শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

বায়ুদূষণে বাড়ছে রোগব্যাধি, মৃতু্য

ঢাকার ৯০ শতাংশ বাসিন্দা এখন বায়ুদূষণের শিকার। এ ছাড়া ৪০ শতাংশ বাসিন্দা শ্বাসনালির রোগে আক্রান্ত। প্রতিনিয়ত এই দূষণ বেড়ে চলছে। এতে গণমানুষের ভোগান্তি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
সুস্বাস্থ্য ডেস্ক
  ২২ মার্চ ২০২৩, ০০:০০
বায়ুদূষণে বাড়ছে রোগব্যাধি, মৃতু্য

বায়ুদূষণের কারণেই দেশে ব্যাপকহারে বাড়ছে শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগ। প্রতি বছর বায়ুদূষণে যখন লক্ষাধিক মানুষ মারা যাচ্ছে, তখন শ্বাসকষ্টজনিত রোগেই আক্রান্তের সংখ্যা পৌঁছেছে কোটিতে। আক্রান্তদের দ্রম্নত শনাক্তের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি কঠোরভাবে বায়ুদূষণ রোধের মাধ্যমেই রোগের নিয়ন্ত্রণ সম্ভব বলে মত বিশেষজ্ঞদের। বাংলাদেশ অ্যাজমা অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, দেশে হাঁপানি বা শ্বাসকষ্টজনিত রোগীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ, যেখানে প্রতি বছর নতুন করে যোগ হচ্ছে প্রায় আড়াই থেকে তিন লাখ মানুষ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাঁপানি বা শ্বাসকষ্টের সবচেয়ে বড় কারণ বায়ুদূষণ। মোট দূষণের ৩৮ ভাগ ইটভাটা থেকে সৃষ্ট হলেও তা বন্ধে নেই কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ। এ ছাড়াও অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, দীর্ঘ যানজটে ধীরগতির যানবাহন থেকে নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়া, খোলামেলাভাবে ভবন নির্মাণসহ নানা কারণে শ্বাসকষ্টজনিত রোগের কবলে পড়ছেন সাধারণ মানুষ। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলেন, ইটভাটা কমাতে হবে। শিল্প সব সময় শিল্প এলাকায় থাকবে। সেখানে দূষণের মাত্রা কমানোর জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। দ্রম্নত শনাক্তের মাধ্যমে এই রোগ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তবে সমস্যা সমাধানে প্রান্তিক পর্যায়ে চিকিৎসার সুযোগ সৃষ্টির আহ্বান বিশেষজ্ঞদের।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন এবং নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ ফোরামের দাবি ঢাকার ৯০ শতাংশ বাসিন্দা এখন বায়ুদূষণের শিকার। এ ছাড়া ৪০ শতাংশ বাসিন্দা শ্বাসনালির রোগে আক্রান্ত। প্রতিনিয়ত এই দূষণ বেড়ে চলছে। এতে গণমানুষের ভোগান্তি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অপরিকল্পিত নির্মাণকাজ এবং বিভিন্ন সেবামূলক কাজের জন্য যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়ি এই বায়ুদূষণের জন্য দায়ী বলে বক্তারা উলেস্নখ করেন।

'বাংলাদেশে পরিবেশগত বিশ্লেষণ-২০১৮' শিরোনামের বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ দেশে পরিবেশ দূষণজনিত রোগে প্রতি বছর ৮০ হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। এক বছরে বাংলাদেশে বিভিন্ন রোগে বা চিহ্নিত কারণে যত মৃতু্য হয়, তার ২৮ শতাংশই হয় পরিবেশ দূষণজনিত রোগে- যা প্রতি বছর বৈশ্বিক দূষণজনিত মৃতু্যহারের (১৬) চেয়ে ১২ শতাংশ বেশি। তবে তার আগের বছর ফেব্রম্নয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভালু্যয়েশনের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে এক লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষের মৃতু্য হচ্ছে। দুটি প্রতিষ্ঠানের ওই প্রতিবেদনে প্রায় কাছাকাছি সময়ের তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হলেও মৃতের সংখ্যার ব্যবধান ৪২ হাজারেরও বেশি। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনটির তথ্য ২০১৫ সালের আর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা দুটির তথ্যও ২০১৫-১৬ সালের। তবে পরিসংখ্যানগত ব্যবধান থাকলেও উভয় প্রতিবেদনেই দেশে পরিবেশ বা বায়ুদূষণজনিত রোগের ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণের মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশ হচ্ছে বায়ুদূষণ। আবার বায়ুদূষণের বড় অংশ হচ্ছে ধুলা।

জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলেন, ঢাকায় জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠেছে বায়ুদূষণ। বিশেষ করে শ্বাসকষ্ট ও হৃদরোগের প্রকোপ দ্রম্নত বেড়ে যাওয়ার জন্য বায়ুর সঙ্গে মিশে থাকা নানা রাসায়নিক দূষণকেই দায়ী করা হয়। এ ক্ষেত্রে সড়কগুলোতে যানজটের সময় দূষণের মাত্রা থাকে সবচেয়ে ক্ষতিকর পর্যায়ে। এ ছাড়া রয়েছে আশপাশে ইটেরভাটা, কলকারখানার মাধ্যমে পরিবেশ বা বায়ুদূষণ। বায়ুর সঙ্গে থাকা ক্ষতিকর উপাদানগুলো চোখে দেখা না গেলেও মানুষের শরীরে প্রবেশ করে শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া, চোখের সমস্যা, সর্দি, কাশি, যক্ষ্ণা, হৃদরোগ, অ্যাজমা, ফুসফুসের ক্যানসারসহ বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করতে পারে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, পরিবেশ দূষণজনিত রোগে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে প্রতি বছর যত সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটে, তার মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের পরে আছে ভারত ২৬ দশমিক ৫, পাকিস্তান ২৫ দশমিক ৮ এবং নেপালে ২৫ দশমিক ৪ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে বিভিন্ন রোগ ও কারণ চিহ্নিত করা মৃতু্য হয়েছে আট লাখ ৪৩ হাজার মানুষের। যার মধ্যে দুই লাখ ৩৪ হাজার মানুষের মৃতু্য হয়েছে পরিবেশ দূষণজনিত রোগে- যা ওই বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের চেয়ে দশগুণ। ওই বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ২১ হাজার ২৮৬ জন।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহামুদুর রহমান এ প্রসঙ্গে মানবজমিনকে বলেন, পরিবেশ দূষণের মধ্যে মূলত বায়ু, ধোঁয়া ও ধুলাজনিত দূষণের ফলেই এ দেশে মানুষের সবচেয়ে বেশি বিপদ বয়ে আনে। অনেক পুরনো মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির ধোঁয়াও মানুষের শরীরের ক্ষতি করে। বহু রোগব্যাধি ছড়ায়। বিশেষ করে শ্বাসকষ্ট, যক্ষ্ণা, অ্যাজমা, ব্রংকাইটিস রোগ এবং ক্ষতিকারক কেমিক্যালের ধোঁয়ার কারণে কিডনির ক্ষতি হয়। তিনি বলেন, এখানে একটু জায়গায় অনেক লোক থাকে। ফলে বহু রোগের বাসা বাঁধে। রোগের জীবাণু ছড়ায়। এ ছাড়া দূষণজনিত কারণে ক্যানসারসহ নানা জটিল রোগ দেখা দিতে পারে। এমনকি ডায়রিয়ার পেছনেও পরিবেশ দূষণজনিত কারণ রয়েছে। পরিবেশ দূষণ থেকে পানিও দূষিত হয়। রাস্তার পাশের বা ফুটপাথের দোকানে রাখা খাবারও ধোঁয়া-ধুলায় দূষিত বা বিষাক্ত হয়ে পড়ে। এসব খেয়ে মানুষ রোগাক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে