অনেকটা দৌড়ের ভঙ্গিতে হাঁটছে রাসেল। কারণ, সন্ধ্যার আগেই বাড়ি পৌঁছাতে হবে তাকে। তা না হলে বাবা-মা'র বকা খেতে হবে। বকা খেলেও তেমন সমস্যা ছিল না; কিন্তু সমস্যা হলো পথের পাশেই শতবর্ষী একটি তেঁতুল গাছ আছে- সে গাছে নাকি ভূত থাকে।
প্রতিদিন বিকালে মাঠে ক্রিকেট খেলতে যায় রাসেল। আজ বিকালে খেলাটা বেশ জমে উঠেছিল। কখন যে বেলা প্রায় ডুবুডুবু হয়ে গিয়েছিল বুঝতেই পারেনি সে। খেলার মাঠ থেকে বাড়ির দূরত্ব প্রায় আধা কিলোমিটারের মতো। অন্যান্য দিন বন্ধু আরিফ ও রাসেল খেলা শেষে একসঙ্গে বাড়ি ফিরত। কিন্তু আরিফ অসুস্থ থাকায় আজ খেলতে আসেনি সে।
মনে হয় না সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরতে পারবে আজ। এ পথে মানুষের চলাচলও খুব কম। আগে-পিছে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে ভয়টা আরও বেড়ে যায় তার। কিন্তু ভয় পেলে চলবে না। ক্লাস ফাইভে পড়ে সে। এখন আর একেবারে ছোট্ট খোকাটি নয় যে, সামান্য কিছুতেই ভয় পেয়ে যাবে।
বেলা ডুবে গেছে ইতোমধ্যে। একটা আবছা অন্ধকার নেমে এসেছে। ঝিঁঝিঁ পোকারা যেন আস্তে আস্তে সরব হয়ে উঠছে। রাস্তার দু'ধারে সারি-সারি আম-কাঁঠালের গাছ। অন্ধকার যেন আরও গাঢ় হয়ে আসছে ক্রমশ। এবার খুব ভয় পেয়ে যায় রাসেল। ওই তো দেখা যাচ্ছে বিশালাকার সেই ভুতুড়ে তেঁতুল গাছটি।
রাতের বেলা অনেকেই নাকি ভূতের কবলে পড়েছে এই তেঁতুল গাছের নিচে। কেউ কেউ লাল-নীল আলোর বিচ্ছুরণ দেখেছে, কেউ বা শুনেছে অদ্ভুত রকমের সব আওয়াজ। এসব ভেবে গা-টা ছমছম করে ওঠে তার।
যতই ভয় করুক, দ্রম্নতই গাছটা পার হতে হবে। আর মাত্র ত্রিশ-চলিস্নশ ফিট দূরে রয়েছে গাছটি। তাই ডানে-বামে না তাকিয়ে হাঁটার গতি আরও বাড়িয়ে দেয়। তেঁতুল গাছের নিচে আসতেই ভয়টা আরও চেপে বসে বুকে। অন্ধকার যেন এখানটায় জমাট বেঁধে লেপ্টে আছে রাস্তার সঙ্গে। ঠিক সেই মুহূর্তে একটা দমকা হাওয়া বয়ে যায় গাছের উপর দিয়ে। ঝিরঝির করে অসংখ্য তেঁতুল পাতা ঝরে পড়ে তার গায়ের ওপর।
মনে হচ্ছে, এই বুঝি ভয়ংকর কোনো ভূত চেপে ধরবে গলায়।
ভয়ে ঘামছে পুরো শরীর। এই তো গাছটা পার হয়ে গেল বলে। আর কয়েক সেকেন্ড মাত্র। কিন্তু এর মধ্যেই ঘটে গেল গা হিম করা ঘটনাটি। গাছের উপর থেকে ভেসে এলো ভয়ংকর আওয়াজ, 'কে যায় এখান দিয়ে? আর এক পা এগুবি না। এগুলেই নির্ঘাত মৃতু্য।'
শরীরের পুরো শক্তি যেন নিঃশেষ হয়ে আসে রাসেলের। পাথরের মূর্তির মতো সটান দাঁড়িয়ে থাকে রাস্তার ওপর। এক পা এগুনোর শক্তি নেই তার। বাইরে থেকেও হৃৎপিন্ডের দাপাদাপি শুনতে পাচ্ছে সে।
এমন সময় হঠাৎ লাল এবং নীল আলোর বিচ্ছুরণ এসে পড়ে রাসেলের চোখের ওপর। ফলে সামনে আর কিছুই দেখতে পায় না সে। কিছুক্ষণ পর চোখ দুটো স্বাভাবিক হয়ে এলে লক্ষ্য করে, গা হিম-করা ভয়ংকর চেহারার একটি ভূত সামনে দাঁড়িয়ে।
কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে রাসেল। এই ভূতের কবলেই বুঝি প্রাণ যাবে তার। ফেরা হবে না আর বাড়িতে। দেখা হবে না বাবা-মা'র সঙ্গে। বাবা-মা নিশ্চয়ই চিন্তা করছে খুব। হয়তো এরই মধ্যে বাবা তাকে খুঁজতে বেরিয়ে গেছে।
এভাবেই চুপচাপ কেটে যায় কিছু সময়। মনে মনে ভাবে রাসেল, ভয়ংকর ভূতটার সঙ্গে কথা বলা দরকার। অন্তত বাঁচার চেষ্টা করে দেখতে অসুবিধা কোথায়?
ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে রাসেল, 'তুমি কে? আমাকে যেতে দিচ্ছ না কেন? আমাকে ছেড়ে দাও। আমি বাড়ি যাব।'
গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দেয় ভূত, 'আমি কে? হা-হা-হা। আমি রোবট ভূত। বুঝলে পুঁচকে?'
এবার একটু ভালো করে তাকায় রাসেল। সত্যিই তো। রোবট বলেই তো মনে হচ্ছে।
অবাক হয়ে জানতে চায় রাসেল, 'রোবট আবার ভূত হয় নাকি?'
'হয় হয়। এই যে আমি হলাম।'
রাসেলের পাল্টা প্রশ্ন, 'রোবট ভূতের কথা তো আগে শুনিনি কখনো। কীভাবে তুমি ভূত হলে?'
'সে অনেক কথা! তোকে বলে কী লাভ! মানুষকে আমি খুব ঘৃণা করি। তুইও তো একজন মানুষ। এক্ষুনি তোর ঘাড় মটকে আমি প্রতিশোধ নেব।' বলেই বিকট শব্দে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে রোবট ভূত।
এবার সত্যিই আরও ভয় পেয়ে যায় রাসেল। কিন্তু বিপদে মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। আবার জিজ্ঞেস করে রাসেল, 'বলোই না, কীভাবে ভূত হলে তুমি! জানতে ইচ্ছে করছে খুব।'
'শোন তাহলে। বলছি সব। তাই বলে মনে করিস না, ছেড়ে দেব তোকে। ঘাড় তোর মটকাবই।' এইটুকু বলে ভূতটা আরও দুই পা এগিয়ে আসে রাসেলের দিকে। আবার বলতে শুরু করে, 'জানিস তো এখান থেকে পশ্চিম দিকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে একটি ইস্পাত কারখানা আছে। সেই কারখানার একজন কর্মী ছিলাম আমি। রাত-দিন চব্বিশ ঘণ্টাই কাজ করতাম। এভাবে প্রায় দশ বছর কাজ করেছি সেই ইস্পাত কারখানায়।'
এটুকু বলেই খানিকটা চুপ হয়ে যায় রোবট ভূত। 'থেমে গেলে কেন? বলো না কী হলো তারপর?' জানতে চায় রাসেল। 'সব বলছি শোন। হঠাৎ একদিন কারখানার ইঞ্জিনিয়াররা আমাকে কাজ থেকে সরিয়ে দেয়। আমি নাকি ব্যাকডেটেড হয়ে গেছি। আমার জায়গায় আরেকটি রোবটকে কাজ দিয়েছে তারা। আর আমাকে নিয়ে রেখে দেয় এক অন্ধকার কুঠুরিতে। এটা আমার জন্যে বড় অপমানের বিষয়। এ ব্যাপারে তুই কী বলিস, বল শুনি?'
কিছুটা সাহস ফিরে আসে রাসেলের মনে।
তাই রোবট ভূতের প্রশ্নের জবাবে বলে, 'সত্যিই তোমার জন্যে এটা খুব কষ্টের এবং অপমানের।' রাসেলের কথায় খুশি হয়ে রোবট ভূত বলতে থাকে, 'কিছুটা হলেও তুই আমার কষ্টটা বুঝতে পেরেছিস। এজন্যে তোকে ধন্যবাদ।'
রাসেল যেন আশার আলো দেখতে পাচ্ছে। ভয়টা ক্রমশ দূর হতে থাকে। ভূতটা আবার শুরু করে, 'জানিস পুঁচকে, শুধু কাজ থেকে সরানোই আমার একমাত্র কষ্টের কারণ নয়।'
'আর কী কষ্ট আছে তোমার, বলো শুনি?' একটু সহানুভূতির সঙ্গে জানতে চায় রাসেল।
রোবট ভূতের কণ্ঠে আক্ষেপের সুর। 'আজ তিন বছর ধরে পড়ে আছি অন্ধকার কুঠুরিতে। কেউ আমার খোঁজটি পর্যন্ত নেয়নি। অন্ধকারে চামচিকা, তেলাপোকা নির্ভয়ে বিষ্ঠা ত্যাগ করেছে আমার নাকে-মুখে, পুরো শরীরে। কী করে এসব সহ্য করি বল?'
'সত্যিই তো অনেক কষ্ট তোমার। শুনে আমারও খুব খারাপ লাগছে।' ভূতকে স্বান্ত্বনা দিয়ে কথাগুলো বলে রাসেল।
রাসেলের কথায় খুশি হয়ে রোবট ভূত বলে, 'তোর মনটা অনেক ভালোরে। এবার শোন আমার ভূত হওয়ার কাহিনি। একা একা অন্ধকার ঘরে থাকতে থাকতে একদিন মনে হলো আমার সব বুদ্ধি লোপ পেয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ আমার মস্তিষ্কে যে সফটওয়্যার দেওয়া ছিল তা ডিলিট হয়ে গেল। ভুলে গেলাম আমার সব কর্মদক্ষতা। মৃতু্য হলো আমার।'
অবাক হয়ে রাসেল বলে, 'মরে গেলে তুমি? রোবটের আবার মৃতু্য হয় নাকি?'
'হয়। আমিই তার প্রমাণ। মরে যাওয়ার পর
অনুভব করলাম আমার শরীরটা অনেক হালকা হয়ে গেছে। যেন আকাশে ভাসছি আমি। বুঝলাম একটা প্রচন্ড রকমের শক্তি সৃষ্টি হয়েছে আমার মধ্যে। সেই সঙ্গে চোখ থেকে মাঝেমধ্যেই লাল-নীল আলোর বিচ্ছুরণ ঘটছে।'
'লাল-নীল আলোর বিচ্ছুরণ! একটু আগেই তা দেখেছি। খুব ভয় পেয়েছিলাম। তারপর কী হলো?' রাসেলের প্রশ্ন।
কিছুটা উলস্নসিত হয়ে রোবট ভূত বলে, 'ভয় পেয়েছিস শুনে খুব ভালো লাগল। মানুষকে ভয় দেখানোই তো আমার কাজ। তারপর কী হলো শোন। মুহূর্তেই সেই অন্ধকার কুঠুরির দরজা ভেঙে বেরিয়ে পড়ি। আকাশে ভাসতে ভাসতে চলে আসি এই তেঁতুল গাছটায়। মরে গিয়ে ভালোই হলো। এখন আমি মুক্ত-স্বাধীন।'
ভয়টা যেন পুরোপুরিই কেটে গেছে রাসেলের। ভূতকে বলে, 'এবার আমায় যেতে দাও। মায়ের কাছে যাব আমি। আমাকে যেতে দাও।'
রাসেলের কথায় অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে রোবট ভূত। 'ছেড়ে দেব তোকে! হা-হা-হা। কক্ষনোই না। মানুষ আমার চির শত্রম্ন। রোবট ভূতদের কোনো দয়ামায়া নেই। তোর ঘাড় মটকে দিয়ে চরম প্রতিশোধ নেব আজ।'
এদিকে অন্ধকার আরও গাঢ় হয়ে এসেছে।
দূরের বন থেকে ভেসে আসা শেয়ালের ডাক পরিবেশটাকে আরও ভয়ংকর করে তুলেছে।
ভূতটা এক পা-দু'পা করে এগিয়ে আসে রাসেলের দিকে। চোখ থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে লাল-নীল আলো। কী করবে, কিছুই বুঝতে পারছে না সে। পা দুটো যেন মাটির সঙ্গে সেঁটে গেছে।। মুহূর্তেই রোবট ভূতের দুটো মেটালিক হাত চেপে ধরে রাসেলের গলা। দম বন্ধ হয়ে আসে তার। বাঁচাও বাঁচাও বলে জোরে চিৎকার দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু গলা দিয়ে কেবল গোঙানোর মতো অস্পষ্ট আওয়াজ বের হয়ে আসে।
এমন সময় গায়ে যেন কার মৃদু ধাক্কা অনুভব করে রাসেল। ধাক্কার সঙ্গে সঙ্গে যেন মায়ের কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছে সে, 'কী রে, স্বপ্ন দেখছিস নাকি? আজ বিকালে খেলতে যাবি না মাঠে?' এবার সবকিছু স্পষ্ট হয় তার কাছে। হাসতে হাসতে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে রাসেল, 'যাব মা। বন্ধুরা নিশ্চয়ই আমার জন্যে অপেক্ষা করছে।'