শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
গল্প

জলপরীর দেশে

মো. আশতাব হোসেন
  ২৮ মে ২০২৩, ০০:০০

চরকুন নামের এক জেলে তার পরিবার নিয়ে বাস করত দুধকুমার নামে এক নদীর তীরে। তার বাড়ির পাশেই ছিল এক বটগাছ। বটগাছের পাশে এক নদী। রাত গভীর হলেই নদী থেকে একঝাঁক জলপরী উঠে এসে বটগাছের শাখায় শাখায় বসে গল্পগুজব, নাচ-গান করত। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বাপ দাদার চৌদ্দ পুরুষদের বীরত্বগাথার গল্প করত। অন্ধকার রাত হলেও পরীদের সমস্যা হতো না, কারণ তাদের শরীর থেকে এক ধরনের সাদা আলো নিঃসৃত হতো যা কিনা তাদের জন্য বিদু্যৎ বাতির মতো কাজ করত। হরকুন তার ছেলেমেয়ে নিয়ে রাতে যখন ঘুমিয়ে পড়ত তখনই জলপরীরা বটগাছের উপরে আসর বসাত। হরকুনের বড় ছেলে চরকুন সে একটু দুরন্ত প্রকৃতির। কোথাও যাত্রাপালা বা অন্য কোনো গানের শব্দ পেলেই সে চুপে চুপে ঘর থেকে বেরিয়ে সেখানে চলে যেত। জলপরীদের আসর বসত বটগাছের উপরে আর সেখান থেকেই মাঝেমধ্যে চরকুনের কানে ভেসে আসতো গান ও নাচের শব্দ কিন্তু চরকুন বুঝতে পারত না কোন দিক থেকে এমন প্রাণ কাড়া নাচ-গানের শব্দ আসে।

প্রত্যেক রাতে এমন শব্দ শুনে চরকুনের ঘুম হারাম হয়ে যেত। সে রাতে উঠে বাহিরে বিভিন্ন দিকে কান পেতে বুঝার চেষ্টা করতে থাকে। এক রাতে সে শব্দ শুনে শুনে পথ চলতে থাকে হঠাৎ তার চোখ যায় বটগাছের দিকে, দেখেইতো হতবাক! একাই সে ফিস ফিস করে বলতে থাকে কি আশ্চর্য! বটগাছের উপরে এত বিদু্যৎ বাতি এলো কোথা থেকে? সেখানে আবার নাচ-গানের এত সুন্দর শব্দ শোনা যায়! চরকুন এক পা দু'পা করে বটগাছের দিকে যেতে থাকে। গান শোনার নেশা তার ভয় ডর চুপসে গেছে। আগের দিনে নাচ-গান পাগল লোক যারা; তারা সবাই এমনই ছিল। বটগাছের নিচে গিয়ে উপরে তাকাতেই হরকুন জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে যায়। এরপর গাছের উপর থেকে এক বয়স্ক জলপরী নিচে নেমে এসে কী যেন মন্ত্র পড়ে চরকুনের কানে জোরে ফু দেয়, তখন চরকুন লাড়া দিয়ে উঠে বসে। দেখে তার সামনে এক বৃদ্ধ মহিলা বসে আছে। চরকুনের দিকে তাকিয়ে সেই মহিলা বলছে, হে চরকুন তুমি ভয় পেয়েছো বুঝি? ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।

আমি বুঝতে পেরেছি তোমার গানবাজনা শোনার খুব নেশা। তবে তুমি এক কাজ কর, ভয় পাবে না কিন্তু। আমরা তোমার কোনো ক্ষতি করব না। আমাদের যারা ক্ষতি করে না এবং আমাদের নাচ-গান যারা পছন্দ করে তাদের আমাদের আসরে নিয়ে গিয়ে আদর আপ্যায়ন করে বসার সুযোগ করে দেই। এই বলে বৃদ্ধ জলপরী তার পরিচয় তুলে ধরে বলে যে আমরা সবাই জলপরী!

আমরা মাসে একবার করে এই বটগাছের উপরে একটু আমোদ ফূর্তি করি। তোমার বাবা হরকুনকে আগে থেকেই আমরা চিনি।

সে আমাদের ব্যাপারেও জানে; সে খুব ভালো একজন জেলে মাছ ধরে বিক্রি করে তোমাদের ভরণপোষণ দেয়। আর রাত হলে সে আর ঘরের বাহিরে কখনো আসে না। আমরাও তার অনিষ্টের চেষ্টা কখনো করি না। হাজার হলেও বেচারা একজন খেটে খাওয়া নিরীহ মানুষ। যা করে সবই তোমাদের কল্যাণের জন্যই করে অসৎ পথে এক পয়সাও উপার্জন করে না। তাই আমরা সবাই তাকে ভালোবাসি এবং তার মাছ ধরার কাজে সহযোগিতা করে থাকি। যখন সে নদীতে মাছ ধরতে যায় আমরা সবাই পানির নিচ থেকে মাছের পেছনে পেছনে ধাওয়া করে তোমার বাবার জালের দিকে পাঠিয়ে দেই, আর তাই সে অন্য জেলেদের চেয়ে বেশি মাছ পায়।

কিন্তু এসব খবর তোমার বাবা জানলেও কাউকে বলে না। কারণ আমাদের সব খবর মানুষের কাছে বলা নিষেধ।

মানুষ এখন খুব খারাপ হয়ে গেছে। একজন অন্যজনের হক আত্মসাৎ করে। একের ভালো অন্যজনে এখন আর সহ্য করতে পারে না। সবাই নিজের পেট ভরাতেই পাগল। তবে আমাদের মধ্যে এ সব নেই। আমাদের কেউ বিপদে পড়লে সবাই মিলে তাকে উদ্ধার করি। আর বর্তমানে মানুষের মধ্যে কেউ বিপদে পড়লে কেউ উদ্ধার করতে চায় না, আরও ফায়দা লোটার চেষ্টা করে।

যাক এসব কথা রাখি, এখন তুমি আমার পিঠের উপর চড়ে শক্ত করে আমার ডানা ধরো, আমি তোমাকে বটগাছের উপর আমাদের আসরে নিয়ে যাব। ভয় পাবে না মোটেই, সবাই তোমাকে আদর করবে।

চরকুন এবার খুশি হয়ে জলপরী জলপনার পিঠে উঠে শক্ত করে ডানা চেপে ধরলে জলপরী চোখের পলকে বটগাছের উপরে নিয়ে তাদের আসরে বসিয়ে দিয়ে সব জলপরীদের সঙ্গে পরিচয় করে দেয় এবং বলে দেয় কেউ যেন চরকুনের ক্ষতি না করে, তাকে যেন সবাই আদর আপ্যায়ন করে। এই বলে পরীদের নিয়ে আসা বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি খেতে দিয়ে নাচ-গান শোনার সুযোগ করে দেয়।

নাচ-গান শেষ হলে জলপরীরা চলে যাওয়ার আগে চরকুনকে বলে, এই শোনো আমরা যে এখানে নাচ-গান করি তা কিন্তু কাউকে বলবে না। যদি বলো তা হলে তোমার এবং তোমার পরিবারের বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবে, আমরা কিন্তু তোমাদের কাউকেই ছাড়ব না। আর কখনো রাতের বেলায় একা একা বাড়ির বাহিরে যাবে না কিন্তু।

রাতে একা একা বাহিরে ভালো মানুষ অযথা ঘুরাঘুরি করে না। রাতে ভালো করে লেখাপড়া করে ঘুমিয়ে যাবে। তারপর সময় পেলে তোমার বাবার কাজে সহযোগিতা করবে, তাতে তোমাদের অনেক উন্নতি হবে। চরকুন তার সব কথা মনোযোগ সহকারে শুনে নিয়ে সম্মতি দেয়। জলপরী জলপনা আবার তার পিঠে তুলে চরকুনকে তার বাড়ির উঠানে পৌঁছে দিয়ে দলবল নিয়ে তাদের জলের দেশে নিয়ে যায়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে