সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
ভিনদেশি রূপকথা

ভাগ্যবতীর গল্প

রূপান্তর: মোস্তাফিজুল হক
  ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

দূর অতীতে এক গাঁয়ে এক গরিব পরিবার ছিল। তাদের ছিল সাতটি মেয়ে। মেয়েদের বাবা একদিন লাকড়ির খোঁজে বেরুলেন। পাহাড়ে গিয়ে তিনি সাতটি বুনোহাঁসের ডিম পেলেন। ডিমগুলো বাড়িতে নিয়ে এলেও ওগুলো মেয়েদের খেতে দিতে রাজি নন। শুধু তিনি আর তার বিবিই খাবেন বলে ভাবলেন। রাতে বড় মেয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠে সে তার মাকে জিজ্ঞেস করল, 'মা, তুমি কী রান্না করো?'

মা বললেন, 'বুনো হাঁসের ডিম রান্না করছি। শোনো, তোমাকেও একটা দেব, যদি তোমার বোনদের না জানাও।' কথামতো তিনি তাকে একটা ডিম দিলেন।

তারপর দ্বিতীয় মেয়েও জেগে উঠে তার মাকে জিজ্ঞেস করল, মা কী রান্না করছে। এবারও মা বললেন, 'বুনো হাঁসের ডিম। তুমি যদি তোমার বোনদের না বলো, তবে তোমাকেও একটা দেব।'

মা কথামতো কাজ করলেন। এমনটা করতে করতে সবগুলো ডিম মেয়েরাই খেয়ে ফেলল। আর কোনো ডিমই বাকি রইল না।

ভোরে মেয়েদের বাবা ঘটনাটা শুনলেন। তিনি মেয়েদের ওপর খুব রেগে গেলেন। এতটাই রেগে গেলেন যে, ওদের নেকড়ের মুখে ঠেলে দিতে চান। নির্দয় বাবা মেয়েদের পাহাড়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করলেন। সাত মেয়েকে ডেকে বললেন, 'তোমরা নানার বাড়ি যেতে চাও কে কে?'

বাবার ডাকে সবাই হাজির। তবে বড় মেয়েটা কেন জানি বাবার এই প্রস্তাবে সন্দেহ পোষণ করল। তাই সে বাবাকে বলল, 'বাবা, আমরা আজ যেতে চাচ্ছি না!' তবে ছোট দুই মেয়ে বলল, 'আমরা যাব, বাবা।'

ছোট মেয়ে দুটো তাদের বাবার সঙ্গে রওনা হলো। অনেকটা পথ পেরিয়ে যাওয়ার পর ওরা বলল, 'বাবা, আমরা কি শিগগিরই নানিবাড়ি পৌঁছাতে পারব?'

'এই-ই তো, একটু পরেই পৌঁছে যাব'। তারপর বাবা পাহাড়ে এসে বললেন, 'তোমরা এখানে একটু অপেক্ষা করো। সামনের পাড়ায় তোমাদের নানি কাজ করেন। আমি তাকে গিয়ে বলি, তোমরা এসেছ।'

এই বলে মেয়ে দুটোর বাবা গাধার গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন। ওরা বাবার জন্য অপেক্ষা করতেই থাকল। তবে বাবা আর ফিরে এলেন না। অবশেষে মেয়েরা বুঝে গেল, বাবা আর তাদের নিতে আসবেন না। তিনি তাদের পাহাড়ে ফেলে রেখে গেছেন।

নিরুপায় মেয়েরা রাতের আশ্রয় খুঁজতে লাগল। তারা পাহাড়ের আরও গভীরে এগিয়ে গেল। বহুপথ হেঁটে এক সময় একটি বড় পাথর দেখতে পেল। তাই তারা ভাবল, এটা দিয়ে বালিশের কাজ হবে। তারা ঘুমাবার জায়গায় পাথরটাকে নিয়ে যাবে।

কিন্তু মেয়েরা পাথরটা সরাতেই একটি গোপন গুহার খোঁজ পেয়ে গেল। ওটা দিয়েই গুহার মুখ এঁটে রাখা হয়েছিল। অর্থাৎ, পাথরটা হলো সেই গোপন গুহার দরজা।

গুহার ভেতরে আলো জ্বলছে। দুইবোন গুহায় প্রবেশ করল। আলোর দু্যতিতে ওরা গুহার ভেতরে বহু মূল্যবান রত্নপাথর দেখতে পেল।

সেই গুহাটি ছিল এক নেকড়ে ও এক শেয়ালের। তাদের কাছে ছিল বহু মূল্যবান জহরত। ছিল মুক্তোর জার। সেই জার রাতের বেলায় আলো ছড়ায়। দুইবোন সমস্বরে বলল, 'ভারী সুন্দর এই গুহা! চলো, বিছানায় শুয়ে পড়ি।'

দুটো সোনার বিছানা পাতা। চাদরে ছিল কাঞ্চনী সুতোয় নকশা আঁকা। মেয়েরা বিছানায় শুয়ে পড়ামাত্রই ঘুমিয়ে পড়ল। রাতে নেকড়ে আর শেয়াল তাদের গুহায় ফিরে এলো। নেকড়ে বলল, 'আমি মানব মাংসের ঘ্রাণ পাচ্ছি!'

শেয়াল বলল, 'উফ! এসব বাজে কথা বলবে না! এমন কোনো মানুষ নেই, যে আমাদের গুহায় প্রবেশ করতে পারে। গুহার মুখকে তো খুব ভালো করেই বন্ধ করে রেখেছিলাম!'

নেকড়ে বলল, 'খুব ভালো। তাহলে চলো, আমরা ঘুমুতে যাই।'

'আজ শীত খুব বেশি। চলো, আমরা না হয় আমাদের কেতলিতে ঢুকে উষ্ণ একটা রাত উপভোগ করি'- শেয়াল বলল।

মেরু দেশের বায়ুরোধী ঘরের মতোই ওদের কেতলি। ওদের দুটো কেতলি। একটা সোনার, অন্যটা রুপার। ওরা আয়েশ করে কেতলির ভেতরে ঢুকে কুঁচকে রইল।

মেয়েরা খুব ভোরে উঠে সহসাই নেকড়ে ও শেয়ালকে শুয়ে থাকতে দেখে খুব ভয় পেয়ে গেল। ওরা ভয়ে সেই কেতলি দুটোর ঢাকনার ওপরে বেশ কয়েকটা বড় পাথর চাপালো, যাতে নেকড়ে আর শেয়াল বের হতে না পারে। তারপর গনগনে আগুন জ্বালাল।

নেকড়ে আর শেয়াল বলল, 'ওহ, আজকের ভোর কী যে উষ্ণ আর কতই না মনোরম! কেমন করে এমন হলো?'

সময় গড়াতে গড়াতে সেই উষ্ণতা অসহনীয় হলে ওরা গরমে অতিষ্ঠ হলো। তারপর নেকড়ে ও শেয়াল হঠাৎ খেয়াল করল- দুটো মেয়েই আগুন জ্বেলেছে। ওরা মেয়েদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলল, 'দয়া করে আমাদের বের হতে দাও! আমরা তোমাদের অনেক মূল্যবান জহরত আর বহু বহু স্বর্ণদানা দেব। বিশ্বাস করো, আমরা তোমাদের কোনো ক্ষতি করব না!'

মেয়েরা শৈশবে দাদুর কাছে শেয়াল আর নেকড়ে নামের অভিশপ্ত দসু্যর গল্প শুনেছিল। তাই তারা তাদের কথায় সায় দিল না। বরং আগুনের আঁচকে আরও বাড়িয়ে তুলল। অবশেষে গরমে সিদ্ধ হয়ে নেকড়ে আর শেয়াল মারা গেল।

দুইবোন সেই গুহায় বেশ কিছুদিন সুখেই কাটাতে লাগল। এক সময় নির্দয় বাবার মনে ভীষণ অস্থিরতা তৈরি হলো। তিনি মেয়েদের ফিরে পেতে চান। তাই ওদের খোঁজে পাহাড় চষে বেড়াতে লাগলেন। ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। তারপর একদিন ঠিক সেই গুহার পাথরেই বিশ্রাম নিতে বসলেন। পাশেই ছিল বায়ুরোধী ঘর বা সেই কেতলি দুটোর নল। ছাই সরিয়ে বসতে গিয়ে নলে আঘাত লেগে শব্দ হলো। তখন ভেতর থেকে মেয়েরা বলল, 'আমাদের দরজায় কে কড়া নাড়ে?'

জবাবে বাবা বললেন, 'এটা কি আমার মামণিদের গলার আওয়াজ?'

মেয়েরা জবাবে বলল, 'এটা কি আমাদের বাবার কণ্ঠস্বর নয়?'

পাথরটি একপাশে সরাতেই মেয়েরা বাবাকে দেখতে পেল। বাবাও তার ফেলে যাওয়া মেয়েদের দেখা পেয়ে ভীষণ খুশি হলেন। তিনি অবাক হয়ে সবকিছু দেখতে লাগলেন। বহু মূল্যবান রত্নেভরা এই গুহাবাড়ি। বাবাকে তার মেয়েরাও গুহার পুরো ঘটনা খুলেই বলল।

রত্নপাথর আর স্বর্ণদানাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে হলে লোকবলের দরকার। তাই বাবা ফিরে গিয়ে লোকজন নিয়ে এলেন। মেয়েরা বাড়িতে ফিরে এলো। লোকটার বিবি জানতে চাইলেন যে, এতসব ধনরত্ন কোথায় পেলে? ফিরে আসা মেয়েরা তাদের মাকে সবকিছুই জানালো। অবশেষে সেদিন থেকে তারা হলো বেশ ধনাঢ্য পরিবার। তারপর তারা যুগযুগ ধরে সুখেশান্তিতে বসবাস করতে থাকল।

মূলগল্প: দ্য কেইভ অব দি বিস্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে