আমার নাম, আফ্রিকান গন্ডার। তবে, আমার আরেকটা বৈজ্ঞানিক নাম হলো, ঈবৎধঃড়ঃযবৎরঁস ঝরসঁস (সেরাটোথেরিয়াম সিমুম)। আমার বর্তমান বাসস্থান, ঢাকা মিরপুর এক নাম্বার জাতীয় চিড়িয়াখানায়। তোমরা জানলে অবাক হবে যে, বাংলাদেশের আমিই একমাত্র গন্ডার। দ্বিতীয়টি আর নেই। যদিও আমার সঙ্গী ছিল।
২০১১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আমাদের এই জাতীয় চিড়িয়াখানায় নিয়ে আসা হয়। তখন আমাদের বয়স তিন, কিংবা সাড়ে তিন বছর। আমরা সাধারণত দক্ষিণ আফ্রিকা, লামিবিয়া, জিম্বাবুয়ে, মোজাম্বিক, জাম্বিয়া, তানজানিয়া, কেনিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করে থাকি। আমাদের দেহের চেয়ে পা দুটি বেশ ছোট। তবে চামড়া আমাদের ঢের মোটা। আমাদের রং হলুদ বেগুনি বর্ণ থেকে ধূসর হয়ে থাকে। আমরা কাদাপানিতে গড়াগড়ি করতে পছন্দ করি। খেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি সবুজ ঘাস, শাকসবজি। তবে, গোপন কথা জানো কি? আজ বলে দেই তোমাদের। আমাদের গন্ডারদের দৃষ্টিশক্তি দুর্বল। ত্রিশ মিটার দূরের কোনো বস্তু আমাদের নজরে পড়ে না। তবে হঁ্যা, আমাদের ঘ্রাণশক্তি প্রখর।
২০১৩ সালে আমার সঙ্গী পুরুষ গন্ডারটি ব্রেন হেমোরেজে মারা যায়। বাংলাদেশের এই জাতীয় চিড়িয়াখানাতেই। সেদিন থেকেই আমি একা। একা বলতে একেবারেই একা। একাই আমার বসবাস। আমার সঙ্গীর শোক কিছুতেই কাটছিল না। আমি ভেঙে পড়লাম। তবে, ধীরে ধীরে আমি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠি। তোমরা যারা আমাকে জাতীয় চিড়িয়াখানায় দেখতে যাও, দেখ না আমি কেমন একা থাকি। নিশ্চল আমার চলাফেরা। যেন আমার শরীরে টু-ও শক্তি নেই। মন চায় আমার সেই ছোট্ট ঘরেই পড়ে রই। কিন্তু কীভাবে ঘরে থাকি বলো? তোমরা আমাকে দেখতে আসো সেই কত্ত দূর-দূরান্ত থেকে। কত্ত আশা নিয়ে। যদি দেখ আমি মন ভোঁতা করে ঘরে বসে থাকি তাহলে তোমাদের আনন্দটাই মাটি হয়ে যাবে না? তাই আমি শত কষ্টেও ঘরে বসে থাকি না। চলাচল করি তোমাদের সামনে। তোমাদের আনন্দ দেওয়ার জন্যে। কিন্তু আমার একটা দুঃখ আছে। খুব দুঃখ। তোমরা অনেকেই আমাকে খুব কষ্ট দাও!
এখন বলবে, আমরা তোমাকে কীভাবে কষ্ট দেই?
একটু ভাবো তো, কীভাবে আমি গন্ডারকে কষ্ট দাও তোমরা? থাক, আর ভাবতে হবে না। আমিই বলছি। না বলে তো আর উপায় নেই। প্রতিনিয়ত তোমরা যারা যাচ্ছ চিড়িয়াখানায় তাদের কেউ না কেউ আমাকে কষ্ট দিয়েই আসছ। তোমরা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। যাকে বলে আশরাফুল মাখলুকাত। তোমরা কীভাবে আমি গন্ডারকে এমন কষ্ট দাও!
তোমরা জাতীয় চিড়িয়াখানা পুরোটা ঘুরে শেষে আসো আমাকে দেখতে। অবশ্য অনেকেই আমি গন্ডার যেদিকে থাকি সেদিক দিয়ে শুরু করে যাত্রা। কিন্তু সবাই আমার কাছে এসে একটাই কথা বলে। সবাই বলে গন্ডারের চামড়া ঢের মোটা। বন্দুকের গুলিও ভেত করতে পারে না। শুধু কি একথা বলেই চলে যায়? না, না। একথা বলেই ইটপাটকেল ছুড়ে মারে আমার গা বরাবর। আমি ব্যথাতুর হয়ে ওঠি। আহ! একথা মনে হলে আমার বুকটা কষ্টে ফেটে যায়।
আমি গন্ডারকে দেখে তোমরা আনন্দ পাও। আমি গন্ডার তোমাদের আনন্দ দেওয়ার জন্য শত অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও উঠে দাঁড়াই। পায়চারি করি তোমাদের সামনে। কিন্তু সেই তোমরা আমি গন্ডরকে কী দিলে? তোমরা জানো, তোমাদের ইটপাটকেলের আঘাতের চিহ্ন আমার চেহারা থেকে শুরু করে সারা গায়ে বিদ্যমান। সারাদিন ব্যথাহত হয়েই তোমাদের সামনে হাঁটাহাঁটি করি তোমাদের আনন্দ দেওয়ার জন্য। রাতে সেই আঘাতের ব্যথায় অস্থির হয়ে ওঠি। শরীরে জ্বর ওঠে। শুতে গিয়েও ঘুমাতে পারি না। ব্যথায় ছটফটিয়ে ওঠি। একাত-ওকাত করতে করতে রাত ফুরোয় আমার। আবার সকাল হয়। তোমরা আসো। আমাকে দেখ। আনন্দ পাও। যাওয়ার সময় ইটপাটকেল ছুড়ে আমার শরীর ক্ষতবিক্ষত করে চলে যাও। আমি আবারও ব্যথাতুর হয়ে পড়ি। এভাবেই আমার দিন কাটছে তোমাদের জাতীয় চিড়িয়াখানায়। আমার তো আশঙ্কা হয়, না জানি তোমাদের আঘাতেই আমার মৃতু্য হয়!
জানি, তোমরা অনেকেই আমার কথা বিশ্বাস করছ না। এবার যদি কখনো তোমরা চিড়িয়াখানায় আসো তাহলে খেয়াল করবে আমি গন্ডারকে দেখতে আসা মানুষদের প্রতি। তারা কী বলে শুনবে মনোযোগী হয়ে। এবং দেখবে সতর্ক হয়ে, তাদের হাতে কী। কী ছুড়ছে আমার দিকে। অবশ্য অনেকেই রকমারির খাবার ছুড়ে আমার দিকে। কিন্তু ইটপাটকেলই ছুড়ে বেশি। আর হঁ্যা, একটু ভালো করে খেয়াল করো আমার শরীরটাতে। দেখবে কত ক্ষতের দাগ আমার সারা শরীরে সেঁটে আছে। কোনোটা মরা। কোনোটা তরতাজা। তাতে মাছি বসে ভোঁ ভোঁ করছে।
আমি তোমাদের একটাই আহ্বান জানাই। জানাই আমার আকুতি। মানবতার দোহাই দিয়ে বলি, তোমরা যারা জাতীয় চিড়িয়াখানায় আসো আমাদের দেখতে, আনন্দ ভ্রমণ করতে, তোমাদের সন্তানদের আনন্দ দিতে। তাহলে কেন আমাদের ওপর এমন নির্যাতন করো? কেন তোমরা নিরীহ প্রাণীদের দিকে ঢিল ছোড়? আঘাত করো? আমরাও তো ব্যথা পাই। অসুস্থতায় ভোগী। তোমরা না মানুষ, সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব! একটু ভেব তো, আমাদের পরিস্থিতিটা!