শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ঝিঙে ফুল : নজরুলের শিশুতোষ কাব্য

আবু আফজাল সালেহ
  ২৮ মে ২০২৩, ০০:০০

বেশ কিছু শিশুতোষ ছড়া লিখেছেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ছোটদের জন্য বেশ কিছু ছড়া, কিশোর-কবিতা ও গান লিখেছেন। গ্রামের সাধারণ দৃশ্য ও শিশুদের পছন্দমতো বিষয় বেছে নিয়ে দারুণ ও সাবলীল ছড়া/কবিতা লেখেন। দুঃখ-কষ্টের মধ্যে বড় হয়েছেন বলে সবাই দুঃখু মিয়া বলে ডাকত পরিবার বা চুরুলিয়া গ্রামের মানুষজন।

১৯২৬ সালে প্রকাশিত ঝিঙে ফুল সাধারণত শিশুতোষ। ঝিঙে ফুলের পর আর একটি শিশুতোষ কবিতা প্রধান কাব্যগ্রন্থ সঞ্চয়ন (১৯৫৫)। ছায়ানটে (১৯২৫) শিশুতোষ 'চিরশিশু' কবিতাটি আছে। ১৯২১ সালের এপ্রিল-মে মাসে দৌলতপুরে আকবর খানের বাড়িতে থাকাকালীন কিছু কবিতা ছায়ানটে স্থান দেওয়া হয়েছে। শিশুতোষ কবিতা-ছড়ায় ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। প্রচলিত ধারা থেকে বেরিয়ে এনেছেন নতুনত্ব। ১৯৪০ সালে কাজী নজরুল ইসলাম 'আকাশ বাণী' রেডিওতে শিশুদের নিয়ে একটি অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন। নজরুল তার সিদ্ধহস্তে অসংখ্য ছড়া লিখেছেন। নজরুলের শিশুতোষ ছড়ার মধ্যে বিশেষভাবে উলেস্নখযোগ্য- পিলেপটকা, খাদু দাদু, লিচু চোর, মটকু মাইতি, খুকি,কাঠবিড়ালী প্রভৃতি। তার ঝিঙে ফুল কাব্যে শিশুদের উপযোগী ১৩টি ছড়াই খুবই মজার। ঝিঙে ফুল (১৯২৬) তার সমকালের শিশুসাহিত্যের বিবেচনায় এক বিস্ময়কর নাম, শিশু মননজাত প্রসূত চিন্তাভাবনার প্রকাশ- যা সাবলীল ও শিক্ষণীয় কিন্তু শিশু উপযোগী ও মজার। এ কাব্যে ছড়া-কবিতার সংখ্যা ১৩টি; যথা ১. খুকি ওকাঠবিড়ালী, ২. খোকার খুশি, ৩. খাঁদু-দাদু, ৪. দিদি বে'তে খোকা, ৫. মা, ৬. খোকার বুদ্ধি, ৭. খোকার গপ্প বলা, ৮. চিঠি, ৯. প্রভাতি, ১০. লিচু চোর, ১১. ঠ্যাং-ফুলি, ১২. পিলে পটকা ও ১৩. হোঁদল-কুঁৎকুঁতের বিজ্ঞাপন। নামগুলো দেখেই বোঝা যায় জনপ্রিয় শিশুতোষ কবিতার সমাহার এ বইটি।

প্রথমেই নাম কবিতায়, 'ঝিঙে ফুল' এ- ঝিঙে ফুল! ঝিঙে ফুল।/সবুজ পাতার দেশে ফিরোজিয়া ফিঙে-কুল/ঝিঙে ফুল। দারুণ বর্ণনা। রং এবং ফুল একইসঙ্গে শিশুমনকে দোলা দেয় এবং শিশুমনে গ্রন্থিত হয়। 'খুকি ও 'কাঠবিড়ালী' কবিতাটি আবৃত্তি করেনি এমন লোক পাওয়া যাবে না! কি সুন্দরভাবেই না কবি উপস্থাপন করলেন! 'খুকি ও কাঠবিড়ালী' শিশুর মনোজগতের এক অদ্ভুত চলচ্চিত্রকে উপস্থাপন করে। পুরো কবিতাটিই কাঠবিড়ালিকে উদ্দেশ করে খুকির সংলাপে রচিত। একটি পেয়ারার জন্য খুকির আগ্রহ, তার আবেগ, চাওয়া-পাওয়া নিয়ে ফুটিয়ে তুললেন। প্রথমে কাঠবিড়ালির সঙ্গে বন্ধুতার আয়োজন, তারপর তাকে খুশি করে তার কাছ থেকে পেয়ারা পাওয়ার চেষ্টা। কবি 'কাঠবিড়ালী'ক নিয়ে লিখেছেন চমৎকার একটি ছড়া। ছড়াটি হলো: 'কাঠবিড়ালী! কাঠবিড়ালী! পেয়ারা তুমি খাও?/গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও? বাতাবি নেবু?/লাউ?/বেড়াল-বাচ্চা? কুকুর-ছানা? তাও?'। তারপর খুকি (অঞ্জলি নামের এক মেয়েকে দেখে কবির অনুভূতি) বলল- 'ইস! খেয়ো না মস্তপানা ওই সে পাকাটাও!/আমিও খুব পেয়ারা খাই যে! একটি আমায় দাও...'

'লিচু-চোর' কবিতায় বর্ণিত হয়েছে সহজ-সরল গ্রামীণ জীবনের একটি স্বাভাবিক ঘটনা। এখানে আছে কোনো এক কিশোর লিচু চুরি করতে গিয়ে ঝামেলায় পড়া তারপর মিথ্যা না বলার/চুরি না করার প্রতিশ্রম্নত। 'বাবুদের তাল-পুকুরে/হাবুদের ডাল-কুকুরে/সে কি বাস, করলে তাড়া, /বলি থাম, একটু দাঁড়া!/পুকুরের ওই কাছে না/লিচুর এক গাছ আছে না..... যেই চড়েছি/ছোট এক ডাল ধরেছি/ও বাবা, মড়াৎ ক'রে/পড়েছি সড়াৎ জোরে!/পড়বি পড় মালির ঘাড়েই'। দারুণ সাবলীন ও রুদ্ধশ্বাস বর্ণনা! এত সহজসরল ভাষায় কয়জনে লিখতে পেরেছেন? পরে চুরির বিষয়ে অনুতাপ হয়ে চিন্তার পরিবর্তন: 'যাবো ফের? কান মলি ভাই/চুরিতে আর যদি যাই,/তবে মোর নামই মিছা। /কুকুরের চামড়া খিঁচা/সে কি ভাই যায়রে ভুলা-/মালীর ওই পিটনী গুলা/কি বলিস? ফের হপ্তা?/তওবা, নাক খপ্তা।' 'প্রভাতি' কবিতায় কবি লেখেন- 'ভোর হল দোর খোল/খুকুমণি ওঠরে/ঐ ডাকে যুঁই শাঁখে/ফুলখুকী ছোটরে...' যা অমর হয়ে আছে। দেখা যায়, 'ঝিঙে ফুল' বইতে রচিত শিশু-কবিতাগুলো দারুণ কারুকার্যে, সহজ ও সাবলীলভাবে তুলে ধরেছেন কবি।

কলকাতার স্কুলে যাওয়া দুশিশু রোজ পাঠশালাতে যেত। একজন ছিল দারুণ বেঁটে আর মোটা, অন্যজন টিনটিনে শুকনো আর ছিপছিপে লম্বা। অনেকটা তালপাতার সেপাইয়ের মতো। এ দুজনকে দেখে নজরুল এতটাই মজা পেয়েছিলেন, একদিন হঠাৎই তিনি লিখেছিলেন : 'মটকুল মাইতি বাঁটকুল রায়/ক্রুদ্ধ হয়ে যুদ্ধে যায়' শুধু শিশুদের চঞ্চল মন মাতিয়ে রাখার পদ্যই লিখেননি নজররুল, শিশু-কিশোরদের মনে তাদের মতো করেই গভীর ভাব জাগিয়ে তোলারও চেষ্টা করেছেন- এমন মহান কারিগর। নজরুল লিখলেন : 'নতুন দিনের মানুষ তোরা/আয় শিশুরা আয়!/নতুন চোখে নতুন লোকের/নতুন ভরসায়।/নতুন তারায় বেভুল পথিক/আসলি ধরাতে/ধরার পার আনন্দ-লোক/দেখাস ইশারায়।/খেলার সুখে মাখলি তোরা/মাটির করুণা,/এই মাটিতে স্বর্গ রচিস,/ তোদের মহিমায়।'

নজরুলের শিশুসাহিত্য বাংলা সাহিত্যের অনন্য সম্পদ। তিনি বাংলা শিশুসাহিত্যকে প্রথাগত প্রবণতা থেকে মুক্তি দিয়ে বাস্তবমুখী চেতনার সঙ্গে যুক্ত করেছেন। নজরুলের এ অবদান নিঃসন্দেহে তাৎপর্যময়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে