিলেটে ক্ষেত্রসমীক্ষায় যাব। যে সিদ্ধান্ত সে কাজ, পরিকল্পনা অনুযায়ী বিভাগের সভাপতি ড. শিবলী চৌধুরী স্যার সবার জন্য নির্দিষ্ট একটা চাঁদা ঠিক করে দিলেন এবং তারিখ ঠিক করলেন যে, পূজার ছুটিতে আমরা বের হবো।

তারপর সবার অপেক্ষার পালার যেন শেষ হচ্ছে না। কবে আসবে পূজার ছুটি, আর আমরা কবে বের হবো স্বপ্নের শহরের উদ্দেশে। একে একে দিন গুনতে লাগল সবাই। অবশেষে এলো সে সুদিন। ক্যাম্পাস পূজার ছুটিতে বন্ধ দিল। কিন্তু বাদ সাধল আমাদের হিন্দু ধর্মাবলম্বী বন্ধুরা। তাদের ধর্মের সবচেয়ে বড় পূজা। পূজা মিস করে টু্যরে যাওয়া যাবে না। তাই সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, তাদের পূজা শেষ হলেই তবে আমরা বের হবো। ২৪ তারিখেই ওদের দশমী শেষ। তাই আমরা তারিখ ঠিক করলাম অক্টোবরের ২৫ তারিখ।

অবশেষে আমাদের অপেক্ষার পালা শেষ হলো। ২৫ তারিখ দুপুর ২টার সময় ক্যাম্পাস থেকে বাস ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীসহ প্রায় ১৩০ জন মিলে তিনটি বাস নিয়ে ঠিক সময়েই রওনা হই গন্তব্যের উদ্দেশে। আমাদের রাতের খাবারের জন্য স্থান নির্বাচন করা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার ঐতিহ্যবাহী নুরজাহান হোটেলে। রাত ৮টা ৩০ মিনিটে আমরা জাবিতে পৌঁছাই এবং এক ঘণ্টার মধ্যে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ৯টা ৩০ মিনিটে আমরা জাবি থেকে গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হই।

তারপর ঢাকা, নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে আমরা সিলেট বিভাগে প্রবেশ করি। সিলেট বিভাগে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল রাস্তার দু'পাশে উঁচু-নিচু টিলা, রাশি রাশি বাঁশবাগান ও কাঁঠাল বাগানের নয়নাভিরাম দৃশ্য। সবচেয়ে মন কাড়া রূপ দেখা যায় শ্রীমঙ্গলের চা বাগান ও সারি সারি লেবুর বাগান।

২৬ তারিখ সকাল ৯টার দিকে আমরা আগে থেকে বুকিং দিয়ে রাখা হোটেল সিটি লিংকে চেক ইন করি। কিন্তু বাদ সাধে হোটেলের নোংরা পরিবেশ ও নিম্নমানের ব্যবস্থা। অনলাইনে হোটেলের ছবির সঙ্গে বাস্তবে কোনো মিল নেই। যেখানের পরিবেশে ঠিকা অসম্ভব প্রায়। তাই আমাদের শিক্ষকরা ঠিক করলেন অন্য হোটেলে উঠবেন। কিন্তু হোটেল মালিক চুক্তি অনুযায়ী আমাদের বের হতে বাধা দেন। অবশেষে অনেক বাক-বিতন্ডার পরে আমরা হোটেল থেকে বের হয়ে এসে আল-আছমা নামের একটা মোটামুটি ভালো মানের হোটেলে চেক-ইন করি।

তারপর সবাই ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা বেলা ২টার দিকে রওনা হই সিলেট শহর থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে প্রায় ৬২ কিলোমিটার দূরবর্তী প্রকৃতিকন্যার দেশ জাফলংয়ের উদ্দেশে। সারাক্ষণ গাড়িতে গান, আড্ডা আর খুনসুটিতে সময় কাটে সবার। চারদিকে সবুজ শ্যামল সমতল ভূমি ও পাহাড়বেষ্টিত দৃষ্টিনন্দন জায়গা দেখতে দেখতে প্রায় দুই ঘণ্টা ভ্রমণ করার পর অবশেষে আমরা পৌঁছে যাই নির্ধারিত জায়গায়।

গাড়ি থেকে নেমেই সবার মনে কি যে আনন্দ! প্রকৃতিকন্যার অপূর্ব চেহারা সবাইকে মনোমুগ্ধকর করে তুলে। দেরি না করে সবাই মিলে প্রথমে আমরা গ্রম্নপ ছবি তুলি। পরে যাত্রা শুরু করি সোজা ভারতের সীমান্তে অবস্থিত পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ হিমেল পানির দিকে। এদিকে পিয়াইন নদীর তীরে স্তরে স্তরে বিছানো পাথরের স্তূপ জাফলংকে করেছে আকর্ষণীয়। সেই সঙ্গে আকর্ষণীয় করে তুলেছে আমাদের ভ্রমণ পিপাসু হৃদয়কেও। খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে স্তরে স্তরে সাজানো সবুজ গাছপালা, ঝুলন্ত ডাউকি ব্রিজ এবং ডাউকি পাহাড়ের পাদদেশ থেকে অবিরাম প্রবহমান জলপ্রপাত দেখলেই মন ভরে যায়। এক এক করে নৌকাযোগে সব জায়গা ঘুরে দেখি আমরা। হাসি-আনন্দে সারাক্ষণ অতিবাহিত হয় আমাদের। ভ্রমণকে স্মরণীয় করে রাখতে তোলা হয় নানা ভঙ্গিমায় স্থিরচিত্র। দেখতে দেখতে সময় গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায়। এবার হোটেলে ফেরার পালা। জাফলং থেকে হোটেলে ফেরার সময় পথিমধ্যে তামাবিল স্থলবন্দরে যাত্রাবিরতি দিয়ে কিছুক্ষণ ঘুরেফিরে দেখি। এরপর ক্লান্ত শরীরে রাত ১০টার দিকে হোটেলে ফেরা।

হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে একটু বিশ্রাম নিয়ে রাত ১১টার দিকে বের হই শাহজালালের মাজারের উদ্দেশে। হোটেল থেকে রিকশাযোগে ২০ মিনিটের মধ্যে আমরা মাজারের প্রধান ফটকে পৌঁছে যাই। এরপর মাজারে প্রবেশ করে মুগ্ধ হয়ে যাই। ব্যাপক মানুষের কোলাহল। আর ভাগ্যক্রমে ওইদিন বৃহস্পতিবার মাজারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। ব্যাপক মানুষের উপস্থিতিতে মাজারে কোলাহল পূর্ণ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। চারদিকে সাজ সাজ রব। চারদিকে ধর্মভীরু মানুষের উপস্থিতি ও জিকির-ফিকির। তারপর মাজার দর্শন শেষে হোটেলে ফিরে আসি। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যাই, কারণ পরের দিন খুব ভোরে আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশে বের হতে হবে।

২৭ তারিখ সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সাদা পাথরের উদ্দেশে বের হই। আঁকাবাঁকা রাস্তার মধ্য দিয়ে আমাদের বহনকারী বাস চলছে ভোলাগঞ্জের উদ্দেশে। বাসের ভেতরে চলছে সে কি গান! গানের সঙ্গে সবার নাচের দৃশ্য ভ্রমণের আনন্দে যুক্ত করেছে বাড়তি মাত্রা।

ভোলাগঞ্জ পৌঁছে সবাই নিজেকে প্রস্তুত করল; সাদা পাথরের রাজ্যে হারিয়ে যেতে। আমাদের শিক্ষকরা নৌকা ভাড়া করে সবাইকে নিয়ে চললেন একসঙ্গে। চারপাশে সবুজ পাহাড়ে ঘেরা এলাকাজুড়ে অজস্র সাদাপাথর। চিকচিকে রুপালি বালু আর ছোট-বড় সাদা অসংখ্য পাথর মিলে এ যেন এক পাথরের রাজ্য। সিলেট শহর থেকে এর দূরত্ব মাত্র ৩৩ কিলোমিটার। ধলাই নদীর সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে ছোট-বড় সাদা রঙের পাথরগুলো। নৌকায় ধলাই নদী পেরিয়ে এসে গেলাম একেবারে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে।

চারদিকে শুধু সাদা রঙা পাথর আর পাথর। নির্জন নৈসর্গিক এই জায়গাটিতে সামনে সবুজ পাহাড়ের সারি, স্রোতকে সঙ্গী করে পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ছে শীতল জল। এই জলে নিজেদের সব ক্লান্তি-অবসাদ নিমিষেই দূর করতে সবার মন উতলা হয়ে গেল। স্রোতের প্রতাপে নির্মল পানি ও সাদা পাথরের জাদুকরী শীতল স্পর্শে শরীর ও মন উভয়ই জুড়িয়ে যায়। এই সুন্দর মুহূর্তগুলো ক্যামেরায় তুলে নিয়ে সবার হৃদয় পটে অঙ্কিত হয় এক টুকরো স্মৃতি আর সঙ্গে অনুভূত হয় এক আকাশ সুখ।

সাদা পাথরের গোসল শেষে সবাই মিলে আবার নৌকাযোগে বাসের কাছে ফিরি এবং সেখানেই দুপুরের খাবার শেষ করি। দুপুরের খাবার শেষ করতে আমাদের বেশ দেরি হয়ে যায়। খাবার শেষ করে ৩.৩০ এর দিকে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য বিছানাকান্দির উদ্দেশে রওনা হয়ে যাই। দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের দুই ঘণ্টার বাস জার্নি শেষে বিছানাকান্দি পৌঁছাতে ৫টা ৩০ মিনিট বেজে যায়। কিন্তু ৫টার মধ্যে বিছানাকান্দির সব স্পট বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের হতাশ হয়ে ফিরতে হয়। এত আনন্দের মধ্যে এইটুকু ছিল আমাদের নিরাশার জায়গা। তারপর মন খারাপ করে বিছানাকান্দি থেকে ফিরে আসি হোটেলের উদ্দেশে। হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে আমদের রাতের খাবার খাওয়ার সিদ্ধান্ত হয় সিলেটের নামকরা পানসি রেস্টুরেন্টে। সিলেটে যাওয়ার পূর্বে এ হোটেলের ব্যাপক সুনাম শুনেছি। কিন্তু যতটুকু প্রত্যাশা ছিল এই হোটেলের খাবারের ব্যাপারে, তা ঠিক আশানুরূপ ছিল না। রাতের খাবার খেয়ে ক্লান্ত শরীরে হোটেলে এসে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাই। কারণ কালই আমাদের শেষ দিন। সকালে বেরুতে হবে। কয়েকটা স্পট কাভার দিতে হবে।

সকালে ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরিই হয়ে গেল। তারপর ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে বের হলাম। পরবর্তী গন্তব্য শাবিপ্রবি হয়ে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ও শ্রীমঙ্গল। তিনটি গাড়ি একসঙ্গে ছেড়ে গেল শাবিপ্রবির উদ্দেশে। শাবিপ্রবি বেশ সুন্দর ক্যাম্পাস। শাবিপ্রবিতে এক ঘণ্টার মতো সময় কাটিয়ে বের হয়ে পড়লাম আমাদের মূল গন্তব্য লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ও শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশে। শ্রীমঙ্গলের পথে সারি সারি সজ্জিত রাবার গাছ দেখতে দেখতে গাছপালায় ছেয়ে যাওয়া নিঝুম মনোরম বনের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া সড়ক দিয়ে পৌঁছে যাই দেশের সর্ববৃহৎ জাতীয় উদ্যান লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে। বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য হিসেবে বেশ বিখ্যাত এই উদ্যান। মৌলভীবাজারে আসা পর্যটকদের পছন্দের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে এটি। আফ্রিকান টিকওকসহ বিরল প্রজাতির অসংখ্য গাছ, সরীসৃপ ও নানা জাতের অসংখ্য প্রাণী রয়েছে এই উদ্যানে। দেখা মিলে বিরল প্রজাতির অসংখ্য গাছ ও লজ্জাবতী বানরের।

সময়ক্ষেপণ না করে রওনা হই পরবর্তী স্পট শ্রীমঙ্গল চা বাগানে। যদিও পথিমধ্যে অসংখ্য চা বাগান দেখেছিলাম। চলতে চলতে পথে দেখা হয়ে গেল দেশের অন্যতম তারকা হোটেল ও রিসোর্ট গ্রান্ড সুলতান হোটেল ও টি রিসোর্ট। চা বাগানের মধ্য দিয়ে চলতে চলতে এক জায়গায় গাড়ি থামানো হয়। সবাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে যায় ফটোশুট করতে। চা বাগানের সৌন্দর্যটাই এই রকম যে, কেউ সুযোগ পেলে ছবি তুলবেই। সুনিপুণ কারিগর মহান মালিক আলস্নাহতায়ালার সৃষ্টির অপার সৌন্দর্য ফুটে ওঠে এই চা বাগানে। ভ্রমণের অধিকাংশ সময় সর্বাধিক আকর্ষণীয় ছিল রাস্তার দু'পাশের এই চা বাগানগুলো।

অবশেষে গোধূলি লগ্নে ভ্রমণের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে শুরু হয় ফেরার যাত্রা। চায়ের রাজ্যে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা অঙ্কিত থাকবে জীবনের সেরা অভিজ্ঞতাগুলোর তালিকায়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে