মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১
গল্প

অমূল্য রত্ন

সারমিন ইসলাম রত্না
  ২১ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
অমূল্য রত্ন

রাজা ওসমান শেখের আছে অঢেল ধনরত্ন। সৈন্য-সামন্ত, সেপাই, লস্কর, অগণিত হাতি-ঘোড়া। কারুকার্যমন্ডিত বিশাল প্রাসাদ। চাঁদের মতো আলোয় আলোকিত বাতির ঝলকানি। তবু রাজার মন ভালো থাকে না। কারণ তার পুত্র নেই। আছে তিনজন রাজকন্যা। রাজপুত্রের মতো রাজকন্যা কী রাজ্য চালাতে পারে? রাজ্যের তাহলে কী হবে?

ভাবতে ভাবতে রাজা ওসমান শেখ অস্থির হয়ে ওঠেন। তার কিছুই ভালো লাগে না।

স্বয়ং রানিও রাজাকে শান্ত করতে পারছেন না। রাজার রাজকর্মে মন নেই। রাজা বিমর্ষ হয়ে সিংহাসনে বসে থাকেন। এমন সময় তিন রাজকন্যা হাজির হলো।

রাজাকে সম্মান জানিয়ে বলল, হে শ্রদ্ধেয় বাবা, আমাদের অনুমতি দিন। কিছু কথা বলব। রাজা ওসমান শেখ বললেন, অনুমতি দেওয়া হলো। বড়ো রাজকন্যা গোলাপ বলল, হে বাবা, আপনি আমার নাম গোলাপ রেখেছেন। কারণ আপনার দৃষ্টিতে আমি দেখতে গোলাপের মতো। আপনি আমাকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করেছেন। আপনার রাজ্যের দায়িত্ব আমি যথাযথ পালন করতে পারব। অতএব, চিন্তা করবেন না।

রাজা ওসমান শেখ রাগতস্বরে বললেন, চিন্তা করব না মানে? যতই তুমি

গোলাপের মতো হও। যতই তুমি জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হও। তুমি যে কন্যা। আর পুত্র অপেক্ষা কন্যা সর্বদাই দুর্বল হয়।

মেজো রাজকন্যা বৃষ্টি শান্ত স্বরে বলল, হে শ্রদ্ধেয় বাবা, আপনি আমার নাম বৃষ্টি রেখেছেন। কারণ আপনার দৃষ্টিতে আমি দেখতে বৃষ্টির মতো। আপনি আমাকে অস্ত্র চালনায় দক্ষ করেছেন। আপনার ধারণা বৃষ্টিও ঝড়ে পরিণত হতে পারে। সেই ধারণা থেকেই বলছি, আপনার রাজ্যের দায়িত্ব যথাযথ পালন করতে পারব। অতএব, বিশ্বাস হারাবেন না। রাজা ওসমান শেখ বিদু্যতের মতো গর্জে ওঠে বললেন, বিশ্বাস হারাবো না মানে? যতই তুমি বৃষ্টির মতো হও। যতই তুমি অস্ত্র চালনায় দক্ষ হও। যতই তুমি ঝড়ে পরিণত হও। তুমি যে কন্যা। আর পুত্র অপেক্ষা কন্যা সর্বদাই কোমলমতি হয়।

ছোট রাজকন্যা হিরেমতি বলল, হে শ্রদ্ধেয় বাবা, আপনি আমার নাম রেখেছেন হিরেমতি। কারণ আপনার দৃষ্টিতে আমি দেখতে হীরের মতো। আপনি আমাকে শিখিয়েছেন কী করে অর্থ-সম্পদ রক্ষা করতে হয়। শিখিয়েছেন কী করে শত্রম্নকে পরাস্ত করতে হয়। আপনার রাজ্যের দায়িত্ব আমি যথাযথ পালন করতে পারব। অতএব, ভরসা হারাবেন না। রাজা ওসমান শেখ আগুন কণ্ঠে বললেন, ভরসা হারাবো না মানে? যতই তুমি দেখতে হীরের মতো হও। যতই তুমি অর্থ-সম্পদ রক্ষায় দক্ষ হও। শত্রম্নকে পরাস্ত করতে দক্ষ হও। তুমি যে কন্যা। আর পুত্র অপেক্ষা কন্যার সর্বদাই শক্তি কম হয়।

রাজা ওসমান শেখ বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। হঠাৎ প্রহরী বলল, হে জাঁহাপনা, প্রাসাদে ফিরে চলুন। রাজা চমকে ওঠে বললেন, কিন্তু, কেন? প্রহরী বলল, হে জাঁহাপনা, ক্ষমা করুন। মনে হচ্ছে ঝড় হবে। রাজা ওসমান শেখ আকাশের দিকে তাকালেন। যখন তিনি বেড়াতে বের হয়েছিলেন আকাশ ছিল নির্মল আর স্বচ্ছ। হঠাৎ এত কালো মেঘ কোথা থেকে এলো? কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝড়ো বাতাস শুরু হলো। বাগানের গাছগুলো থরথর করে কাঁপতে লাগল।

গাছের সব ফল আর ফুল ঝরে পড়ল।

রাজা ওসমান শেখ প্রাসাদে প্রবেশ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রাসাদের জানালাগুলো ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল। চারপাশ থেকে আর্তনাদ শুরু হলো। শুধু রাজা নির্বাক।

এমন ঝড় তিনি কখনোই দেখেননি। রাজার চোখে মুখে চিন্তার রেখা ফুটে

উঠল।

কয়েকদিন ধরেই চলল ঝড়। ভেঙে গেল প্রজাদের ঘর-বাড়ি। নষ্ট হলো ফসলি জমি।

প্রজাদের কাকুতি মিনতিতে কেঁদে উঠল রাজদরবার। তিন রাজকন্যা দরবারে উপস্থিত হলো। সেদিকে রাজার খেয়াল নেই। তিনি আপন মনে ভাবছেন, যদি আমার পুত্র থাকত তাহলে কত ভালো হতো। প্রজাদের অর্থ- সম্পদ প্রদান করলে রাজভান্ডারের অর্থ সম্পদ কমে যাবে। তিন রাজকন্যা রাজ্য জয় করে সেগুলো বৃদ্ধি করতে

\হ

পারবে না। হায়! কেন আমার পুত্র ভাগ্য হলো না? রাজার দীর্ঘশ্বাস রাজদরবারের সবাই উপলব্ধি করল।

বড়ো রাজকন্যা গোলাপ প্রজাদের উদ্দেশ্যে বলল, আমার দুঃখী প্রজারা, মনে সাহস রাখ। এ সময়ে মনোবল খুব দরকার। তোমাদের কাছে নিশ্চয়ই লোহার জিনিসপত্র আছে। সেসব অস্ত্রাগারে জমা দাও।

মেজো রাজকন্যা বৃষ্টি প্রজাদের উদ্দেশ্যে বলল, প্রিয় প্রজারা, তোমাদের মধ্য থেকে যারা যুবক বয়সের তারা সৈন্যদলে নাম লেখাও। অস্ত্র প্রশিক্ষণ নাও।

রাজকন্যা হিরেমতি প্রজাদের উদ্দেশ্যে বলল, আমার পরিশ্রমী প্রজারা, তোমরা যারা কৃষক তারা নিশ্চয়ই গাছ সম্পর্কে অবগত আছ। অতএব, রাজ্যের চারপাশে এমন গাছ লাগাও যেন আমাদের রাজ্য শত্রম্ন মুক্ত থাকে। প্রজারা রাজকন্যাদের কথায় ব্যতিব্যস্ত হলো। লোহার জিনিসপত্র অস্ত্রাগারে

জমা দিল। যুবকেরা সৈন্যদলে নাম লেখাল। কৃষকেরা গাছ লাগাল।

সবাই নিজ কর্ম সম্পাদন করে দরবারে উপস্থিত হলো। রাজকন্যাদের চোখেমুখে আলো ছড়িয়ে পড়ল। বড়ো রাজকন্যা গোলাপ বলল, তোমাদের লোহার জিনিসপত্র অস্ত্রাগারে জমা দিতে বলেছি। তার কারণ সেসব লোহার জিনিস দিয়ে অস্ত্র তৈরি করা হবে। আমাদের অস্ত্রাগার পরিপূর্ণ হবে। মেজো রাজকন্যা বৃষ্টি বলল, যুবকদের সৈন্যদলের নাম লেখাতে বলেছি, তার কারণ আমাদের সৈন্যদল ভারী হবে।

অন্যান্য রাজ্য জয় করতে আমাদের সহজ হবে। তারপর সেসব রাজ্যের ধনরত্ন রাজার এবং প্রজার হবে। ছোট রাজকন্যা হিরেমতি বলল, তোমাদের পরিশ্রমের কাজ দিয়েছি। তার কারণ তোমরা রাজার কাছ থেকে পারিশ্রমিক পাবে। এতে তোমাদের কাছে নিজেকে ক্ষুদ্র মনে হবে না। তোমরা স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে।

আমার প্রিয় প্রজারা, তোমরা রাজাকে সহযোগিতা করেছ। তাই রাজাও

তোমাদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন। এই বলে হিরেমতি প্রজাদের ধনরত্ন প্রদান করল। আর বলল, এগুলো বিক্রি করে তোমাদের যাবতীয় প্রয়োজন মিটাও।

রাজা ওসমান শেখ নীরব দর্শকের মতো সব দেখছিলেন আর শুনছিলেন। তার চোখে অশ্রম্ন জমে উঠল। রাজা ওসমান শেখ রাজকন্যাদের কাছে ডেকে বললেন, প্রিয় কন্যারা, আমায় ক্ষমা করে দাও। আমি ভুল করেছি। তোমাদের সঙ্গে অন্যায় করেছি। তোমাদের ক্ষুদ্র ভেবেছি। পুত্র অপেক্ষা কন্যা কখনোই দুর্বল নয়। বরং অনেক বেশি শক্তিশালী। কারণ কন্যা জননী, কন্যা ধরণি। কন্যাদের অবহেলা করেছিলাম বলেই স্র্রষ্টা রাজ্যের ওপর শান্তি বর্ষণ করেছেন। রাজা ওসমান শেখ ঘোষণা করলেন, প্রিয় প্রজারা, আমার অবর্তমানে পর্যায়ক্রমে আমার তিন রাজকন্যা রাজ্যের রানি হবে। তোমরা আগলে রেখ, তোমাদের অমূল্য রত্ন জননীদের।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে