মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

দাদুর গল্পের আসর

মিলাদ হোসেন সুজন
  ০২ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০

মহান স্বাধীনতা দিবস। স্কুল, কলেজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আলোকসজ্জায় সজ্জিত। নিতুই, রুপা, উজ্জ্বলরা মিলে প্রস্তুতি নিচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের ছবি আকার এবং মহান স্বাধীনতা দিবসে বক্তৃতা দেওয়ার। স্কুল থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে বাছাইকৃত সেরা ছবিগুলোকে পুরস্কৃত করা হবে এবং স্কুলের দেয়ালিকায় প্রদর্শন করা হবে? আর সেরা বক্তৃতায় যারা থাকবে তাদেরও পুরস্কৃত করা হবে। নিতুইরা যৌথভাবে ছবি আকার পরিকল্পনা নিচ্ছে। আর নিতুই একাই বক্তৃতার প্রস্তুতি নিচ্ছে। উজ্জ্বল আর রুপা বিভিন্ন বই ঘাটাঘাটি করে মুক্তিযুদ্ধের ছবি বের করছে। কিন্তু কোনো ছবিই নিতুইয়ের মনে ধরছে না।

নিতুই আরো ভালো ছবির তালাশ করছে? নিতুই পঞ্চম শ্রেণির একজন ছাত্রী। অত্যন্ত মেধাবী হওয়ায় সবাই নিতুইকে স্নেহ করতে ভুলে না? ক্লাসে সবকিছুতেই সবাইকে ছাড়িয়ে যায় নিতুই? রুপা আর উজ্জ্বল তারা চাচাতো ভাইবোন। রুপা চতুর্থ শ্রেণি এবং উজ্জ্ব্বল তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে? তারাও কোনো অংশে কম না? নিজেদের সেরা প্রমাণ করতে তারা সব সময়ই চেষ্টা চালিয়ে যায়।

নিতুই রং পেন্সিল গুছিয়ে নিচ্ছে, ওইদিকে উজ্জ্বল আর রুপা ছবি খুঁজতে খুঁজতে ব্যর্থ। একটা ছবিই নিতুইয়ের মনে ধরেনি। এবার নিতুই সিদ্ধান্ত নিয়েছে না দেখেই ছবি আঁকবে। সে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বিষয়ক অনেক বই ইতোমধ্যে পড়ে শেষ করেছে? তার চোখের সামনে সবকিছু স্পষ্ট। আরো ভালো ধারণা পেতে নিতুই সিদ্ধান্ত নিল খোঁড়া দাদুর কাছে যাবে। মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বীর মুক্তিযোদ্ধা ছোটরা ভালোবেসে খোঁড়া দাদু বলে ডাকে। বয়সের চাপে নুয়ে পড়া আব্দুল মান্নান সাহেব স্ব-চোখে মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন। স্বাধীনতা দেখেছেন। নিজ হাতে রাইফেল চালিয়ে দেশকে রক্ষা করেছেন হানাদার বাহিনী থেকে?

নিতুইয়ের কথায় উজ্জ্বল আর রুপাও সায় দিল। পাশের বাড়িটাই খোঁড়া দাদুর? ছেলেরা পড়াশোনা করার জন্য বিদেশে গেছে। আর কারো খবর নেই?

একটা মেয়ে নিয়েই খোঁড়া দাদু বিশাল বাড়িতে থাকেন।

একটা নাতনি আছে প্রীতি নামের। সে নিতুইয়ের সবচে কাছের বন্ধু। মাঝেমধ্যে নিতুই আর প্রীতি মিলে দাদুর কাছে গল্প শুনে? আজও মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে খোঁড়া দাদুর কাছে যাবে? রুপা আর উজ্জ্বলকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল নিতুই? খোঁড়া দাদুর প্রধান ফটকে বেল বাজাতেই একজন এসে খুলে দিল গেট। নিতুইরা সোজা গিয়ে ঢুকলো প্রীতিদের রুমে। প্রীতি সবাইকে একসঙ্গে দেখে ভীষণ খুশি হলো। জানতে চাইল আজকে সবার একসঙ্গে আসার কারণ কি, নিতুই সবকিছু খুলে বলল।

বাইরে রিমঝিম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। খোঁড়া দাদু জোহরের নামাজ শেষ করেছেন। প্রীতি রান্নাঘর থেকে রং চা নিয়ে খোঁড়া দাদুর রুমে ঢুকল। আর বলল নিতুই, রুপা, উজ্জ্বলরা এসেছে দেখা করতে। খোঁড়া দাদু বুঝতে পারলেন তারা গল্পের আসর জমাতে চায়। দাদুও পাক্কা ওস্তাদ, গল্প জমাতে প্রীতিকে বললেন রান্নাঘর থেকে মুড়ি ভাজা নিয়ে আসতে। রিমিঝিম মেঘলা দিনে গল্পের সঙ্গে মুড়িভাজা বেশ মানাবে? প্রীতিও কথামতো মুড়ি ভাজা নিয়ে হাজির হলো। দাদু লাটি হাতে নিয়ে এগিয়ে আসলেন বারান্দায়? নিতুই, রুপা, উজ্জ্বলরা আগে থেকেই বসে ছিল।

খোঁড়া দাদু এসে খসখসে হাতে একে একে সবার গাল টেনে আদর করে নিলেন। আর জানতে চাইলেন কেমন গল্প শুনতে চাও। সবাই একসুরে বলে উঠলো মুক্তিযুদ্ধের গল্প? দাদু বললেন ঠিক আছে।

একদিন ঘুটঘুটে অন্ধকারে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প দখলমুক্ত করার? গোপন তথ্যের ভিত্তিতে জানতে পারলাম ওই ক্যাম্পে ৬০ জন হানাদার অবস্থান করছে যার তুলনায় আমরা মাত্র ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা? সরাসরি যুদ্ধে নামলে আমাদের সবাইকে তাদের হাতে মরতে হবে? কোনো উপায় পাচ্ছিলাম না? এতটুকু বলে খোঁড়া দাদু মুড়ির টবে হাত দিয়ে এক মুঠো মুড়ি নিলেন? ওইদিকে উৎসুক হয়ে কান খাঁড়া করে খুব মনোযোগে শ্রবণ করছে সবাই?

নিতুই বলে উঠলো তারপর.....!

খোঁড়া দাদু মুড়ি চিবাতে চিবাতে বললেন, তারপর আমাদের ১০ জনের দল থেকে একজনকে পাঠালাম তাদের ক্যাম্প থেকে খবর নিয়ে আসতে, রুপা প্রশ্ন করে বসল কি খবর আনতে?

দাদু বললেন, হানাদাররা কখন কি করে সেই খবর। সেই খবর আনতে পাঠানো হয় আমার বাল্যবন্ধু রফিক উলস্নাহকে। ইতোমধ্যেই দাদুর চোখ অশ্রম্নসিক্ত হয়ে আসছে? ঠোঁট কাঁপছে, ঠোঁট কাঁপতে কাঁপতে বলে যাচ্ছেন? রফিক উলস্নাহ খবর আনতে ভুল রাস্তা দিয়ে যাওয়ার ফলে তাকে হানাদাররা ধরে ফেলে।

তারপর রফিক উলস্নাহর ওপর চালানো হয় অমানবিক নির্যাতন। বাকিদের অবস্থান জানতে চাওয়া হয় তার কাছে। কিন্তু সাহসী রফিক তার জীবন দিয়ে দিতে রাজি তবুও কারো নাম বলেনি? তিলে তিলে হত্যা করা হয় আমার বাল্যবন্ধু বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিক উলস্নাহকে। বলতে বলতে অশ্রম্নতে ভিজে গেছে খোঁড়া দাদুর পাঞ্জাবি। নিতুই, প্রীতি, রুপা, উজ্জ্বলের চোখেও টলমল করছে জলের চাক।

খোঁড়া দাদু চোখ মুছতে মুছতে তাদের জিজ্ঞেস করলেন এতটুকু গল্প থেকে কি শিখতে পারলে?- নিতুই হাত তুললো বলার জন্য। দাদু অনুমতি দিলেন? নিতুই বলতে থাকল- বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিক উলস্নাহ নিজেকে শেষ করে দিয়েছেন কিন্তু কারো কথা বলেননি। এতে নিজেদের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে? দেশের প্রতি উনার আঘাত ভালোবাসার প্রমান পাওয়া যায়।

খোঁড়া দাদু মুচকি হেঁসে নিতুইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আর বললেন, অনেক বড় হও? উজ্জ্বল তেমন কিছু বুঝে উঠতে পারছে না? তবুও মনোযোগসহ শ্রবণ করে যাচ্ছে। প্রীতি বলে উঠল দাদু তোমার রাইফেলের গল্প বলো। দাদু শুরু করলেন.....

আমার রাইফেলটা ছিল সবার রাইফেল থেকে আলাদা। উজ্জ্বল এবার প্রশ্ন করে বসল- দাদু রাইফেল কি? দাদু বললেন, রাইফেল হলো বন্দুক যেটা দিয়ে গুলি করে? উজ্জ্বল বুঝতে পারল। দাদুও গল্প আগিয়ে নিলেন? আমার রাইফেলটি ছিল মুক্তিবাহিনীর প্রধানের দেওয়া। তিনি আমার সাহস দেখে নিজের হাতের রাইফেলটি আমাকে দিয়েছিলেন। আর এই রাইফেল দিয়েই আমি যুদ্ধ করেছি।

নিতুইরা অনেক সময় গল্প শুনলো। দাদুর সঙ্গে অশ্রম্নও ঝরাল। হৃদয়ে মুক্তিযুদ্ধের কথাগুলো গেঁথে গিয়েছে সবার। উজ্জ্বলও বলে উঠেছে আমিও যদি যুদ্ধ করতে পারতাম,তাহলে অনেক হানাদারকে গুলি করতাম। খোঁড়া দাদু উজ্জ্বলকে জড়িয়ে আদর করলেন আর বললেন, এই সমাজকে সত্যের পথে চালিত করতে হবে তোমাদের। এটাই তোমাদের যুদ্ধ। সমাজের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে লড়তে হবে সেটাই তোমাদের যুদ্ধ। অনেক অনেক বড় হও, বলে খোঁড়া দাদু গল্পের আসর ত্যাগ করলেন।

নিতুইও মুক্তিযুদ্ধের সব কথামালা হৃদয়ে গেঁথে নিল। রাতে সবাইকে নিয়ে একটা বড় আর্ট পেপারে মুক্তিযুদ্ধের ছবি অঙ্কন করল যেখানে দেখা গেল হাতবাঁধা একজন লোককে একদল হানাদার নির্যাতন করছে। নিচে বড় বড় অক্ষরে লিখলো বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিক উলস্নাহের সঙ্গে ঘটা অমানবিক নির্যাতন।

আর বক্তৃতায় তো স্কুলের সবার চোখে অশ্রম্ন ঝরিয়েই ছাড়ল। নিতুইয়ের বক্তৃতা শুনে সবাই অবাক হলেন। নিতুইয়ের আর্ট করা ছবি এবং বক্তৃতা দুটোই সেরাদের সেরা হলো? সবাই করতালির মাধ্যমে নিতুইদের অভিনন্দন জানালেন? সবশেষে 'স্বাধীনতায় খোঁড়া দাদু' শিরোনামে নিতুইয়ে বক্তৃতা সবার হৃদয়ে জায়গা করে নিল।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে