শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
গল্প

একরোখা ভূতছানা

মাহমুদুল হাসান মুন্না
  ১২ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। ভূত মশাই আস্তানা থেকে বাইরে যেতে পারেনি। ভূতের গিন্নি খিচুড়ি রান্না করেছিল। কিন্তু ভূতের ছানা কিছুতেই খিচুড়ি খাবে না। সন্ধ্যা থেকেই গরম গরম জিলাপি খাওয়ার জন্য বায়না ধরেছে। বাইরে তুমুল বৃষ্টি, ঝড়ো বাতাস, ক্ষণে ক্ষণে বাজ পড়ছে। ভূত মশাই ভয় পেয়ে ঘরে বসে আছে। পুরনো একটি ভাঙা বাড়ি দখল করে সেখানে ভূত পরিবার থাকে। বাড়িটি হাটবাজার থেকে অনেক দূরে।

এদিকে, মানুষের তেমন যাতায়াত নেই। দিনের বেলায় মাঠে কাজ করতে কৃষকরা আসে। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই বাড়ি ফিরে যায়। এখন যদি কেউ এ পথে জিলাপি নিয়ে আসত, তাহলে ভয় দেখিয়ে ছিনিয়ে নেয়া যেত। সারা রাতেও এ পথে কোনো মানুষ আসবে না। ভূত মশাই বলল, আজকে খিচুড়ি খেয়ে নে বাপ। আগামীকাল গরম গরম জিলাপি এনে দেব। তখন পেট ভরে জিলাপি খাস। ভূতের ছানা কারও কথা শুনছে না। মুখ বেজার করে বসে আছে। সে খিচুড়ি খাবেই না। তখন ভূতের গিন্নি বলল, সোনা ছেলে আমার, মুখ গোমড়া করে থাকিস না, মা পিঠা বানিয়ে দেব, কী পিঠা খাবি বল? ভূতের ছানা বলল, আমি পিঠা ও খিচুড়ির কিছুই খাব না। আমাকে জিলাপি এনে দাও। ভূতের ছানাকে নিয়ে ভূত মশাই ও গিন্নি পড়েছে মহাবিপদে। এমন একরোখা ছেলে বাপের জন্মেও দেখেনি। একদম নাছোড়বান্দা।

মধ্যরাতে বৃষ্টি থেমেছে। ভূত মশাই ও গিন্নি ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু ভূতের ছানা তখনও সজাগ। সন্ধ্যা থেকেই পেটে কিছু পড়েনি। তাই ঘুমও আসছে না। বাবা-মায়ের ওপর খুব অভিমান হলো। তার শখ-আহ্লাদের কোনো গুরুত্ব নেই। সে এই বাড়িতে আর থাকবে না। বাবা-মায়ের সঙ্গে আড়ি দিয়ে চুপিসারে বেরিয়ে পড়ল। ঘুটঘুটে অন্ধকার, পিচ্ছিল পথ। একটু এগুতেই ভূতের ছানা আছাড় খেল। উঠে আবার চলতে শুরু করল। পথঘাট সব অচেনা। এখন কোথায় যাবে, কীভাবে যাবে? অন্ধকারে চলতে চলতে মাঠ পেরিয়ে নির্জন বনে পৌঁছে গেল। এতটা পথ হেঁটে শরীর খুব ক্লান্ত। খিদায় পেট মোচড়াচ্ছে। একটু জিরিয়ে নেয়া দরকার। বৃষ্টিতে সব জায়গা ভেজা। রাত কাটানোর জন্য ভালো জায়গা খুঁজতে হবে। কিছুটা যাওয়ার পর মিটিমিটি আলো দেখতে পেল। বনের মধ্যে ছোট্ট একটা ঘর। বারান্দায় মধ্যবয়স্ক এক লোক বসা। ভূতের ছানা পা টিপে টিপে ঘরটির কাছে গেল। ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে বারান্দায় চোখ রাখল। লোকটি দেখতে ভূতের চেয়েও ভুতুড়ে, কিন্তু ভূত নয়। ভূতের ছানা দেখল লোকটি বিড়বিড় করছে, কী বলছে তা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে না। এ লোক আসলে কে? আজকের রাতটা কি এই ঘরে কাটানো যাবে? চুপিসারে ঘরে ঢুকে লুকিয়ে পড়বে না কি? এসব ভাবতে ভাবতে বারান্দার মেঝেতে চোখ পড়ল। এতক্ষণে খেয়াল করল মেঝেতে অনেকগুলো কাচের বোতল সাজিয়ে রাখা। স্বচ্ছ বোতলের ভেতরে আবছায়া দেখতে পেল। ছায়াগুলো যেন বোতল থেকে বের হতে চেষ্টা করছে। এরা কারা? তখন ভূতের ছানার মায়ের কথা মনে পড়ল। তার মা তাকে তান্ত্রিকের কথা বলেছিল। তান্ত্রিকরা ভূতদের বশীভূত করে ফেলে। বোতলে বন্দি করে রেখে দেয়। তার দাদুকেও কোনো এক তান্ত্রিক বন্দি করে রেখেছে। ভূতের ছানার সমস্ত শরীর শিহরে উঠল। তাহলে এই লোক তান্ত্রিক! এখনই এখান থেকে পালাতে হবে। ভূতের ছানা প্রাণপণে দৌড় দিল। কোন দিকে যাচ্ছে তার ঠিক নেই। বাঁচতে হলে পালাতে হবে। ভূতের ছানা ছুটছে তো ছুটছেই। হঠাৎ একটা গাছের সঙ্গে সজোরে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল। ক্লান্তি, আতঙ্ক আর আঘাতের চোটে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।

ওই দিকে ভূতের গিন্নির ঘুম ভেঙে গেল। ঘরের দরজা খোলা। ঘুমানোর আগে তো ভেতর থেকে খিল দিয়েছিল। বাতাসেও দরজা খুলে যাওয়ার কথা নয়। তবে কি ছেলেটি দরজা খুলে রেখেছে? ঘরের ভেতরে ছেলের দেখা মিলল না। ছেলেটি এত রাতে ঘর থেকে বের হলো কেন? একা একা কই গেল আবার। ভূতের গিন্নি ঘরের বাইরে এসে ছেলেকে খুঁজতে লাগল। সারাবাড়ি খুঁজেও তার দেখা পেল না। তড়িঘড়ি করে ঘরে গিয়ে ভূত মশাইকে জাগিয়ে তুলল। দু'জনের মনেই শঙ্কা দেখা দিল। ছেলেটি কোনো বিপদে পড়েনি তো! তারা ছেলেকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়ল। ভূতের গিন্নি বলল, আমার খুব ভয় হচ্ছে। ও কখনোই বাড়ির বাইরে যায়নি। এই মাঝ রাত্রিতে কোথায় গেল? কোনো তান্ত্রিক ধরে নিয়ে যায়নি তো? ভূত মশাই বললেন, অশুভ কথা বলো না তো। আমাদের ছেলের কিছুই হবে না। বৃষ্টির কারণে পথঘাট ভেজা ছিল। ভূতের ছানার পায়ের ছাপ মাটিতে পড়ে আছে। ভূত মশাই গিন্নিকে বলল, এই দেখ তোমার ছেলের পায়ের ছাপ। মাঠের দিকেই গেছে। দ্বিতীয় কারো পায়ের ছাপ নেই। কেউ তাকে ধরে নিয়ে যায়নি। মিছামিছি ভয় পেয়ো না। চল মাঠের দিকে যাই। তারা খুঁজতে খুঁজতে মাঠে চলে গেল। সেখানেও কেউ নেই। পায়ের ছাপ ধরে চলতে চলতে মাঠ পেরিয়ে জঙ্গলে পৌঁছাল। এক সময় তান্ত্রিকের ঘর দেখতে পেল। ভূতছানার মা বিলাপ করতে করতে কান্না জুড়ে দিল। আমাদের ছেলেকে তান্ত্রিক বন্দি করে ফেলেছে গো। ও কে আর ফিরে পাব না। ভূত মশাই ধমক দিয়ে বলল, চুপ কর। আগে বুঝতে দাও কী ঘটেছিল। তারা বারান্দার পাশের ঝোঁপ পর্যন্ত চলে এলো। এখানেই পায়ের ছাপ শেষ। ভূত মশাই চারপাশে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। সেখান থেকে উল্টো দিকেই একজনের পায়ের ছাপ চলে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে কেউ দৌড়ে পালিয়েছে। ভূত মশাই গিন্নিকে বলল, তোমার ছেলে তান্ত্রিককে দেখে ভয় পেয়ে এদিকে ছুটে পালিয়েছে। ভূতছানার মা কাঁদতে থাকল, না জানি ছেলেটার কী হয়েছে? অবশেষে তারা ছেলেকে অজ্ঞান অবস্থায় খুঁজে পেল।

পরদিন দুপুরে ভূতের ছানার জ্ঞান ফিরল। বাবা-মাকে পাশে দেখতে পেয়ে কাঁদতে শুরু করল। ভূত মশাই ও গিন্নি তাকে কোথায়, কীভাবে খুঁজে পেল তা বলল। ভূতের গিন্নি ছেলেকে বলল, সেখানে কেন গিয়েছিলি বাপ? ভূতের ছানা কাঁদতে কাঁদতে সব বলল। ভূত মশাই ছেলেকে বোঝাল। তার জেদের কারণে কত বড় বিপদে পড়তে যাচ্ছিল। আর কখনোই যেন এমন না করে। ভূতের ছানা বলল, আর কখনোই জেদ করব না। তোমাদের সব কথা মেনে চলব। ভূতের ছানা তার ভুল বুঝতে পারল। বাবা-মা তাকে কতই না ভালোবাসে। সেই রাতে ভূত মশাই ছেলের জন্য গরম গরম জিলাপি এনে দিল।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে