তিন্নির বয়স প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর কিন্তু এখনো পর্যন্ত লেখাপড়ায় হাতেখড়ি হয়নি। মা-বাবার একমাত্র সন্তান হওয়ায় ব্যাংকার বাবার অতিরিক্ত আদর ছোট্ট তিন্নিকে এক্কেবারে পড়ালেখা বিমুখ করেছে।
তিন্নির পড়ালেখা নিয়ে কেউ কিছু বলতে গেলেই বাবা থামিয়ে দেয়। বলে ও ছোট মানুষ ওর মনে যা চায় তাই করুক। কেউ ওর মনের ওপর কেউ চাপ দেবে না। ওর পড়ালেখা নিয়ে কথা বলবে না। সময় হলে সব হবে।
এত চঞ্চল ও দুরন্ত হয়েছে সে, যে এখনো পর্যন্ত কেউ তাকে খাতা কলম বা চক শ্লেট নিয়ে বসাতে পারেনি। তার কাজ হলো সারাদিন টইটই করে ঘুরে বেড়ানো, খেলা করা আর পাকা পাকা কথা বলা।।
বাবা তো সারাদিন থাকে ব্যাংকে। বিপদে পড়েছে মা।
\হতিন্নির মা বেশ শিক্ষিত হয়েও গৃহিণী। বাড়িতে ঘর কন্যা সামলানো তার কাজ। সে এখন থেকেই মেয়েকে পড়ার টেবিলে বসাতে চায় কিন্তু মেয়েকে পড়ালেখার কথা বলতে গেলেই শুধু পাকা পাকা কথা বলে। বাবা বলেছে না! আমার লেখাপড়া নিয়ে কেউ কথা বলবা না। এই বলেই দৌড়ে এদিক ওদিক খেলতে চলে যায়। কিছুতেই বই খাতার পাশে বসে না।
মা চাইলো মেয়েকে বাড়ির পাশের পাঠশালার মাস্টার মশাইয়ের কাছে দিতে। বাদ সাধলো বাবা-মেয়ে দুজনেই।
মা'র মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে কীভাবে মেয়েকে খাতা কলমের পাশে বসানো যায়। যেহেতু এখনো তিন্নির ব্রেনটা কাদামাটির মতো আছে তাই ডাইভার্ট করে যা তৈরি করা হবে- তাই হবে।
একদিন বাবা ব্যাংকে চলে গেলে মা মেয়েকে ডেকে বললো, তিন্নি সোনা মা এসো তো আমরা ডিম ডিম খেলি।
তিন্নি বলল, সে আবার কেমন খেলা মা?
- এসে দেখো না! এই খাতা আর এই কলম। দেখি তুমি কেমন ডিম বানাতে পারো আর আমি কেমন ডিম বানাতে পারি।
- তুমি আমাকে পড়ালেখা করাবে না তো!
- না রে মা! আমরা ডিম বানানো খেলব।
- তাহলে তুমি কি কি ডিম বানাতে পারো আগে আমাকে দেখাও।
- মা খাতায় কতকগুলো বৃত্ত মতো আঁকতে আঁকতে বলল- এই দেখ একটা মুরগির ডিম। এই একটা হাঁসের ডিম। এই একটা বকের ডিম। এই একটা চড়ুইয়ের ডিম।
- তিন্নি ছুটে এসে মায়ের হাত থেকে কলম কেড়ে নিয়ে খাতায় বড় বড় আঁকা বাঁকা বৃত্ত মতো দিয়ে বলল- এইটা হাতির ডিম, এইটা গরুর ডিম আর এইটা ঘোড়ার ডিম।
মা হাততালি দিয়ে হেসে বললো এইতো মামনি খুব ভালো ডিম বানাতে পারে।
মা মনে মনে এই ভেবে শান্তি পাচ্ছে মেয়ে হাতি, ঘোড়া ও গরু যার ডিম বলে বলুক অন্তত তো খাতা কলমে হাত দিয়েছে।
মা আবার বলল- মা মনি আরও কয়েকটা ডিম বানাও।
তিন্নি এঁকে চলেছে আর বলছে এইটা বাঘের ডিম, এইটা কুমিরের ডিম, এইটা বানরের ডিম।
মা আবার হাততালি দিয়ে উৎসাহ দেয়।
তিন্নি মজা পায়।
এভাবে সারাদিন চললো তিন্নির বিভিন্ন প্রাণীর ডিম বানানো খেলা।
রাতে বাবা বাসায় এলেই বাবাকে দেখালো সে কি কি ডিম বানাতে পারে। বাবা তো সব বুঝতে পারছে। বাবাও বেশ বেশ হয়েছে বলে অনেক উৎসাহ দিল তিন্নি সোনাকে।
তিন্নি ডিম বানানোয় যেন মজে গিয়েছে।
পরের দিন সকালে উঠে কাউকে কিছু বলতে হলো না। তিন্নি নিজেই খাতা কলম নিয়ে বসে গেল ডিম বানাতে।
এক একটা ডিম আঁকে আর মাকে দেখায় এইটা অমুকের ডিম এইটা তমুকের ডিম। মাও তাকে বাহবা দেয়।
এভাবে আস্তে আস্তে ডিম বানানো খেলার মধ্যে তিন্নি ডুবে গেল।
তিন চার দিনের মধ্যে তিন্নির ব্রেন ডাইভার্ট হয়ে গেছে খাতা কলমের মধ্যে।?
মা ধীরে ধীরে ডোজ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলো।
কয়েকদিন পর একদিন মা বলল, মামনি এবার একটা বড় ডিমের মধ্যে অনেক ছোট ছোট ডিম বানাতে হবে। ধরে নাও হাতির ডিমের মধ্যে চড়ুইয়ের ডিম, টিকটিকির ডিম, কাকের ডিম বানাতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে ছোট ডিমগুলো যেন বড় ডিমের সীমানার বাইরে না যায়। তাহলে কিন্তু তুমি ডিসকোয়ালিফাই হয়ে যাবে।
- ডিসকোয়ালিফাই মানে কি মা?
- ডিসকোয়ালিফাই মানে প্রতিযোগিতায় অযোগ্য হয়ে যাওয়া।
- মা আমি তো একা একা ডিম বানাচ্ছি। আমি কার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছি?
- ধরে নাও তুমি তোমার নিজের সঙ্গে নিজে প্রতিযোগিতা করছ।
- নিজের সঙ্গে নিজে প্রতিযোগিতা করা যায় নাকি?
- হঁ্যা এই যে তুমি করছো, তোমার মনের সঙ্গে তুমি প্রতিযোগিতা করছো, তোমার হাতের সঙ্গে তুমি প্রতিযোগিতা করছ।
- যাইহোক, তিন্নি বড় ডিমের মধ্যে ছোট ছোট ডিম বানানোর চেষ্টা করল।
- প্রথম প্রথম বাইরে চলে গেলে মা বলে তুমি কিন্তু ডিসকোয়ালিফাই হয়ে যাচ্ছ।
তক্ষুনি সে মুছে সংশোধন করে।
এভাবে চললো প্রায় সপ্তাহখানিক।
একদিন মা বলল, এই দেখো সোনা মা ডিমটাকে কেমন করে আমি চারকোণা ঘর বানিয়ে দিলাম। এখন এই চারকোনা ঘরের মধ্যে ছোট ডিমগুলো বানাচ্ছি।
তিন্নি বলল। আমিও পারবো মা- দাও না আমার কাছে।
তিন্নিও আঁকা বাঁকা চারকোণা ঘর বানালো। তার মধ্যে ডিম আঁকল।
এভাবে চারকোণা ঘরের মধ্যে ডিম আঁকা চললো বেশ কিছুদিন।
তারপর মা একদিন বলল, এই দেখো সোনা মা ডিম থেকে কেমনভাবে অ ও আ হয় এভাবে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জন বর্ণ লেখা শিখাতে শুরু করল।
তবে মা একটা বিষয়ের ওপর জোর দিল। বলল, তিন্নি মা সব সময় একটা বিষয় মনে রাখতে হবে- কোনো কিছু লেখার আগেই খাতার পৃষ্ঠা বরাবর চারপাশে দাগ টেনে বাউন্ডারি দিয়ে তার মধ্যে লিখতে হবে। কোনো অবস্থায় অক্ষর যেন বাউন্ডারির বাইরে না যায়।
-কেন মা।
- তুমি এরকম বাউন্ডারি দিয়ে বাউন্ডারির মধ্যে লিখতে লিখতে তোমার মনে ও ব্রেনে একটা বাউন্ডারি তৈরি হয়ে যাবে। একটা শৃঙ্খলা তৈরি হবে।
সত্যি সত্যি এতদিনে তিন্নির ব্রেনের সীমানা মায়ের দেওয়া বাউন্ডারির মধ্যে এসে গেছে।
মা যা বলছে তিন্নি তাই শুনছে।
অল্প কিছুদিনের মধ্যেই স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ ও সংখ্যা লেখা তিন্নির মুখস্থ হয়ে গেছে।
তবে তিন্নি যাই লিখুক না কেন, মায়ের কথামতো প্রথমে খাতার পৃষ্ঠাজুড়ে বাউন্ডারি এঁকে তার ভেতরে লেখে।
দেখতে দেখতে জানুয়ারি মাস এসে গেল। তার বাবা-মা ও তিন্নির নিজের ইচ্ছায় তিন্নিকে বাড়ির পাশের একটা কিন্ডার গার্টেন স্কুলে ভর্তি করানো হলো।
স্কুলে স্যার যা করায় বা যা লিখতে দেয় তিন্নি প্রথমে খাতার চারপাশে বাউন্ডারি টেনে তার ভেতরে লেখে। স্যারকে দেখাতে গেলে স্যার প্রথম প্রথম দু'একদিন কিছু না বললেও কয়েকদিন পর একদিন বলল, তিন্নি সোনা তুমি পৃষ্ঠার চারপাশে বাউন্ডারি দিয়ে লেখো কেন? এতে পৃষ্ঠার জায়গা কম হয়ে যায়। তুমি সবার মতো শুধু পৃষ্ঠার উপরে ও বামে দাগ টেনে মার্জিন দিয়ে লিখবে।
তিন্নি বলল, না স্যার আমি তা পারব না। আমার মা বলে দিয়েছে পৃষ্ঠার চারপাশে বাউন্ডারি দিয়ে তার ভেতরে লিখতে।
- তুমি বাড়ি যাই করো স্কুলে এসে আমি যেভাবে বলছি সেভাবে লিখবে।
- তা হবে না স্যার। আমি মায়ের কথার বাইরে যেতে পারব না।
- তাহলে তো আমার তোমার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে হয়।
- তাই চলুন স্যার।
সত্যি সত্যি সেদিন বিকালেই স্যার তিন্নিদের বাড়ি যেয়ে হাজির।
তিন্নির মা স্যারকে যত্ন আপ্যায়ন করল।
এরপর স্যার তিন্নির মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনি নাকি মেয়েকে পৃষ্ঠা বরাবর চারিদিকে বাউন্ডারি দিয়ে তার ভেতরে লিখতে বলেছেন? কেন?
তিন্নির মা বলল, দেখুন স্যার যখন একটা শিশু পৃষ্ঠায় বাউন্ডারি দিয়ে তার ভেতরে লিখবে তখন তার ব্রেনে ও মনে একটা বাউন্ডারি তৈরি হয়ে যাবে। একটা শৃঙ্খলা তৈরি হয়ে যাবে। তার মনে হবে এই সীমানার বাইরে যাওয়া চলবে না। এই সীমাবদ্ধতা তাকে নিয়মানুবর্তি হতে শেখাবে।
তার প্রমাণ তিন্নি কিন্তু আপনি বলা সত্ত্বেও আমার কথার বাইরে যায়নি। কারণ তার ভেতরে ইতোমধ্যে আমার দেওয়া বাউন্ডারি কার্যকর হতে শুরু করেছে।
শিশুদের সীমাবদ্ধতা শেখানোর এটাই সর্বোত্তম উপায়।
স্যার ভেবে দেখলেন সত্যিই তো।
পরদিন স্যার ক্লাসে যেয়ে সব ছাত্রছাত্রীদের তিন্নির মায়ের পদ্ধতি প্রয়োগ করে লেখালেন। কোনো কিছু লেখা বা আঁকার আগে খাতার চারপাশে বাউন্ডারি টেনে নিতে বললেন। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বাউন্ডারি দেওয়ার ফল স্যার হাতেনাতে পেলেন। ছেলেমেয়েরা আগের থেকে অনেকটাই লেখাপড়া বা চালচলনে সীমাবদ্ধতা ও শৃঙ্খলার মধ্যে চলে এসেছে।